দীপক দাস
ঘোরাঘুরিতে দু’টো কাজ। দ্বিতীয়, গন্তব্যের সৌন্দর্য চোখ-মন ভরে নেওয়া। প্রথম, পথ ও পথের প্রান্তের ছিটকে ছিটকে আসা রূপ এবং রূপ বদলকে যতটা সম্ভব স্মৃতিতে ধরে রাখা। আরও একটা কাজ আছে। সেটা হল স্থানীয় খাবার চেখে দেখা।
আমরা এখন প্রথম কাজটি করছি। গাড়ি ঢাঙ্গিকুসুম ছাড়িয়ে চলেছে হদহদির দিকে। ছোটা হাতির মাহুত হুড়মুড়িয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন। ইন্দ্র কেবিনে। আমি, দীপু আর বাবলা গাড়ির কেবিনের খোলের গায়ে হেলান দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে। পাকা রাস্তার পাশে মাঝে মাঝে দু’চারটে গ্রাম। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকটি বাড়ি নিয়ে গ্রাম সম্পূর্ণ। প্রচুর গাছগাছালি। দূরে দিগন্ত রেখায় জঙ্গলের বেড়া, পাহাড়ের পাঁচিল। এই জায়গায় একটাই অসুবিধে। কোথায় এলাম, কোথা দিয়ে যাচ্ছি, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। কারণ জায়গাগুলোর নাম জানি না। মাঝে মাঝে পথের পাশে গ্রাম নামের বোর্ড আছে বটে। কিন্তু স্মৃতিতে বেশিক্ষণ থাকছে না সেই নাম। সাইঁ সাঁই করে সরে যাওয়া পথ-ছবির মতোই সেগুলো পত পত করে উড়ে যাচ্ছে। কিন্তু মন ভরে উঠছে।
মন ভর্তি কত টুকরো টুকরো ছবি। কোথায় যেন একটা দেখলাম, পথের পাশে এক স্তম্ভ। তার দু’টো চৌকনো থাক। আয়তাকার। তার গায়ে বেশ কিছু ছবি আঁকা। জনজাতি প্রতিনিধি। এক মহিলাও রয়েছেন। চিনি না কাউকেই। একটি ছবি দেখে মনে হল, সিদো-কানহো হতে পারেন। আরেকজন বিরসা মুন্ডা। ঠিক বলতে পারব না। প্রান্তিক ইতিহাস তেমন ভাবে পড়ানো হয় কই? নিজেদেরও জানার গরজ থাকে না তেমন। আজ দুর্গাপুজোর অষ্টমী। রাস্তায় দেখা হল দুই কন্যার সঙ্গে। পুজো দিতে চলেছে। হাতে পুজোর উপাচারের থালা। হতে পারে কন্যা দু’টি দুই সখী বা পড়শি। ধীর পায়ে পাকা রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে। স্নানে স্নিগ্ধা। শ্যাম্পু করা চুল। পরনে শাড়ি। গল্প করতে করতে হাঁটছে। সে এক অপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা। আমাদের ছোটা হাতি ক্রমশ মেয়ে দু’টিকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু খোলা প্রান্তের মাঝে রাস্তাটা সরলরেখায় হওয়ায় অনেকটা দূর থেকেও কন্যা দু’টির হেঁটে আসা দেখতে পাচ্ছিলাম আমরা। দূরে সবুজের ঘেরাটোপ। কাছে অল্প ধূসর প্রান্তর। আর সেই প্রান্তরের মাঝে শুয়ে থাকা কালো পিচের রাস্তার উপরে দু’টি সচল, প্রাণবন্ত কন্যা। ওদের যদি জঙ্গলের মাঝে এমন পুজোর থালা হাতে নিয়ে হেঁটে আসতে দেখতাম, মনে হত দুই বনদেবী। ভক্তের পুজোয় খুশি হয়ে প্রসাদ বিতরণে আসছে। কত বয়স হবে? ১৩-১৪ বছর। শাড়ি পরার খুশিতে উচ্ছল। দীপুকে একবার ছবি তুলতে বলেছিলাম। ও রাজি হল না। স্বাভাবিক। এই মাত্র ছবি তোলার জন্য ধমক খেয়ে এলাম। তা-ও উনি ছিলেন মধ্যবয়সী। এরা কিশোরী। লোকে একবার সন্দেহ করলে বিপদের শেষ থাকবে না। কেউ কাব্যিক অনুভূতির কথা মানতে চাইবে না।
বেশ কিছুটা আসার পরে একটা পুজো মণ্ডপ পড়ল। বেলপাহাড়িতে আসার পরে কটা মণ্ডপ দেখেছি, হাতে গুনে বলে দিতে পারব। কলকাতা, হাওড়ায় পুজোর ছড়াছড়ি। চাঁদাবাজদের প্রাবল্যও বেশি। এখানে এত পুজো হয় না। সাদা চোখে তার মানেটা কী দাঁড়ায়? অর্থাভাব। মানুষের পকেটে পয়সা থাকলে আমোদ থাকবেই। তার মানে, উন্নয়নের মডেলটাই হল, রাজধানী আর তার আশপাশের জেলাগুলো। প্রান্তিক জেলাগুলোয় অর্থনীতির চুঁইয়ে পড়া নির্যাস এসে শুধু পড়ে রাস্তায়। রাস্তা মেপেই উন্নয়নের মাপজোক তৈরি হয়। আরেকটা জিনিস মনে হল, ওই মেয়ে দু’টি এই মণ্ডপেই পুজো দিতে আসছে। ওদের যেখানে শেষ দেখেছি সেখান থেকে মণ্ডপের দূরত্ব অন্তত দু’কিলোমিটার হবেই। তার আগে কতটা হেঁটেছে কে জানে?
দেখতে দেখতে হদহদি চলে এলাম। চলে এলাম ব্যাপারটা মোটেও বাঁশতলা স্টেশন ছাড়ার পরেই ট্রেন ঝাড়গ্রাম ঢুকছে এমন নয়। পথে জিজ্ঞাসাবাদ চলেছে। তারপর দীর্ঘ জঙ্গল মাঝারে পথ পার। একটু সন্দেহ। তার পর গাড়ি থামিয়ে লোক খোঁজা। লোক কোথায় পাব। বহুক্ষণ আগে একটা লোককে জঙ্গল পথে সাইকেল চালিয়ে যেতে দেখেছি। গাড়ি আরেকটু এগোল। দু’টো মেয়েকে দেখা গেল। ছাগল চরাচ্ছে। আমাদের মাহুত ওদের জিজ্ঞাসা করল। মেয়ে দু’টো বলল, হদহদির জঙ্গলে ঢোকার জায়গাটা আমরা পার হয়ে এসেছি। তার পর ছোটা হাতিকে পিছিয়ে নিয়ে চলা। মাহুত বন্ধু জঙ্গলে ঢুকতে রাজি হলেন না। ওঁর এই সব প্রকৃতিতে তেমন কোনও আগ্রহ নেই। বেলপাহাড়িতে গাড়ি বুক করার সময়েও উনি বলছিলেন ঢাঙ্গিকুসুমে দেখার কী আছে! মানুষ হাতের কাছে যা পায় তাকে অবহেলা করবেই। সে বড়ই সুদূর পিয়াসী। কী আর করা। সঙ্গে রেশনের থলি আর জলের বোতল ধরিয়ে দিলুম তাঁকে। উনি গাড়ির কাছে বসে রইলেন। আমরা জঙ্গলে ঢুকে গেলাম।
রুক্ষ, পাথুরে মাটি। মূলত শালের জঙ্গল। এছাড়া মহুয়া গাছও রয়েছে। কেন্দু আর পলাশ ছিল কিনা মনে পড়ছে না। এই গাছগুলোই চিনি। বাকি গাছগুলোর নাম বলতে পারব না। কিছুটা ঢোকার পরে জঙ্গল ঘন হতে শুরু করল। আর মাটির রং পাল্টাতে থাকল। আসলে পাথরের। রাস্তার কাছের জঙ্গলের পাথর ধূসর। কিন্তু আমরা যত ভিতরে ঢুকলাম কিছু কালো রঙের পাথরও চোখে পড়ল। আরেকটু ভিতরে ঢুকতে বেশ কিছু গর্ত দেখা গেল। মানুষের তৈরিই। সেখানে অনেক পাথরের টুকরো। দীপু বলল, এখান থেকে বোধহয় পাথর তোলে। কী কাজে লাগে? বাবলা বলল, রাস্তাটা দেখলে না? পাথরের টুকরোই তো ছড়ানো।
জঙ্গলের ভিতরে কী পাথর দেখেছিলাম সেদিন বুঝতে পারিনি। হদহদি নামের মানে জানার পরে একটা সম্ভাবনার কথা মনে আসছে। আগে নামের মানেটা বলি। অর্থটি বলেছিলেন আমার দূরের বন্ধু তরুণ সিংহ মহাপাত্র। সত্যিই মহাপাত্র। অনেক বিদ্যের আধার তিনি। হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে তাঁর জ্ঞানের টুকটাক টুকরো এই অর্বাচীনকে দিয়ে সমৃদ্ধ করেন গবেষক তরুণটি। উনি জানালেন, কাদা যুক্ত মাটিকে এখানকার ভাষায় হদহদি বলে। আসল শব্দটি হদহদ্যা। লিঙ্গান্তরে হদহদি। এই জঙ্গলের পাথরগুলো কি তাহলে কাদা বা স্লেট পাথর ছিল? জানি না। ও হ্যাঁ, ঢাঙ্গিকুসুমের অর্থও তিনি জানিয়েছেন। ঢাঙ্গি শব্দটিও স্ত্রী লিঙ্গ। আসল শব্দ ঢাঙ্গা। মানে লম্বা। স্ত্রী লিঙ্গে ঢাঙ্গি। ঢাঙ্গিকুসুম মানে যেখানে লম্বা কুসুম গাছ আছে। আহা বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’এর সেই কুসুম। সেই যে মোহনপুরা রিজার্ভ ফরেস্টের এক জায়গায় মঞ্চী কুসুম ফুল কাটছিল। ‘কুসুমফুলের পাপড়ির গুঁড়া লাগিয়া তাহার হাতখানা ও পরনের শাড়ির সামনের দিকটা রাঙা’, বর্ণনা বিভূতিভূষণের। কিন্তু কুসুম গাছ যে চিনি নে!
হদহদির জঙ্গলে কেমন যেন গা ছমছম করছিল। ঘন নির্জন জঙ্গল। ছোটা হাতি করে এসেছি। কিন্তু জঙ্গল থেকে সত্যিকারের হাতি যদি বেরিয়ে আসে! আমি, বাবলা আর দীপু ছুটে পালাতে পারব। কিন্তু ভয়টা ইন্দ্রকে নিয়ে। ওর যেটুকু ছোটাছুটি সে সব খাওয়ার জন্য। লদবদে ইন্দ্রকে ধরতে কোনও হাতির তিরিশ সেকেন্ডও লাগবে না। আমরা তো আর কেউ টেনিদা বা টিনটিন নই। টেনিদাকে বন দফতরের কুনকি হাতি নিয়ে পালিয়েছিল। আর টিনটিনকে তো হাতির দল পুষেছিল। ইন্দ্রকে পুষবে? বোধহয় নয়। আর ও পোষ মানতে চাইবেও না। হাতিরা যে ঘাস পাতা খায়!
ইচ্ছে ছিল জঙ্গলের আরও গভীরে যাওয়ার। বেলপাহাড়িতে আমরা যে অতিথিশালায় উঠেছি সেটির মালিক রাহুলদা বলেছিলেন, হদহদিতে একটা ঝর্না আছে। তবে বাইরের লোকের পক্ষে ঝর্না খুঁজে বের করা মুশকিল। উনি পরামর্শ দিয়েছিলেন, এলাকার কোনও বাচ্চাকে সঙ্গে নিতে। তাকে ৫০ টাকা দিয়ে দিতে। এলাকা কোথায় যে বাচ্চা খুঁজব! বাধ্য হয়েই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলাম।
তার পর কাঁকড়াঝোর হয়ে বেলপাহাড়ির পথে। রাস্তায় এক পাথরশিল্পীর বাড়িতে ঢুকেছিলাম। আমাদের মাহুত নিয়ে গিয়েছিলেন। উনি পাথর আর কাট কেটে নানা সামগ্রী তৈরি করেন। থালা, মূর্তি, রুটি বেলার বেলন চাকি। শিল্পী ছিলেন না। তাঁর ছেলে আর আমাদের মাহুত মিলে যা রাম ঠকান ঠকালেন! সে সব কথা বলতেও সংকোচ হয়।
তবে শিল্পীর বাড়ির এলাকাটি বেশ সুন্দর। আম গাছের ছায়া ঘেরা চত্বর। পাকা রাস্তার বীথি। আর আম গাছের ফাঁক দিয়ে দূরের পাহাড়ের ঝলক। কেনাকাটার ঠকার কিছুটা দাম উঠে এসেছিল সৌন্দর্য দর্শনে।
ছবি- দীপশেখর দাস ও ইন্দ্রজিৎ সাউ
(সমাপ্ত)
ঢাঙ্গিকুসুমে ধমক, হদহদিতে হন্যে- পড়ে চমৎকার লাগল । “কেউ এঁদের সম্পর্কে তথ্য দিতে পারেন? জানি না এঁদের কীর্তি সম্পর্কে “- প্রসঙ্গে বলি বামে উপরে পন্ডিত রঘুনাথ মুরমু। নিচে সিধু-কানু আর নিচে ডান দিকে বিরসা মুন্ডা। উপরের মহিলাকে চিনতে পারলাম না । বর্ননা পড়ে ও ছবি দেখে বুঝলাম আর তিন মিনিট হাঁটলে আপনারা হদহদি বা হুদহুদি তে পৌছে যেতেন। বাকি রাস্তার ছবি গুলো দিলাম। এই বসন্তে তোলা।
সিদো কানু বিরসা থাকবেন অনুমান ছিল। কিন্তু পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মুর নামটা সেই সময়ে খেয়ালে আসেনি। আপনার তথ্য কাজে লাগবে।
ভারি চমৎকার লেখা । আর তিন মিনিট হাঁটলেই হদহদি বা হুদহুদিতে পৌছে যেতেন। বাকি পথের ছবি গুলো মেইল করে দিলাম। এই বসন্তে তোলা। পরেরবার নিশ্চই ওখানে পৌছে যাবেন। আবারও আসুন সবাই।
পথ দেখিয়ে দেওয়ার কাউকে পাইনি। তাই ওই ঝরনাটা দেখা হয়নি। আপনার পাঠানো ছবিতে আমাদের চোখের শান্তি হল। ছবিটা লেখায় নিলাম। ধন্যবাদ মৃন্ময়বাবু।