জঙ্গল যাপন বিশেষ ভ্রমণ

ঢাঙ্গিকুসুমে ধমক, হদহদিতে হন্যে

দীপক দাস

‘ছবি তুললে কেন?’ দীপুর ক্যামেরার শাটারের আওয়াজ শেষের সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষেপণাস্ত্রের মতো ধেয়ে এল প্রশ্নটা। জনস্থান হলে, ইয়ে মানে পাবলিক প্লেস আরকী, এতক্ষণে আমাদের চারিদিকে ভিড় জমে যেত। তার পর? ছোটবেলায় টিভিতে রামানন্দ সাগরের রামায়ণ হত। তির-ধনুকের মহাযুদ্ধ। রাম একটা তির ছুড়ল। সেই তির বিরোধীদের কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে রক্তবীজের মতো ঝাড়ে বংশে বেড়ে এক ঝাঁক তিরে পরিণত হল।

জনস্থানে প্রশ্নটাও অমন ঝাড়ে বংশে বাড়ত। তার পর, যা হচ্ছে চারিদিকে, পাবলিকের ধোলাই। কে বলে বাঙালির হাতের গুলিতে নয়, বুলিতে জোর? চাদ্দিকে দেখুন না। কথা নেই বার্তা নেই, আউল, বাউল ধরে পিটতে লেগেছে। আমরা আরও বেশি মার খেতাম। কারণ প্রশ্নটা করেছেন এক মহিলা। বাঙালির আর কিছু থাকুক আর না-ই থাকুক দু’টো জিনিস জোরদার রয়েছে। কূটকচালির স্বভাব আর যৌন ঈর্ষা। ভুল বললাম বোধহয়। ঈর্ষা নয়, শিভালরি হবে বোধহয়।

চললুম জঙ্গলের কাছে।

আমরা চারজন বেঁচে গেলাম। কারণ জায়গাটা জনস্থান নয়। জংলাস্থান। ঝাড়গ্রামের বিনপুর এলাকার ঢাঙ্গিকুসুম। দুর্গাপুজোর অষ্টমী। আর আমরা দল পাকিয়ে জঙ্গলে। আমলাশোল পার হয়ে, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ঝাড়খণ্ডের ঝাঁটিঝর্ণা দেখে আমরা হাজির ঢাঙ্গিকুসুমে। নামটা না-ও শোনা থাকতে পারে। কারণ ঝাড়গ্রামের অভিজাত সফর-স্থানের মধ্যে ঢাঙ্গিকুসুম পড়ে না। হালে দু’একবার নাম শোনা যাচ্ছে। কিন্তু ঢাঙ্গিকুসুম মানে কী? জানি না।

পাকা রাস্তা অনেক আগেই ছেড়ে এসেছি। আমাদের বাহন ছোটা হাতি কাঁচা, ইট, পাথরের টুকরোয় ভরা পথ দিয়ে গুড়গুড় করে এগোচ্ছে। রাস্তা ভাল নয়। পায়ে চলা পথ। মাঝে মাঝে গরুরু গাড়ি বা ভ্যান যেতে পারে। যদিও আমরা যতক্ষণ ছিলাম, একবারও কোনও বাহনই চোখে পড়েনি। এলাকায় জনবসতিই বা কোথায়! গাড়ি গড়াতে গড়াতে এক সময় থেমে গেল। আর রাস্তা নেই। পায়ে চলা পথ। নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে।

কত রং প্রকৃতির।

অসাধারণ প্রকৃতি। থমকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুধু অনুভব করতে হয়। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার একপাশের জায়গাটা টিলার মতো। পুরো রাস্তার ওই পাশটা উঁচুই। সেই উঁচুতে শাল, কেঁদ গাছ। আরও নাম না জানা গাছও রয়েছে। এক জায়গায় দেখলাম বাবুই ঘাস কেটে শুকোতে দেওয়া। এই ঘাস পাকিয়ে পাকিয়ে শক্তপোক্ত দড়ি হয়। শুকতারায় এক সময় টারজান ধারাবাহিক ভাবে বেরতো। অনুবাদক হিসেবে নাম থাকত সব্যসাচীর। পরে জেনেছিলাম, সব্যসাচী আসলে শিশু সাহিত্যিক সুধীরীন্দ্রনাথ রাহা। টারজানের খুব সুন্দর একটা ছবি আঁকা থাকত। কী চেহারা! সেই বানুষের (বানর এবং মানুষ) অস্ত্র হিসেবে ছিল একটা ছোরা। আর থাকত ঘাসের দড়ি। ছোটবেলায় ঘাসের দড়ি ব্যাপারটা ঠিক হজম হত না। ঘাসের দড়ি কখনও ওই চেহারাকে বইতে পারে! ছিঁড়ে পড়বে না?

ঝাঁটিঝর্নায় দড়ি পাকানো দেখে এত বছর পরে বিশ্বাস হল। আগে হাতে পাকানো হত। এখন যন্ত্র বেরিয়েছে। বহু লোক হাতেও পাকায়। জঙ্গলমহলে বাবুই ঘাসের দড়ি আয়ের একটা পথ। যে কথা বলছিলাম। আমাদের আরেক পাশে চাষের জমি। বেশ কিছুটা এলাকা জুড়ে ধান চাষ হয়েছে। চাষের জমি শেষ হলে ঝাঁটি জঙ্গল। অন্য গাছও রয়েছে। মাঝে এই রাস্তা। টিলার কিছুটা অংশ কেটে কি রাস্তা তৈরি হয়েছে? জানি না।

এই সেই প্রশ্ন-স্ট্রাইকার ভদ্রমহিলা।

আমরা জমিতে নেমে পড়লাম। লক্ষ্য জমি পেরিয়ে জঙ্গল। আরেকটা লক্ষ্যও ছিল। ধান জমি আর জঙ্গলের মাঝে এক চিলতে ডাঙা জমি। পাশাপাশি কোনও জনবসতি চোখে পড়েনি। কিন্তু ওই ডাঙা জমিতে দেখলাম কয়েকজন কাজ করছেন। তা ছাড়া জমির ঠিক পাশেই খড়ের একটা চালা রয়েছে। সব কিছু সরেজমিন দেখাটা দরকার। আলপথ দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। ভয় ছিল। একদম সরু আলপথ। ইন্দ্রর গথিক স্থাপত্যের থামের মতো পা সেই আলে আঁটবে কি! ব্যাটা টাল খেয়ে জমিতে পড়লে হয়েছে আর কী। জমিতে জল আছে। দীপু, বাবলা আর আমি ক্যাজুয়াল। উনি বাবু ফর্মাল। তা-ও সাদা জামা। পড়লে কাদায় মাখামাখি। আরেকটা বিপদও আছে। অক্টোবর মাস। শীতকাল আসছে। শীতল রক্তের প্রাণীরা প্রাণপণে খাওয়াদাওয়া সারছে। আলে কেউটে সাপ থাকে। কারও ঘাড়ে পা পড়লে ঠিক আছে। লেজে পড়লে। ধারে কাছে বাড়িঘর খুঁজলে পাব না। আবার হাসপাতাল।

বিপদ কিছু হল না। শুধু দীপু আমাদের লজ্জায় ফেলে দিল। জমির একটা জায়গায় আল কেটে জল যাওয়ার নালা কাটা। জায়গাটা ভিজে ভিজে। লাফিয়ে পার হতে হবে। ভেবেছিলুম, ইন্দ্র নির্ঘাত ফেল করবে। ও বাবা! দীপু টপকাতে গিয়ে পা ভিজিয়ে ফেলল। ঠিক পা নয়। জুতো। তার পর শুরু হল বাবলার নানা বিশেষণ। দীপু এখনও ছুটিছাটায় মাঠে যায়। ম্যাচ খেলে। বাবলাকে মাঠে যেতে প্ররোচিত করে। শরীরচর্চার এই নমুনা! সুযোগ বুঝে আমিও দু’চার কথা শুনিয়ে দিলুম। বয়স নিয়ে বড্ড খোটা দেয় যৌবন মদ মত্ত দীপশেখর। এক হাত নেওয়ার জন্য মাঝে মাঝে বুড়োও বলে।

আমাদের ফটোসেশন।

লাফালাফি করে কিছু লাভ হল না। আল এক জায়গায় গিয়ে শেষ হয়ে গেল। যাব কী করে! চেঁচিয়ে সেই কাজ করা লোকেদের জিজ্ঞাসা করলাম। ওঁরা বললেন ঘুরে আসতে হবে। আবার সেই পথে ফেরা। এবার দীপু ঠিকঠাক পেরোল। রামায়ণে কাকে যেন তাঁর শক্তি সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দিতে হয়েছিল? তার তিনি এক লাফে লঙ্কা!

এক সময়ে পৌঁছলাম সেই ডাঙা জমির কাছে। তার পরই দীপুর শাটার টেপা। আর এক মহিলার প্রশ্ন, ‘ছবি কেন তুললেন?’। মহিলাটি জমিতে কাজ করছিলেন। কীসের যেন বীজ বোনার কাজ চলছে। জমিতে দুই পুরুষও কাজ করছিলেন। আর একটা বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে দেখছিল। ভদ্রমহিলা শুধু প্রশ্নতেই থামলেন না। আমাদের হয়ে উত্তরও দিয়ে দিলেন, ‘বাড়ির মেয়েদের গিয়ে দেখাবে?’ উত্তর দিতে যাচ্ছিলুম, আমার হৃদযন্ত্র অতটা শক্তিশালী নয়। তাছাড়া ভারতে সামরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক নয়। ফলে ক্ষণে ক্ষণে সার্জিকাল স্ট্রাইকের ধাক্কা সামলানোর কৌশলও জানা নেই। ইন্দ্রর প্রশিক্ষণ চলছে। ও ছবি দেখালেও দেখাতে পারে। দীপু এখন অস্ত্র ত্যাগ করে ঘাসপুসে মন দিয়েছে। শুধু বাবলাটাই রংরুট। ওকে নাকি সোজা লাইন অব কন্ট্রোলে দাঁড় করিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে।

ফেরার পথে টালমাটাল।

কিন্তু কিছুই বলে উঠতে পারলাম না। একটা রসিকতা মনে পড়ে গিয়েছিল। শিশু জর্জ ওয়াশিংটন নাকি ছোটবেলায় কুড়ুল দিয়ে একটা আপেল গাছ কেটে ফেলেছিলেন। কুড়ুল হাতে বাবার কাছে ধরাও পড়েছিলেন। কিন্তু অপরাধ স্বীকার করায় বাবা ক্ষমা করেছিলেন ছেলেকে। গল্পটা শুনিয়ে এক শিক্ষক ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ওয়াশিংটনের বাবা কেন ক্ষমা করেছিলেন? ছাত্রের চটজলদি উত্তর, না করে উপায় ছিল! কুড়ুলটা যে ওয়াশিংটনের হাতে ছিল। আমিও দেখতে পেলুম, ভদ্রমহিলার সঙ্গে মাঠে কাজ করা এক পুরুষের হাতে কোদাল। আমি ওই সব বললে যদি ক্ষেপে যান!

দ্রুত ভুল স্বীকার করে নিলুম। বললুম, ভুল হয়ে গিয়েছে। আমার জীবনে এই ‘ভুল হয়ে গিয়েছে’ বাক্যাংশটি অনেক কাজে দিয়েছে। কত লাভা উদগিরণ থামিয়েছে। দেখলাম, ওঁরা আর কিছু না বলে কাজে লেগে গেলেন। ওদের সঙ্গে একটা বাচ্চা ছিল। সে শুধু দেখছিল। আমরাও দেখতে শুরু করলাম। জায়গাটার সৌন্দর্যের কী ভাবে বর্ণনা দিই? জঙ্গলের পাশে জমি। বেশ বোঝা যায়, জমিগুলো অনেক কষ্ট করে তৈরি করা হয়েছে। কারণ পাশে পাশে এখনও জংলা, অনাবাদী জমি। ডাঙা জমিটার ঠিক পাশেই একটা বিশাল গাছ। মহুয়া সম্ভবত। সবুজের এথানে কত রকম রং। ধান জমি সবুজ। জঙ্গলটা এত ঘন যে সবুজটা একটু কালচে মনে হচ্ছে। অনাবাদী ঘেসো জমি আবার হালকা, রুক্ষ সবুজ। ছবির পর ছবি উঠতে শুরু করল। সেই খড়ের চালা সামনেও ছবি উঠল। চালার ভিতরে অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে কী সব রাখা। ভাত হতে পারে। জল হতে পারে। হাঁড়িয়াও। একবার উল্টে দেখার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু সেই কোদাল!

এর মধ্যেই একটা আবিষ্কার হয়ে গেল। দীপু বিশাল একটা হাঁচি দিল। আর সঙ্গে সঙ্গে সেই হাঁচি ফেরত দিল প্রকৃতি। কী চমৎকার এক প্রতিধ্বনি। যেন ‘হিরা পান্না’ সিনেমায় জিনাত আমন ‘হিরা হিরা’ বলে আহ্বান করছে। আর প্রকৃতি সাড়া দিচ্ছে। ইন্দ্রর ভাল লেগে গেল সেই ধ্বনি-প্রতিধ্বনির খেলা। আমরা ফিরে আসছিলুম। হঠাৎ ও টারজানের মতো একটা ডাক ছাড়ল। এতই আচমকা যে আমাদের পিলে চমকে উঠল। প্রকৃতি অবশ্য সাড়া দিয়েছিল।

কেঁদ ফল।

ফিরে আসার সময় ভাবছিলাম, ভদ্রমহিলা কেন জিজ্ঞাসা করলেন, আমরা ছবি তুলে নিয়ে গিয়ে বাড়ির মেয়েদের দেখাব কিনা? কোনও হীন্মন্যতায় ভুগছেন?

ভাবতে ভাবতে গাড়ির কাছে পৌঁছে গেলাম। দেখি, ছোটা হাতির মাহুত ফল ভরা একটা ডাল ভেঙে নিয়ে বসে আছেন। জিজ্ঞাসা করতে বললেন, ‘কেঁদ ফল।’ তার মানে কেন্দু। এই গাছের পাতাই বিড়ি পাতা।

ছবি— ইন্দ্রজিৎ সাউ এবং দীপশেখর দাস

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *