ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

শশাঙ্কের কর্ণসুবর্ণে তিন মূর্তিমান

ফারুক আব্দুল্লাহ

অনেকদিন থেকেই ইচ্ছে ছিল রাজা শশাঙ্কের রাজধানী মুর্শিদাবাদের কর্ণসুবর্ণ দেখার। সেখানকার অতীতকে অনুভব করার। ইতিপূর্বে বহুবার পরিকল্পনা করেও তা ভেস্তে যায় নানান কারণে। তাই এবার যখন মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে আবার পরিকল্পনা হল কর্ণসুবর্ণ যাওয়ার আমার মনে হচ্ছিল, এবারও হয়তো হবে না যাওয়া। কিন্তু শোভনা এবং বিশ্বজিৎদার অদম্য ইচ্ছেয় এবারের পরিকল্পনা সফল হল।

শোভনা পেশায় স্কুল শিক্ষিকা। তার সাবজেক্ট ভূগোল হলেও ইতিহাস তাকে খুব টানে এবং ইতিহাস নিয়েই সে লেখালেখি করে। কর্ণসুবর্ণ তাকেও খুব টানছিল দির্ঘদিন ধরে। শোভনার এখানে আসার মূল উদ্দেশ্য ছিল এই সুপ্রাচীন রাজধানী শহরের অজানা ইতিহাস উদ্ধার করে তা নিয়ে লেখা। অন্যদিকে বিশ্বজিৎদা বাংলার শিক্ষক। তাঁর অবশ্য কর্ণসুবর্ণ আসার উদ্দেশ্য ছিল কিছুটা ভিন্ন। তিনি হাজার বছরের পুরনো এই রাজধানীতে আধ্যাত্মিকতার একটু ছোঁয়া পেতে চেয়েছিলেন। এই যাত্রায় একটি মজার বিষয় হল, এখানে আমরা তিনজন তিন জেলার মানুষ। আমি মুর্শিদাবাদের, শোভনা বর্ধমানের এবং বিশ্বজিৎদা নদিয়ার। যদিও বিশ্বজিৎদা কর্মসুত্রে এখন মুর্শিদাবাদেই থাকে সপ্তাহের অধিকাংশ দিন।

প্রাচীনত্বের নির্দশন।

৩০ মার্চ ভোরবেলা আমি এবং বিশ্বজিৎদা মুর্শিদাবাদের ইসলামপুর থেকে বাসে চড়ে বসলাম। ঘণ্টা খানিকের পথ বহরমপুর। সেখান থেকে আবার অটোতে মিনিট পনেরোর পথ খাগড়াঘাট স্টেশন। তার পর আজিমগঞ্জ-কাটোয়া প্যাসেঞ্জার বা কাটোয়াগামী যে কোনও ট্রেন ধরে মিনিট দশেকের পথ কর্ণসুবর্ণ স্টেশন। কিচ্ছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন মিলল।…

এখানেই ছিল গৌড়েশ্বর শশাঙ্কের প্রাসাদ।

এদিকে শোভনা আসছে কাটোয়া থেকে। দূরত্বের অনুয়ায়ী সময় মেপেই ট্রেন ধরা হয়েছিল। সেই মতো শোভনার আমাদের থেকে ৩০ মিনিট আগে পৌঁছে যাবার কথা। অথচ ও তখনও স্টেশনে  পৌঁছয়নি। ফোন করে জানতে পারলাম লাইনে কাজ চলায় বহু ট্রেন বাতিল এবং যেগুলি চলছে সেগুলিও অনেকটা লেট। শোভনা জানাল, তার আরও প্রায় ৪০ মিনিট সময় লাগবে কর্ণসুবর্ণ আসতে। ফলে আমরা স্টেশন থেকে বেরিয়ে গেলাম। এলাকার খোঁজ নিতে চায়ের দোকানে গিয়ে বসলাম। দোকানে উপস্থিত সকলেই খুব উৎসাহিত। আমরাও সেই সুযোগ কাজে লাগালাম। প্রত্যেকের কাছেই দেখি গল্পের বড় ঝুলি। সকলেই জানে তাদের গ্রাম প্রাচীন এবং একসময় এখানে রাজা শশাঙ্কের রাজধানী ছিল। এর বেশি তেমন জানে না বলেই মনে হল। তবে তারা গ্রামের বহু প্রাচীন লোককথা জানে। এর মধ্যেই একজন মাঝ বয়সী মানুষ বলে উঠল, তাদের পাড়ায় আজ থেকে প্রায় ৩০-৪০ বছর আগে মাটি খুঁড়তে গিয়ে নাকি একটি সোনার নৌকা পাওয়া গেছে। একথা শুনে আমার পাশে বসে থাকা মানুষটি বলে উঠল, তাদের পাড়ায় পুকুর খনন করতে গিয়ে একটি প্রাচীন পাথরের মুর্তি পাওয়া গেছে। এমন নানান গল্পে বেশ ভালই সময় কাটছিল আমাদের। এদিকে গল্প শুনতে শুনতে কখন যে শোভনার ট্রেন এসে গেছে বুঝতেই পারিনি। আমাদের টনক নড়ল শোভনার ফোন পেয়ে। আমরা স্টেশনে ফিরলাম।

বটবৃক্ষ পাশে পীরের থান।

এবার পালা আসল গন্তব্যে যাওয়া। আমাদের গন্তব্য তিনটি, ১) রাজবাড়িডাঙা ২) রাক্ষসীডাঙ্গা এবং ৩) কুঠির পাহাড়। তিনটি জায়গাই কাছাকাছি। পায়ে হেঁটেই যাওয়া যায়। যেহেতু একেবারেই নতুন তাই রাজবাড়িডাঙা যাওয়ার জন্য ব্যাটারি চালিত রিকশায় চড়লাম।

যেতে যেতে দেখছিলাম, একদা দাপুটে রাজা শশাঙ্কের রাজধানী নগরী আজ পরিণত হয়েছে গণ্ডগ্রামে। চোখে পড়ছে মাটির তৈরি বাড়ি। দিগন্ত বিস্তৃত ধানে ভরা জমি। কোথাও দেখা মিলছে সেই জমির মাঝেই উচু ঢিবি। সেই সঙ্গে মাঠের মধ্যেই সারি সারি তাল গাছ। রাঢ় বাংলার রূপ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে উপভোগ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। এর মধ্যেই রাস্তায় পড়ল চাঁদপাড়ার মোড়। এটিই গ্রামের বাসস্টপ। কথিত, এখানে নাকি চাঁদ সওদাগর এসে কিছুদিন অতিবাহিত করেছিলেন। তাই তাঁর নামানুসারেই এই পাড়ার নামকরণ করা হয়।…

রাজবাড়িডাঙায়।

অবশেষে এসে পৌঁছলাম রাজবাড়িডাঙায়। এখানে রয়েছে একটি প্রাচীন বৌদ্ধ মঠের ধ্বংসাবশেষ। যার বিরাট এলাকা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা হলেও মঠের খননকার্য সম্পূর্ণ হয়নি বলে জানালো স্থানীয় কিছু মানুষ। এলাকার এক প্রবীণ  তাঁর স্মৃতি হাতড়ে জানালেন যে, যখন খনন কাজ চলছিল তখন কয়েক বস্তা পোড়া চাল পাওয়া গেছিল। সেই প্রাচীন চাল দেখতে ঠিক মনে হলেও হাত দিলেই ধুলো হয়ে যেত। চাল ছাড়াও বহু মূর্তি এবং সোনার তৈরি অনেক কিছুই পাওয়া গেছে। কিন্ত অর্থাভাবে নাকি খনন কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এখন বিক্ষিপ্ত ভাবে এখানে সেখানে মাটির ভেতর থেকে ইট দেখা যায়। এর মধ্যেই মঠের মধ্যে একটি উঁচু অংশের মাটি শোভনা হাত দিয়ে খুড়তেই লালমাটির সঙ্গে বেরিয়ে এল মৃৎপাত্রের অজস্র টুকরো। এদিকে সুপ্রাচীন ধর্মীয় স্থানে এসে বিশ্বজিৎদার আধ্যাত্মিক মনও শান্ত হয়ে গেছে। দেখালাম দাদা এক বিরাট পাথরের উপর বসে আপন মনে ভেবে চলেছে। অন্যদিকে শোভনা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তার লেখার নমুনা সংগ্রহ করতে এবং ছবি তুলতে।

পদব্রজে ইতিহাস দর্শন।

দ্বিতীয় গন্তব্য রাক্ষসিডাঙায় হেঁটেই গেলাম। উদ্দেশ্য ছিল, পথের মাঝে যদি নতুন কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। তাই আমি ক্যামেরা নিয়ে আগে আগে হাঁটছিলাম। পেছনে বিশ্বজিৎদা আর শোভনা আধ্যাত্মিকতার নানান দিক নিয়ে আলোচনা করতে করতে আসছিল। রাক্ষসিডাঙা আসলে বিরাট এলাকা জুড়ে উঁচু ঢিবি। যার একটি অংশের কিছুটা পোড়া ইটের ভিত্তি অবশিষ্ট রয়েছে। এলাকাবাসীর কাছে জানলাম, এটিই নাকি রাজা শশাঙ্কের প্রাসাদ ছিল। পাশেই রয়েছে একটা প্রাচীন ঝুরিওয়ালা বট গাছ। এবং এই গাছের নিচেই রয়েছে কারকুন পীরের মাজার। এই মাজারকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর বৈশাখ মাসে মেলা বসে। সেই মেলায় এলাকার জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহণ মেলায় প্রাণের সঞ্চার করে।

সব কিছুই বেশ ভাল লাগছিল। কিন্ত একটা বিষয় কিছুতেই মাথায় আসছিল না, জায়গার নাম রাক্ষসিডাঙা কেন?  বটগাছ তলায় বসে থাকা এক প্রবীণকে একথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি জানালেন, এখানে নাকি এক ভয়ংকর রাক্ষস থাকত। যে প্রতিদিন একটি করে মানুষ খেত। এই কারকুন পীর সেই রাক্ষসকে মেরে এলাকায় শান্তি ফিরিয়ে আনেন। এখানে এসে একটা বিষয় খুব লক্ষ্য করছি, এখানকার মানুষদের কাছে গুপ্তধনের বহু গল্প রয়েছে। অনেককেই বলতে শুনছি, মাটি খুঁড়তে গিয়ে অনেকেই নাকি মূল্যবান দ্রব্য, সোনা,, দামি পাথরের তৈরি মূর্তি পেয়ে থাকে।

গৌড়ের রূপ চিরকালীন।

বেলা বাড়েছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গরম। প্রখর রোদের তাপে শুষ্ক রাঢ় অঞ্চলে আমরা ইতিমধ্যেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। সঙ্গে থাকা জলও শেষ। আশেপাশে কোথাও জলের দেখা নেই। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য মাত্র কয়েকশো মিটার। কিন্ত পায়ে হেঁটে যাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে বা শক্তি কোনটিই ছিল না। কিন্ত রাস্তায় তেমন কোনও যানবাহনের খোঁজও পাওয়া যাচ্ছিল না। ফলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আমরা বাধ্য হয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। কিছুটা এগোতেই পেয়ে গেলাম ব্যাটারি চালিত একটি রিকশা।

কুঠির পাহাড়ে পৌঁছে কিন্ত আমার মনে খটকা লাগল, এ জায়গা কুঠির পাহাড় হতে যাবে কেন? এত দেখি বিরাট খোলা মাঠ। রিকশা থেকে নামতেই অবশ্য ভুল ভাঙল। মাঠের একেবারে শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে দেখলাম এটা সত্যিই কোন মাঠ নয় এটা একটি উঁচু বিরাট আকারের ঢিবি। তাই হয়ত এলাকাবাসীর কাছে এই উঁচু ঢিবিই পাহাড় নামে পরিচিত। ঢিবির উপরের বিস্তীর্ণ মাঠের এক কোণে দেখলাম একটি উঁচু চিমনি। এলাকার লোকেদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, ইংরেজ আমলে এখনে একটি নীল কুঠি এবং একটি নীল কারখানা ছিল। এটি সেই কারখানারই চিমনি। এতক্ষণে পরিষ্কার হল, স্থানের নাম কুঠির পাহাড় কেন। এই উঁচু ঢিবিতেই হয়তো হাজার বছর আগে কোনও রাজার দুর্গ ছিল। আমরা ঢিবির গা বরাবর দুর্গম রাস্তা দিয়ে নীচে নামলাম। নীচে দিগন্ত বিস্তৃত চাষের জমি। নীচে নামার সময় শোভনা সেই দুর্গম রাস্তার দুই পাশে ঢিবির গায়ের ছবি তুলতে ব্যাস্ত হয়ে গেছে। এগিয়ে গেলাম ওর কাছে। দেখলাম, ঢিবির গায়ে প্রচুর মৃৎপাত্রের টুকরো মিশে আছে। বিশ্বজিৎদা একমনে দূরের সারি সারি তাল গাছ এবং সবুজ ধানের ক্ষেত দেখতে মগ্ন। বেশিক্ষণ থাকা গেল না। কারণ ইতিমধ্যেই আমাদের এনার্জি শেষ পর্যায়ে। প্রচণ্ড গরম।

এবার বাড়ি ফেরার পালা। ট্রেন লাইনে কাজ হওয়ায় প্রায় সমস্ত ট্রেনই বাতিল। যে কয়েকটি চলছে সেগুলিও বড্ড লেট করছে। ফলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার। কিন্তু সকাল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি। তাই খাবারের খোঁজে চাঁদপাড়া বাজারে। সেখানে বেশ কিছু দোকানপাট রয়েছে। কিন্তু অনেক খুঁজেও ভাতের হোটেল পেলাম না। শোভনার ইচ্ছে অনুযায়ী প্রথমে আখের রস খেয়ে তেষ্টা মেটালাম। কিন্ত তৃষ্ণা মিটলেই তো আর খিদে মেটে না। আবার খোঁজ। অনেক খুঁজে একটি লুচির দোকান মিলল। আমি আর বিশ্বজিৎদা লুচি ঘুগনি  খেলাম। কিন্ত শোভনা খেলো না। ওর পছন্দ মতো খাবার অনেক খুঁজেও না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত বাজারের একমাত্র ছোট্ট মিষ্টির দোকান থেকে শোভনার সঙ্গে আমরাও কয়েকটি মিষ্টি এবং জল খেয়ে আমাদের যাত্রার ইতি টানলাম।

বাংলার প্রকৃতি

শোভনাকে ট্রেনে তুলে দিলাম প্রায় ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষার পর। তারপর শুনলাম আমাদের বহরমপুরে যাবার ট্রেন আরও ৩ ঘণ্টা লেট। ঠিক হল বাসে ফিরব। কিন্ত সেখানেও আর এক সমস্যা। প্রায় এক ঘণ্টা বাসের জন্য অপেক্ষা করেও বাস না পেয়ে অবশেষে একটি ব্যাটারি চালিত রিকশা ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ির পথে। দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল। আমাদের তিন চাকার ই-রিকশা তখন প্রাচীন জনপদ পেছনে ফেলে ছুটে চলেছে সামনের দিকে।

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *