পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

জ্যোতিপাহাড়ি কথা

মৃন্ময় হোতা


তখন আমাদের সবে যুবকবেলা। কেউ কেউ চাকরি পেয়েছি কিন্তু বেশির ভাগই বেকার। তারও আগে মাথা খেয়েছে রাহুল সংকৃত্যায়নের ‘ভবঘুরে শাস্ত্র’। ছেলেবেলায় আমাদের গ্রামের নবতিপর এক গ্রাম্য জ্যোতিষী দাদু্র মুখে শুনেছিলাম সুবর্নরেখার তীরে ‘গুহাপাল’ নাকি অতি চমৎকার জায়গা কিন্তু গরুর গাড়ি ছাড়া যাওয়ার উপায় নেই। পাশেই হাতির দাঁতের মত চকচকে ‘জ্যোতিপাহাড়ী’ । পাহাড়ের গুহায় নাকি তিনি ছবিও দেখেছেন। ওখানে ওনার অনেক যযমান তাই খুব খাতির মেলে। যাওয়ার রাস্তায় যে দিক নির্দেশনা তিনি দিয়ে ছিলেন তাতে জায়গাটার অবস্থান ঝাড়খণ্ড ( তখন বিহার) ও উড়িষ্যার সীমান্তে বলে মনে হয়েছিল। উনি আমার বাবাকে বলেছিলেন উনি সঙ্গে করে আমাদের গুহাপালে নিয়ে যাবেন। বাবা ছেলেবেলায় কোথাও গেলে আমাকেই সাথে নিতেন। তাই সেই দিব্যদর্শী (এটা ওনার উপাধি ছিল) জ্যোতিষীর আশ্বাসে মনটা নেচে উঠেছিল। কল্পনায় দেখতে পেতাম জ্যোতিপাহাড়ী থেকে দুপুর রোদ ঠিকরে বেরোচ্ছে আর আমি তাকাতে পারছি না।

বাবাকে মাঝে মাঝে তাড়া দিই গুহাপাল নিয়ে যাওয়ার জন্য। বাবা হাসেন আর বলেন – দাঁড়া, তোর জ্যোতিষী দাদুর সময় হোক । দিন যায়, মাস যায়, একদিন সকালে উঠে শুনলাম জ্যোতিষী দাদু চিরতরে চলে গেছেন। সেদিন বালকমনে এটা মনে হয়েছিল জ্যোতিপাহাড়ীও বোধহয় চিরতরে হারিয়ে গেল, একটা অব্যক্ত যন্ত্রনা কোথায় যেন দলা পাকিয়ে উঠেছিল। তারপর কালের নিয়মে সব সয়ে গেল। নতুন চাকরি নিয়ে আমায় ছেড়ে বাবা গেলেন নাগাল্যান্ড। জ্যোতিপাহাড়ী ক্রমশ ঝাপসা হতে হতে মনের কোণে ভেসে রইল হ্যালির ধূমকেতুর মতো। তারপর সেকেন্ডারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পেরতে চলে গেল আরো অনেক গুলো বছর। কিন্তু একটা অদৃশ্য ও অমোঘ টান বোধহয় কোথাও জায়মান ছিল নাহলে আমার প্রথম চাকরির জায়গাটা কেনই বা হবে বাংলা – বিহার সীমান্তের এক গন্ডগ্রাম। বিকেলে কাজের পরে কানে ওয়াকম্যান লাগিয়ে সাইকেলে চষে বেড়াই মোরামের ছোট ছোট টিলা, ধূ ধূ প্রান্তর, জঙ্গল, ঝর্না, নদী…। চেনা – অচেনা কারো সাথে দেখা হলে জানতে চাই গুহাপাল কোন দিকে? জ্যোতিপাহাড়ী দেখেছেন? লোকেরা দুদিকে মাথা নাড়ে। একদিন এরকমই এক বিকেলে একদল মানুষ হাট থেকে গরু কিনে মেঠো রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে বিহার সীমান্তের দিকে যাচ্ছিল আমার ঐ একঘেঁয়ে প্রশ্ন শুনে পরস্পরের মুখোমুখি চাওয়া চাওয়ি করল তারপর ওদের একজন প্রশ্ন করল – কেন বাবু গুহাপালে আপনার কি কাজ? বেড়াতে যাব শুনে তাদের সেকি হাসি। হাসি থামিয়ে একজন বলল  – জায়গাটা এখান থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার, বাসরাস্তা ছেড়ে ৬-৭ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে গেলেই জ্যোতিপাহাড়ী দেখা যাবে আর ঐ পাহাড়ের নিচে গুহাপাল গ্রাম। বাসস্টপের নাম মহিষপুর। আমরা তো ঐ পাহাড়ের পাশ দিয়ে সুবর্ণরেখা পেরিয়ে উড়িষ্যায় যাব।

আমার অবস্থা তখন আর্কিমিডিসের মত। পারলে ইউরেকা বলে চেঁচিয়ে উঠি। যাই হোক সেই শরতের রঙিন বিকেলে বাড়ি ফেরার তাড়ায়, আমার আরও কিছু প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে গোখুর রেনু উড়িয়ে ওঁরা মিলিয়ে গেলেন দিগন্তে।

ঘাটশিলার দৃশ্য।

বাসায় ফিরে আমি রাহুলজীর শিষ্যদের চিঠি দিলাম  সবকিছু জানিয়ে। সামনের পুজোর ছুটিতে যাতে সবাই জড়ো হতে পারি গুহাপাল যাওয়ার উদ্দেশ্যে। প্রথম শ্রেণীর ভবঘুরে হওয়ার লক্ষ্যে তখন  আমরা সুযোগ পেলেই লো কস্ট অথবা নো কস্ট  ভ্রমণ করতাম। সে বড় মজার দিন ছিল আমাদের।

নেইকো গুড় গুড় ঢাক ঢাক

আমরা ভাত ছড়ালেই কাক।

একে জড়ো হলো সাতজন। দুর্গাপূজার এক ঝকঝকে সকালে আমরা বম্বে রোডে দাঁড়িয়ে হাত দেখিয়ে থামালাম এক ভিনদেশী লরি কে। কারণ সে সময় লরির চালকরা সাধারণত কোন ভাড়া নিতেন না । ওঠার পরই চালক এর প্রশ্ন – কাঁহা জানা হ্যায়? আমরা বলি – থোড়া আগে যানা হ্যায়। কিঁউ? আমাদের উত্তর –  ঘুমনে কে লিয়ে । শুনে ড্রাইভার ও খালাসীর সে কি হাসি। আগে কাহা ঘুমোগে ইয়ার? উধার তো জঙ্গলহি জঙ্গল অর বহত ঝাড়ি হ্যায়। আমরা বলি – ওই জঙ্গলের আগে নামিয়ে দেবেন। শুনে ড্রাইভার বলে পাগল কাহিকা!  এইসব কথাবার্তা চলতে চলতে এক সময় পৌছে যাই মহিষপুর। আমাদের ঝুপ করে নামিয়ে দিয়ে লরিটা সোজা চলে গেল জঙ্গলের পেট চিরে কালো পিচের রাস্তা ধরে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে এক বন্ধুর মন্তব্য – এ কোথায় এলাম গো? কোথায় তোমার জ্যোতিপাহাড়ি? এতো ধুতমা ডাঙা! অনেক দূরে দু্রে একটা আধটা পাহাড়ের আবছা রেখা দেখা যাচ্ছে । আরেকজন বলল – ছাড়ো তো। এসো হাঁটা লাগাই জ্যোতিপাহাড়ি ঠিক পাওয়া যাবে। পিচের রাস্তা থেকে নেমে বামের মেঠো লাল মোরামের  রাস্তা ধরি তারপর চড়া রোদ মাথায় নিয়ে আমরা হাটা দিলাম। দু’পাশে ধান ক্ষেত কখনোবা একটা আধটা শালুক ফোটা পুকুর । এসব পেরিয়ে চলতে চলতে আমরা সবাই যখন কিছুটা ক্লান্ত, তখন কে যেন চেঁচিয়ে উঠলো – সামনে দেখো! সত্যি দেখে আমরা অবাক হয়ে গেলাম একটু দূর থেকে হলেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সামনের টিলাটা যেন হাতির দাঁতের মত চকচকে আর ঠিক আমার কল্পনার মতোই রোদ ঠিকরে  আসছে। আমাদের চলার গতি বেড়ে গেল। কত তাড়াতাড়ি ওখানে পৌঁছানো যায়। কিন্তু তখন একটা জলের বোতলও সঙ্গে আনিনি তাই ওই কাঠফাটা রোদে সবার গলা শুকিয়ে কাঠ আর কান দিয়ে যেন আগুন বেরোচ্ছিল। একসময় এসে পৌছালাম একটা গ্রামে। নাম জানা গেল গুহাপাল। ওঃ আমার সেই শৈশবের স্বপ্নের গ্রাম!

গ্রামের রাস্তায় এতগুলি আগন্তুককে দেখে বহু মানুষের মনে জিজ্ঞাসা। গ্রামের একমাত্র দোকানে আমরা  জাঁকিয়ে বসলাম। ওখানকার বিখ্যাত কালো জিলিপি,  চপ, মুড়ি কাঁচা লঙ্কা আর খাদ্য চা দিয়ে উদরপূর্তি করতে করতে দোকানদারের কাছ থেকে জানা গেল এলাকার হাল হকিকত। জানা গেল টিলার একটা অংশ নাকি সরকার থেকে কেটে নিচ্ছে। ওটা নাকি কাইনাইটের খনি। গুহাটা আছে টিলার মাঝামাঝি। প্রায় তিরিশ বছর আগে কোন কলেজের  ছেলে-মেয়েরা নাকি বেড়াতে এসেছিল তারপর দ্বিতীয় দল হিসেবে আমাদের পদার্পণ। গ্রামের সবাই অনুরোধ করলেন আগে সুবর্ণরেখা দেখে যান। গ্রামের সুনিবিড় ছায়াপথের দুধারে পাথর ও মাটিতে তৈরি পুরানো সব খড়ের বা টিনের চালের বাড়ি যায় শেষ একটা পুরনো শিব মন্দিরে। ওখানে নদীর উঁচু কাতা (পাড়) থেকে ঢালু রাস্তা নেমেছে সবুজ স্বচ্ছ  সুবর্ণরেখারেখায়। নদীর ভিতর থেকে প্রাগৈতিহাসিক প্রানীর মত মাথা উঁচিয়ে আছে বড় বড় শিলারাশি। নদীতে নামার লোভ সম্বরন করে আমরা এগোই জ্যোতিপাহাড়ীর দিকে। এখানে মানুষের ভাষা ওড়িয়া যদিও নদীর এপারটা বিহার। 

রাস্তায় গরু – ছাগল নিয়ে ছাতা মাথায় দাঁড়িয়েছিলেন খালি গা ধুতি পরা  এক ব্রাহ্মণ (মোটা পৈতা দেখেই মালুম হয়েছিল)  । আলাপচারিতার পর আমাদের পথপ্রদর্শক হয়ে সঙ্গ নিলেন। টিলার শানু দেশে পাথরের মস্ত চাতালের গায়ে একটা নড়বড়ে কুঁড়েঘর। আমাদের গলার আওয়াজে ভিতর থেকে হাসিমুখে বেরিয়ে এলেন এক  দেহাতি বৃদ্ধা। আমাদের উদ্দেশ্য শোনার পর সপাটে প্রশ্ন – বাছারা দুপুরে খাবে কোথায়? আমরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম। তখনো জলখাবার হজম হয়নি আর তাছাড়া এ ধরনের ভ্রমনে দুপুরটা বুনো পেয়ারা – কুল – বেল খেয়েও   আমরা কাটিয়েছি। আমাদের অবস্থা দেখে কিঞ্চিত ইতস্তততার পর উনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন – আহা কেউ যদি আমাকে সামান দিত তাহলে আমি বাছাদের রেঁধে খাওয়াতাম! এবার এগিয়ে এলেন সেই ব্রাহ্মণ। দেহাতি ওড়িয়ায় বললেন – তুই চল আমার সাথে যা যা লাগবে নিয়ে আসবি, সত্যি তো আমাদের গ্রামে এসে ছেলে গুলো দুপুরে অভুক্ত থাকবে? বাবুরা তোমরা মনের সুখে বেড়াও। মাউসি তোমাদের ভাত খাওয়াবে।

ওরা চলে যেতেই বন্ধুদের সেকি নৃত্য! আমি তখন নীল আকাশে পুঞ্জ পুঞ্জ সাদা কিউমিউলাসের ফাঁকে দেখতে পেলাম জ্যেতিষী দাদুর হাসি – কি? বলেছিলাম কিনা ওখানে মানুষ খুব অতিথি বৎসল।

পশ্চিমের জেলাগুলো এবং ঝাড়খণ্ডে এমন দৃশ্য হামেশাই চোখে পড়ে।

তারপর কয়েক ঘন্টা ধরে চলল, টিলায় চড়া, গুহায় ঢোকা, নদী-স্নান, চোরাবালিতে পড়া, আতঙ্ক ও অবশেষে উদ্ধার। টিলার উপর থেকে সুবর্নরেখার কি অপরূপ দৃশ্য! ডাইনে শিয়ালবিন্দ্ধা আর শিরবই  ডুংরুর সুউচ্চ শিখর আর বামে নদীর ওপারে উড়িষ্যার ছুরিয়াপাহাড়ের সারি।  টিলার পাথরে প্রচুর মাইকা আর ওটাই জ্যোতিপাহাড়ীর জ্যোতির রহস্য। কাইনাইট ঠিকাদারেরা একটু একটু করে পাথরের স্তর গুলো কেটে নিচ্ছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল, এভাবে চললে বোধহয় বছর কুড়ি পরে জ্যোতিপাহাড়ীর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হবে! গুহায় প্রচুর বাদুড় আর চামচিকা ঝুলছিলো। আমাদের সঙ্গে টর্চও ছিলনা তাই বেশি ভেতরে যাওয়ার সাহস হলোনা । আমরা গুহাচিত্র থাকলেও দেখতে পাইনি। তারপর মাউসির কাছে ভাত খাওয়া। টাটকা শালপাতার থালায় লাল মোটা চালের ভাত, মুগ কলাই এর সবুজ ডাল, আলু – বেগুনের তরকারি আর কাঁচা লঙ্কা। আহা, সেই অবেলায় কি খাওয়াই না খেলাম মাউসির কাছে। তারপর আকাশ দেখতে দেখতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ছি সবাই টিলার চ্যাটালো পাথরে। হঠাৎ এক বন্ধুর ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো সবার। সূর্য প্রায় অস্তমিত।

চটজলদি মাউসির কাছে বিদায় নিয়ে আবার পথে নামা। ছয় কিলোমিটার দুরত্ব প্রায় ছুটে আবার মহিষপুর। ভয় একটাই, অন্ধকার হয়ে গেলে লরি অচেনা লোককে তুলবে না। যাইহোক, দিনটা আমাদেরই ছিল। আমাদের সম্মিলিত হাত নাড়ার তীব্রতায় সেই আধো অন্ধকারে একটা লরি আমাদের তুলে নিল বিনা প্রশ্নে তারপর ফিরতি পথে গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম হুস করে। বাসায় ফিরে সবাই যখন বিছানায় টান টান এক বন্ধু আমাদের মুখ দেখে লাফিয়ে উঠে বলল – এখানে তো কোন মাউসি নেই, আমি বাবা রাতের ভাতটা এখনি রেঁধে রাখি।

তোমরা তো বাবা এখনি ঘুমাবে আর মাঝরাতে উঠে খিদের চোটে জ্বালাবে। সত্যি সেদিন তাই হয়েছিল। রাত দুটায় ঘুম থেকে উঠে অমৃততূল্য ডিম-আলুভাতে ডাল ভাত খেয়ে বাকি রাতটা আমরা গল্প করে কাটিয়ে দিয়েছিলাম।

তারপর আমাদের সবার চাকরি হয়েছে, সংসার হয়েছে। এখনও আমরা সপরিবারে সদলবলে বেড়াতে যাই কিন্তু জ্যোতিপাহাড়ীর মত অলৌকিক ভ্রমন আর হয়না।

পুনশ্চ -১) বর্তমানে গুগুল আর্থে দেখেছি আমাদের আশঙ্কা সত্যি ছিল। জ্যোতিপাহাড়ীকে কেউ যেন বেলচা দিয়ে চেঁচে তুলে নিয়েছে। রয়েছে কেবল ঠাকুর থানটা। পুনশ্চ ২) ১৯৪৩ সালে বিভূতিভূষণ  জ্যোতিপাহাড়ী ও কাইনাইটের খনি দেখে গিয়েছিলেন।

সম্পাদকীয় স্বীকারোক্তি— লেখক যে সময়ের অভিজ্ঞতার কথা বলছেন তখন ক্যামেরার চল ছিল না। মোবাইল ক্যামেরা তো দূর অস্ত। ফলে লেখায় ব্যবহৃত ছবিগুলো সবই প্রতিনিধি স্থানীয়। শুধু প্রচ্ছদের ছবিটি সুবর্ণরেখার। ঘাটশিলার সুবর্ণরেখা। তবে লেখকের বর্ণনার সঙ্গে অনেকটাই মেলে।

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *