শ্রেয়সী সেনশর্মা

ভাল্লাগে না শহর।
পরীক্ষা দেওয়ার একটা সুবিধা আছে, সেটা হল ওই যন্ত্রণা শেষে বেশ মজাসে ছুট্টি কাটানো যায়। যা হোক এই টিকিট কাটা, ট্রেন চড়ার একঘেয়েমি কাটাতে দাদাকে বললাম, ‘চ, ইস্কুটিতে পেট্রল ভর, চক্কর মেরে আসি।’ চক্করের চক্করে যে এক নতুন দুনিয়া আবিষ্কার করে ফেলব ভাবিনি। খানিকটা ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ শোনাল কি? সকাল ১০টা থেকে ক্যামেরা কাঁধে দুই যাযাবর চললাম।
প্রথম গন্তব্য চরসরাহাটি আর ঈশ্বরীপুরের গঙ্গা। সতীমার থান পেরিয়ে মিনিট দশেক। ওই জায়গায় সারা রাস্তা জুড়ে পুরনো মন্দির, দাঁত বের করা বট অশ্বত্থের দেয়ালের গায়ে যেন কর্তাভজা সম্প্রদায়ের ইতিহাসেরা কথা বলে। মিছরি পুকুরও চুপ করে থাকে না (সতীমার থান)। ফুসফুসটা তো কালো দূষণে ভর্তি, একটু সবুজ বাতাস না হয় নিলাম। প্রচণ্ড খারাপ রাস্তাতে লাফাতে লাফাতে অবশেষে সর্ষে ফুলের গলি পেরিয়ে চরসরাহাটির গঙ্গায় এসে পড়লাম। কী ভীষণ সুন্দর! একটা হালকা কুয়াশার পরত। কিছু বছর আগে যখন এসেছিলাম তখনও অব্দি গঙ্গার ঘাটে যাওয়া যেত কেবল দু’টি বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে। খানিক তার কৌলীন্য বজায় ছিল তখনও। এখন খুব অযত্ন টাকে বড় যত্ন করে সিমেন্ট মুড়িয়ে ‘দিলবর’ চালিয়ে খুব আধুনিক তথা শহুরে বানানোর একটা আপ্রাণ চেষ্টা। কিন্তু কিছু জায়গা বুনো থাকলেই যে ভালো লাগে।

নদী দিদি এখানে খুব উদার। মাঝখানে সরু রাস্তায় ভটভটি ভ্যান এক পেট লোক নিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার ঠিক ওপারে সাদা হলুদ ধনে সর্ষের মিলমিশে বড় বড় সৌর প্যানেলের স্নেহ আর দারোয়ান দাদার মতো মোবাইল টাওয়ারের কড়া পাহারা। দৃশ্য খুব সুন্দর এখানে, এক ধরনের শান্তি। ফটাফট ক্যামেরা আর খিচিক চলল খানিকক্ষণ। নদী দিদি বলতেই পারে ‘খানিক জিরাও এখানে বোনটি, দু’দণ্ড বসো, দুটো মনের কথা কও, তুমি যে খুব ক্লান্ত’। মনেই হবে বেশ বসি কিছুক্ষণ।

মন টাকে হাফ শান্ত করে এবারের গন্তব্য সগুনা চেকপোস্ট চার্চ। মদনপুরের চওড়া রাস্তা ধরে, কলাগাছের সারি, কল্যাণী ইন্ড্রাস্টিয়াল বেল্টের সারি সারি কল কারখানার পাহাড় সরিয়ে বাইক বাহিনী পৌঁছলাম নম্বর ১ রেলগেট পেরিয়ে সগুনা চার্চ। কুলিয়া পাট রোড ধরে একটি গলি ধরে এগোতে হবে। আসল নাম ‘Don Bosco catholic Church’। আদপে খুব কড়া নিয়ম এখানে। কেবল ২৫ ডিসেম্বর কিছুক্ষণের জন্য ঢুকতে দেয় সাধারণ মানুষকে। পাশে স্কুল অনাথ বাচ্চাদের, এবং ‘Graveyard’। লাল রঙের রংবাহারি পতাকা ঝোলানো, স্তূপীকৃত খড়ের গাদা, বেশ ভরভরন্ত। পাশে ফুল দিয়ে সাজানো একটি হুড খোলা গাড়ি, বুঝলাম নবদম্পতির যাত্রা উৎসব হবে। বড় বড় গ্লাস পেইন্টিং, মাতা মেরি, আর সবচেয়ে বড় কথা এখানেও শান্তি। চার্চের ভেতরে না ঢুকতে পারার খেদ চেপে চললাম ‘কুলিয়া পাটে’র মন্দিরের দিকে। তার আগে দু’ভাই বোন মিলে ঝুপড়িতে চা পান করে মনটাকে ১০০ শতাংশ ফুরফুরএ করে নিয়েছি।

স্মৃতিবিজড়িত কুলিয়ার পাট বৈষ্ণবদের একটি তীর্থস্থান। পৌষ মাসের কৃষ্ণা একাদশী তিথিতে শ্রীচৈতন্যদেব এই গ্রামের বৈষ্ণব-নিন্দুক পণ্ডিত কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত দেবানন্দের অপরাধ ভঞ্জন করেন। একে ‘অপরাধ ভঞ্জনে’র পাটও বলা হয়। মূলতও গৌর-নিতাই, কৃষ্ণ-রাধা পুজো পান। একটা সময় এই কুলিয়া গ্রামের পাশ দিয়ে যমুনা নদী বয়ে যেত। এখন তা শুকিয়ে ‘কুলিয়ার বিলে’ পরিণত হয়েছে। এখানকার একটি শিউলি গাছকে ‘বাঞ্ছাকল্পতরু’ বলা হয়। এই গাছের নিচে ভক্তরা অপরাধ ভঞ্জনের অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন।

সেখান থেকে ‘কুলিয়া বিলের’ যাযাবর পাখির দল ক্যামেরা বন্দির সঙ্গে বেলা পড়ার ইঙ্গিতে বুঝলাম ঘরমুখো হবার সময় হয়েছে।

জানি না কতটা মনের ক্লেদ কমলো। ঘুরতে বেরিয়ে এখানে এসে মনের রসদ, বাঁচার খোরাক যে ঢের পেয়েছি, সন্দেহ নেই। বাংলার গ্রামগুলোর এই লোককাহিনী, মেলা যেন রহস্যে মোড়া। কোনটা সত্য, মিথ্যা বিচার, নাকি কেবল বিশ্বাসে ভর করে এরা যেন আরও যুগে যুগে বেঁচে থাকে।
ছবি—লেখিকা
(সমাপ্ত)
কাছেপিঠেই থাকা এমন সব ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া’ স্থানের চিত্রসহ মনোরম বর্ণনা মনকে প্রশান্তি দেয়। শ্রীচৈতন্যদেব এর কুলিয়া বা অপরাধভঞ্জনপাট নিয়ে একটি প্রামাণ্য বই পড়ে প্রথম বিস্তারিত জেনেছিলাম এর সম্বন্ধে। এটা পড়েও ভালো লাগল বেশ।