দীপক দাস
বাস থেকে নামার আগে চিনির কাছ থেকে ভাও খেয়েছিলাম। বলেছিলুম, দেখ যেখানে যাচ্ছি সেটা কিন্তু তোর পূর্বপুরুষদের জন্মস্থান। নেমেই যেন হ্যা হ্যা করবিনি।
সুযোগ পেলে ভাও খাওয়াটা আমার স্বভাব। নানা ভাবেই খেয়ে থাকি। ধরুন, কোথাও গিয়েছি। সঙ্গে বন্ধু-বন্ধুনী। হঠাৎ নাকে একটা মিষ্টি একটা গন্ধ ভেসে এল। এক বন্ধুনী বলল, ‘কী ফুল বল তো?’ আমি করণ জোহর মার্কা গলাটা যতটা সম্ভব বিগ বি-র মতো করে বললাম, সপ্তপর্ণী। এক বন্ধু গাছটা দেখতে পেয়ে বলল, এ তো ছাতিম। ছদ্ম ব্যারিটোনে আমার উত্তর, ‘ছাতিমের ইস্কুলের নাম সপ্তপর্ণী।’ উফ! বন্ধুকে টেক্কা দিয়ে সে কী আনন্দ। এখানেও সেই চেষ্টা।
কিন্তু কোথায় কী? ভেবেছিলুম, পূর্বপুরুষের ভিটেয় এসে চিনির আবেগে থরথর অবস্থা হবে। যেমন সিনেমায় হয় আরকী। হাঁটু গেড়ে বসে ভূমি চুম্বন করবে। চোখ ছলছল। ব্যাকগ্রাউন্ডে বেহালার করুণ স্বর। সেসব কিছুই হল না। চিনি একটা কালো বিড়ালটার পিছনে পড়ে গেল। ক্যামেরা নিয়ে পিছু পিছু হাঁটা আর ক্লিক। পিছনে পড়ারই কথা। এই কালো ক্যাট এডগার অ্যালান পো’র কালো বিড়ালকেও হার মানাবে।
আমাদের এবারের অভিযান নদিয়া। জায়গায় জায়গায় থেমে খাবার চেখে বেড়াচ্ছি চারজনে। শুভ, দীপু, চিনি আর আমি। খাদ্য সফরের ফাঁকে ফাঁকে চলছে ইতিহাস সফর। আজ যেমন এসেছি ঘূর্ণিতে। কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত জায়গা। ছোটবেলা থেকে জানি, কৃষ্ণনগরের তিনটি জিনিস বিখ্যাত, কেশনগরের মশা, সরভাজা-সরপুরিয়া (মিষ্টি হিসেবে একটাই ধরলাম) আর ঘূর্ণির মাটির পুতুল। রাত হয়নি বলে মশক কুলের সাক্ষাৎ পাইনি। মিষ্টিগুলো চাখা হবে। তার আগে একটু শিল্প সফর। কিন্তু সফরের প্রথমেই ধাক্কা। ঘূর্ণি স্টপে নেমেই একটা পুতুলের দোকান দেখতে পেয়েছিলাম। পাশেই পুতুল তৈরির কারখানা। মালিককে অনুরোধ করা হল, ছবি তুলব? মালিক বললেন, ‘তুলতে পারেন। তবে বাইরে থেকে।’ বলে কারখানার দরজাটা টেনে দিয়ে মালিক বাইক চেপে বেরিয়ে গেলেন। শিল্পীর এ কী ব্যবহার! কারও নৈপুণ্য টোকা যায়। আয়ত্ত করা যায় কী! চিনির দিকে তাকালুম। পূর্বপুরুষদের উত্তর প্রজন্মের কী নমুনাই দেখলুম। চিনি বোধহয়, বেরাদরদের এমন ব্যবহারে লজ্জা পেয়ে শিল্প ছেড়ে বিড়াল ধরছিল।
চিনির পূর্বপুরুষদের ভিটে ব্যাপারটা একটু খোলসা করি। আমাদের গ্রামের নাম পাতিহাল। গ্রামের কুম্ভকার সম্প্রদায়ের একসময়ে যথেষ্ট নামডাক ছিল। মাটির হাঁড়িকুড়ি, বাসনপত্রের সঙ্গে সুন্দর সুন্দর পুতুল বানাতেন তাঁরা। প্রতিটি গ্রামে সমাজ জীবন চালাতে গেলে ন’টি সম্প্রদায়ের দরকার হয়। কামার, কুমোর, মালি, তেলি ইত্যাদি। যাঁদের নবশায়ক বা নবশাক বলে। আমাদের গ্রামের জমিদার কোনও এক সময়ে কৃষ্ণনগর থেকে এক বা দু’ঘর কুম্ভকারকে এনে জমি দিয়েছিলেন। চিনি তাঁদেরই বংশধর। কৃষ্ণনগরের সুনাম রক্ষা করেছিলেন পাতিহালের কুম্ভকারেরা। তাঁদের তৈরি জিনিসপত্রের বেশ সুনাম ছিল। শুধু তাই নয়, পাতিহাল নামের সৃষ্টির পিছনেও এঁদের অবদান রয়েছে।
এবার আমরা কী করব? প্রথম চোটই সামলাতে পারছি না। আর কোনও দোকানে ঢোকার ইচ্ছেও নেই। কী করা যায়? ঠিক হল, পুরো কুমোর পাড়াটা ঘুরে দেখা হবে। সেই সিদ্ধান্ত নিয়েই একটা গলির ভিতরে ঢুকে পড়া। আর কালো বিড়ালের সাক্ষাৎ। ততক্ষণে পাড়ার চরিত্র বোঝা হয়ে গিয়েছে। এবং আমাদের কোথায় ভুল হচ্ছে সেটাও আবিষ্কার করা গিয়েছে। আমরা এতদিন যে কুমোর পাড়া দেখে অভ্যস্ত সেই পাড়ার সঙ্গে ঘূর্ণির আকাশ পাতাল তফাৎ। আমরা কী দেখি চিনিদের পাড়ায়? কুমোরের চাক। একটা মাটির ঘরের সামনে ডাঁই করে রাখা হাঁড়ি, কলসি, ঘট, লক্ষ্মীঠাকুর, পেট মোটা গণেশ। হাত ছোট, চোখ টেপা ছোট ছোট পুতুল। কিন্তু ঘূর্ণি সেই ‘কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি বোঝাই করা কলসি হাঁড়ি’র পাড়া নয়। এখানে প্রতিটি শিল্পীর ঝকঝকে দোকান। সেই দোকানের কাচের শোকেসে শোভা পাচ্ছে হস্তশিল্পের নানা নমুনা। দোকানের সামনে নানা মনীষীর বড় বড় মূর্তি। দোকানের সাইনবোর্ড লেখা ইংরেজিতে। অর্থাৎ এ পাড়ায় বিদেশি বা ভিনরাজ্যের শিল্পরসিকদের আগমন ঘটে। সে সবই কিউরিও বা স্যুভেনির শপের চেহারার সঙ্গে মেলে। সুতরাং বাংলায় কথা বলা কাউকে কারখানা দেখতে দিতে না-ও ইচ্ছে করতে পারে শিল্পীর।
আমরা পাড়ায় ঢুঁ মারতে শুরু করলাম। পাড়ায় ঢোকার মুখেই পেল্লাই আকারের বেশ কিছু মূর্তি। একতারা হাতে বাউল, লাঙল কাঁধে চাষি, লন্ঠন আর বর্ষা হাতে ডাকহরকরা, ছেলে কোলে জননী, এক শ্রমজীবী। মানে গোটা বাংলার কিছু প্রতিনিধি স্থানীয় চরিত্র। দেখে ভাল লাগল। এগিয়ে গিয়ে ডান হাতি একটা গলিতে ঢুকে পড়লাম চারজনে। ঝকঝকে মাটির পুতুলের দোকান দু’চারটে। এই গলিতে শিল্পীর বাড়ি আর সাধারণ গৃহস্থের সঙ্গে তফাৎ করা যায় সহজেই। শিল্পীর বাড়ির সামনে অবধারিত ভাবে কিছু নমুনা থাকবেই। একটা বাড়ির সামনে তো রামমোহন রায়, বিবেকানন্দ, সুভাষচন্দ্র বসু, মাদার টেরিজা আর শিবঠাকুরকে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। যুগ-কালের কী অপূর্ব সহাবস্থান। একটা মন্দির দেখলাম। জলেশ্বর দেবের। মানে ইনি শিব। জলেশ্বরের মন্দির মেদিনীপুরে আছে। এখানে! বাংলায় ঈশ্বর যোগ করা শিবের মন্দিরগুলো একটা নির্দিষ্ট ইতিহাসে গাঁথা। যেমন, যোগেশ্বর, হঠেশ্বর, পিপীলিকেশ্বর। ইতিহাসটা জানতে হবে।
কিন্তু একটা দোকানে ঢুকে তো কিছু নমুনা সংগ্রহ করা দরকার। স্মারক হিসেবে। প্রথমের ধাক্কা আর ঝকঝকে ব্যাপার দেখে একটু থমমত লাগছিল। পকেট সায় দেবে না। দীপু বলল, ‘চলই না ঢোকা যাক।’ আশ্বাস পেয়ে ঢোকা গেল এক দোকানে। দুরুদুরু বুকেই। দোকান পুরো কাচে ঢাকা। সাইনবোর্ডে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পীর নাম। কোনও পুতুলের দাম করব না মনে মনে ঠিক করে নিলাম। শুধু দেখব আর কোনও বই যদি সংগ্রহ করা যায় কেনার চেষ্টা করব। দোকানের ভিতর গদি আঁটা চেয়ারে বসে একজন। তাঁকে বইয়ের কথা জিজ্ঞাসা করা গেল। তিনি একটি পেপারব্যাক বের করে দিলেন। প্রচ্ছদে ইংরেজি। উল্টেপাল্টে দেখলুম। বই কোথায়? এ যে স্যুভেনির! কিংবদন্তী শিল্পী সম্পর্কে বিভিন্ন জনের মতামত। বিভিন্ন কাগজে তাঁর সম্পর্কে বেরনো নানা খবর। এবার দামের দিকে লক্ষ করা গেল। ২০০ টাকা লেখা। দোকানদার বললেন, দেড়শো টাকা। মুখ ফসকে বলে ফেললুম, ‘এ যে স্যুভেনির! এত দাম। ঘূর্ণির ইতিহাস নেই?’ উনি জবাব দিলেন, ‘সুধীর চক্রবর্তীর লেখা আছে। ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরিতে মিলবে।’ শুনে…যাগ গে। শিল্পক্ষেত্রে অশৈলী কিছু না ঘটাই ভাল।
দোকান থেকে বেরিয়ে দীপু তো এই মারে কী সেই মারে। খোঁচাতে লাগল আমাকে, ‘কিনেই ফেললে? কিনেই ফেললে পুজোর স্যুভেনিরটা দেড়শো টাকায়?’ সেসবে পাত্তা না দিয়ে বললুম, ‘ঘূর্ণিতে এসে মাটির পুতুল না কিনে ফিরব না। উপায় বল।’ গার্ডবাবু শুভ পরামর্শ দিল, ‘বারোদোলতলার মেলায় চলো।’
(চলবে)