সৌগত পাল
কত তারিখ টিকিট করব? টিকিট কনফার্ম হবে তো? ছুটির জন্য আবেদন করতে হবে। হোটেলে ঘর বুক করতে হবে।
যথা ইচ্ছার ঘুরতে যাওয়া আর রিজার্ভেশন? ঠিক মিলছে না তো? মিলবে না কারণ, এটা পুরো দস্তুর পারিবারিক ঘোরাঘুরি। এতে ‘ভোজনং যত্রতত্র শয়নং হট্টমন্দিরে’ হলে হবে না। তাই এসব ব্যবস্থা। রেলের সেবা করার জন্য রেল বছরে ঘোরাঘুরির জন্য পাস দেয়। সেটার সদ্ব্যবহার করার জন্য এবার বিশাখাপত্তনম ঘোরার পরিকল্পনা।
কিন্তু যাব বললেই কি যাওয়া যায়। ছুটি চাই। সেটার যে বড় অভাব। তার পর রিজার্ভেশন। এখন তো বাঙালির ঘোরা মানে দক্ষিণেই যায়। যাদের ঘোরা হয়ে গেছে তাদের থেকে সব জানলাম। কন্যাকুমারী এক্সপ্রেসে টিকিট হল। হাওড়া থেকে বিকেল ৪টে ১০মিনিটে ছাড়ে। দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে আমতা লোকাল ধরে হাওড়া স্টেশন। ইতিমধ্যে ব্যাগপত্র গোছানো হয়েছে। শুধু খাবারদাবার এর একটা আলাদা ঢাউস ব্যাগ হয়েছে। মাতৃদেবীর যুক্তি, ওখানে কিছু খাবার দাবার পাওয়া যাবে না। তাই মুড়ি চানাচুর বিস্কুট চিড়ে সব বস্তা বন্দি হয়েছে। দীপু ঘাস পাতা খুঁজতে হিমালয় যায় প্রতি বছর। ও বোধহয় এত রেশন নিয়ে যায় না। আমতা লোকাল ধরা তো গেল। সাঁতরাগাছি অবধি হুড়মুড়িয়ে চলেও এল। বাকি রাস্তা যেতে যেতে একটা গোটা সিনেমা দেখে ফেলা যায়। সাঁতরাগাছি ছাড়ার পর আমতা লোকালের পাশে পাশে একটা খালি গাড়ি হাওড়ার দিকে চলতে থাকল। সে তো রোজ কোনও না কোনও গাড়ি যায়। আজ গাড়িটায় চোখ আটকে গেল।
এটা কন্যাকুমারী এক্সপ্রেস। সাঁতরাগাছি ইয়ার্ড থেকে হাওড়া যাচ্ছে। হাওড়া থেকে ছাড়বে। তার পর দু’টো ট্রেন পাশাপাশি একবার দাঁড়ায় একবার চলে। যেন স্লো ট্রেন রেস করছে দুজন মিলে। একবার ভাবলাম যদি আমতা লোকাল এই রেসে জেতার জন্য স্লো চলতে থাকে তাহলে তো হয়ে গেল। কন্যাকুমারী এক্সপ্রেস কন্যাকুমারীর উদ্দেশ্যে রওনা দেবে আর আমরা আবার আমতা লোকাল ধরে বাড়ি।
কিন্তু আমার আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত করে আমতা লোকাল হাওড়া এসে পৌঁছল। স্টেশন থেকে বাকিদের সাথে যোগাযোগ করে ট্রেন ধরতে চললাম। ও এতক্ষণ বলা হয়নি আমাদের দলে কতজন লোক। আমার বাড়ির লোক, আমার মা আর ভাই। হাওড়াতে অপেক্ষা করছিল আমার সহকর্মী পৃথ্বীশ আর ওর মা। যথা সময়ে ট্রেন ছাড়ল। আমরা বসে নিজেদের মধ্যে গল্প করছি হঠাৎ রেলের ক্যাটারিং সার্ভিসের একজন কর্মী এসে বললেন নিন চা খান। আমতা লোকালে এলেন তো। আমতা লোকালে এলে এরকম আপ্যায়ন পাওয়া যাচ্ছে! ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলাম না। ভদ্রলোক বললেন উনিও ওই ট্রেনেই এসেছেন। বাড়ি মানসিংহপুরে। গ্রামটা আমাদের গ্রামের কাছাকাছি।
ট্রেনের গতি বাড়তে থাকল। দেউলটি, উলুবেড়িয়া একে একে পার করে গেলাম। ট্রেন থামল খড়গপুরে। তারপর সন্ধের সময় থামল বালেশ্বর, ভদ্রক। রাত হল। খাওয়াদাওয়া করে নিলাম। ভোরবেলা নামতে হবে। তাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ব। ১০টার সময় কটক পার করলাম। তারপর ভুবনেশ্বর। এরপর ঘুম। ট্রেন সঠিক সময়ে মানে ভোর ৫টা ৩৫মিনিটে বিশাখাপত্তনম পৌঁছে গেল। নেমে চারপাশটা দেখতে লাগলাম। আধো অন্ধকারে স্টেশনের বাইরে একটা পাহাড় চোখে পড়ল। দেখতে দেখতে স্টেশন থেকে বাইরে এলাম। স্টেশন চত্বরটা বেশ বড়। এবার থাকার জায়গার খোঁজ করতে হবে। কিন্তু এত সকাল কোনো গেস্টহাউস কি খোলা থাকবে? একটা গাড়ির খোঁজ করতে লাগলাম। কিন্তু ছোটো গাড়ি আর পাওয়া যায় না। সব বড়। সেরকম একটা গাড়ি নিয়ে রওনা দিলাম। আমাদের গন্তব্য হোটেল সোনার বাংলা। সবাই এখানেই ওঠার পরামর্শ দিয়েছিল। চারপাশের রাস্তা বাড়ি ঘর দেখতে দেখতে চললাম।
শহর হিসেবে খুব সাজানো। আর নিরাপত্তা বাহিনীর তিনটি শাখারই ঘাঁটি রয়েছে এখানে। পাহাড়ি পাকদণ্ডী দিয়ে গাড়ি মসৃণ গতিতে ছুটে চলল। মাঝে মাঝে সমুদ্রের গর্জন কানে আসছিল। কিছু পরে সমুদ্রের সামনে এসে গাড়ি থেমে গেল। এসে গেছি। ভাড়া মিটিয়ে পৌঁছলাম হোটেলের লবিতে। ঘর দেখে পছন্দ করে নিলাম। ঘরের সামনে খোলা ব্যালকনি। সামনে সমুদ্র। কিছু লোকজন শরীরচর্চা করছেন। আরো দূরে জাহাজ ভেসে বেড়াচ্ছে। দূরে দেখা যাচ্ছে বিখ্যাত ‘ডলফিন’স নোজ’। হঠাৎ যেন লোকজনের মধ্যে একটা আলোড়ন দেখা গেল। সবাই চটপট ক্যামেরা নিয়ে রেডি। কোনো তারকা আসছে নাকি। তারপর বুঝলাম কী ব্যাপার। সমুদ্রতীরে সূর্যোদয় হচ্ছে। মুগ্ধ হয়ে দেখলাম। সে দৃশ্য বর্ণনা দেবার সাহস আমার নেই।
১০টার মধ্যে স্নান করে সবাই তৈরি হয়ে গেলাম। হোটেলের গাড়ি বলা ছিল। তাতে করেই আমরা ঘুরব। গাড়িতে বসে আমাদের প্রথম গন্তব্য হল একটা খাবার দোকান। সকালের টিফিন করে যাত্রা শুরু হবে। ড্রাইভারদাদা নিয়ে এলেন একটা দোকানে। সেখানেই খাওয়াদাওয়া হল। ইডলি দোসা আর সাথে সম্বর। বেশ ভালোই লাগলো। তারপর গাড়ি চলতে লাগল। রামকৃষ্ণ বিচের পাশ দিয়ে। আমাদের হোটেলটাও রামকৃষ্ণ বিচের পাশেই। গাড়ি থামল VUDA পার্কের সামনে। টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকতে হবে। ভিতরে প্রায় কিছুই নেই। কয়েকটা খাবারের স্টল আর গাছগাছালি দিয়ে ঘেরা বসার জায়গা। আর সামনে সমুদ্র। ওখান থেকে বেরিয়ে আমরা গেলাম ঋষিকোন্ডা বিচ। সুন্দর ছবির মতো সাজানো জায়গা। বসে বসে সমুদ্র দেখলাম। তারপর গেলাম কৈলাস গিরি। ওখান থেকে পুরো শহরটা দেখা যায়। রোপওয়ে করে উপরে উঠলাম। উপর থেকে পুরো শহরটা অসাধারণ লাগছে।
এসব দেখার পর দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পালা। একটা হোটেলে গাড়ি নিয়ে গেলেন ড্রাইভারদাদা। রীতিমতো বাঙালি হোটেল। খাওয়াদাওয়া সেরে পরের গন্তব্য সাবমেরিন মিউজিয়াম। একটা গোটা সাবমেরিনের পেটে ঢুকে পড়লাম আমরা। সত্যি সাবমেরিন নয়। সাবমেরিনের মডেল। তাতে কোথায় কোনও যন্ত্রপাতি আছে কোথায় থাকার ব্যবস্থা এইসব দেখা যায়। এরপর এয়ারক্র্যাফ্ট মিউজিয়াম। সেখানেও একই রকম ব্যবস্থা। এখানে সবাইকে একটা মোবাইল আর হেডফোন দেওয়া হচ্ছিল। ঘুরে ঘুরে যেটার সামনে যাচ্ছিলাম সেটার ইতিহাস শোনানো হচ্ছিল। সব দেখে বাইরে বেরোলাম। আজকের মতো ঘোরা শেষ।
ছবি- লেখক।
(চলবে)