রবিশঙ্কর দত্ত
উল্টোদিকের ছোট্ট চায়ের দোকানের অমৃতে একটু গলা ভিজিয়েই শুরু করতে হবে। তা না হলে গোটাটা আলুনি থেকে যাবে। তাই ছ’টা পাঁচের ট্রেন ধরে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টার এই ‘অমরনাথ যাত্রা’ শুরু করতে একটু আগেই পৌঁছতে হবে ঝাড়গ্রাম স্টেশনে।
সময় বাছার দরকার নেই। কারণ শুকনো এপ্রিলেই এত ভাল লাগবে তাই অন্য সময় একেবারে সংশয়হীন। বছরের যে কোনও সময়ই বাছা যেতে পারে।
আগে পরে অনেক চেনা আনন্দ তো আমাদের অপেক্ষায় আছেই। আমি শুধু এই যাত্রাপথের কথাই বলি। ওই যে দিনের গোটা খোরাকের নুনটুকু নিয়ে নিয়েছেন তো ঝাড়গ্রাম স্টেশনে? ব্যস্। হাতের ঘড়িতে ক’টা বাজে ছ’টা? একটু বসুন ফাঁকা স্টেশনের সবুজ-মাখা হাওয়ায়। দেখে বসতে হবে। কারণ তাহলে একেবারে ঘাড় ঘুরিয়েই পেয়ে যাবেন তাজা খবরের কাগজ। আর সে সব এড়িয়ে থাকতে চাইলে ঘাড় না ঘোরালেই হল।
ঝাড়গ্রাম স্টেশনে খড়্গপুর-ধানবাদ ট্রেন ঢুকবে ঠিক সময়েই। তাই স্টেশনে টাটামুখী যাত্রীদের সঙ্গে আলাপ জমতে বাধ্য। কারণ কাজে বেরোলেও শান্ত আতিথেয়তায় সকলেই বেড়ানোর মেজাজে থাকেন। আর নিত্যযাত্রী যদি বুঝতে পারেন পাশের জন আনকোরা তাহলে গল্প শুরু হবেই।
প্রায় ফাঁকা কামরায় উঠে নিজেকে তার রাজা রাজা মনে হবে। সত্যিই একটা অন্য রাজত্ব। নরম সকালে গড়িয়ে চলছে ট্রেন। এপ্রিলে কুয়াশা কুয়াশা ভাব। শুকনো মাটি আর সবুজ বনে পথ করে এগোচ্ছি। আসল ট্রেন মনেই হবে না। পিছন থেকে ছোটবেলায় পাড়ায় কোমর ধরে আমরা যেমন ট্রেন ট্রেন খেলেছি ঠিক সেইরকম খেলার মজায় পৌঁছলাম পরের স্টেশন।
ট্রেন থামল। কিন্তু স্টেশন কোথায়? প্ল্যাটফর্ম? টিকিটঘর? তার সামনে ব্যস্ততা? এই শব্দটার সঙ্গে পরিচয় নেই খাটপুরা হল্টের। অথবা এইরকম এক আগন্তুকের জন্য হয়ত বসে আছে সব ফেলে?
ততক্ষণে পাশের সিট ভরে গেছে। টের পেলাম সস্তার জর্দার তীব্র গন্ধে। খালি পেট কেমন করে উঠল ঠিকই কিন্তু তাকিয়ে যে চোখজোড়া চোখে পড়ল তাতে পরমাত্মীয়ের আবেগ। খয়ের মাখা দাঁতে নির্মল হাসি। বললেন, রাইট টাইম। আমাকেই, চেনাচেনাও নয়। বাইরে দেখলাম, কুয়াশা ঢাকা মাঠ পেরিয়ে ট্রেন এগোচ্ছে। সবুজে চিরে একফালি মোরামের রাস্তা। ট্রেনে একটা গান বাজছে। ভজনের মতো শোনাচ্ছে। পুরনো মডেলের মোবাইল, সুর ফেটে ফেটে যাচ্ছে। ঈশ্বরের কাছে সকলের জন্য মঙ্গল প্রার্থনা।
পরের স্টেশন চাকুলিয়া। একটু বেশি আনাগোনা। তারপর আর হারিয়ে যেতে নেই মানা।
পাহাড়ি শিশুর মতো আবহাওয়া। অচেনা সহযাত্রীর দিকে তাকিয়ে মুগ্ধতা বিনিময় চোখে চোখেই। আমার মুখ পড়ে বললেন, ধলভূমগড়। সত্যিই কী আন্তরিক অভ্যর্থনা।
নাহ্। আবেদন যতই তীব্র হোক, পরের স্টেশন ঘাটশিলার কথা বলছি না। জানালার মুখ দেখে সামান্য করুণা নেই। নিজের রূপে বিভোর। ভুলে থাকলাম জাম্বো সাইজের শসায়।
ততক্ষণে অবশ্য দু’দফায় ভাজাভুজি ঘুরে গেছে। পাশে যে ভদ্রলোক পান খাচ্ছিলেন তিনিই ভাজার পরে বাদাম নিলেন। আমিও। ওঁরা এ রাস্তায় নিত্য যান। তাই নিজেদের মধ্যেই গল্প করছিলেন। আর আমি চান্ডিলের ভিতরটা কল্পনা করছিলাম। নিজেই ভাবছিলাম, এই সাজানো রেপ্লিকার মতো বিরামডি তার পাড়া-গাঁ কত সুন্দর!
রং-তুলিতে তৈরি প্ল্যাটফর্ম রেল-পাড়…রং আর রং।
এই রূপ দেখাবে বলেই হয়ত ট্রেনের দরজা হাট করে রেখেছে ভারতীয় রেল।
পুরুলিয়ায় নামতে হল। মনটা রেখে এলাম পাকা খেজুর রঙের বার্নিশ করা সিটে। জানালার পাশে।
(সমাপ্ত)