দীপক দাস
শুভর স্মৃতির ওপরে আমরা ভীষণ ভরসা করি। কখনও কোনও সফরে কোনও তথ্যে আটকে গেলে ওর শরণ নিতে হয়। ওর এটা অসাধারণ গুণ। মাঝে মাঝে সেটা আমাদের কাছে বিরক্তির কারণও হয়। যেহেতু রেলের গার্ড তাই ও ট্রেনের গল্প করতে ভীষণ ভালবাসে। আমরা শুনব না বলে ওকে জোর করে থামিয়ে দিয়ে অন্য গল্পে চলে যাই। শুভ কিন্তু অপেক্ষা করে চুপচাপ। আমরা থামলেই ও আবার শুরু করে। যে শব্দে থেমেছিল ঠিক সেখান থেকেই। ধরা যাক, ও ট্রেন নিয়ে মালদায় গিয়েছে। কোনও এক স্টেশনে কিছু একটা দেখেছে। লোকটার ট্রেন ধরা, খাবার খাওয়া ইত্যাদি। তারই বর্ণনা শুরু করেছিল, ‘শোন, একবার পাকুড়ে…’। আমরা হইহই করে উঠলাম, ট্রেনের গল্প শুনব না। অন্য গল্প শুরু করলাম। শুভ চুপ। আমাদের গল্প শেষ হতেই গার্ডবাবু আবার শুরু, ‘শোন, একবার পাকুড়ে…’। আবার হইহই।
কুমোর পাড়ায় ঢোকার আগে একজনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তিনিও ঘূর্ণি দেখতে এসেছিলেন। মাটির পুতুলের শখ। আমাদের পরামর্শ দিলেন বারোদোল মেলায় যেতে। শুভ কথাটা মনে রেখেছিল। ওঁর কথা অনুযায়ী একটা টোটো জোগাড় করা গেল। টোটোচালক খুব মজার মানুষ। আমাদের সঙ্গে খুব জমে গেল। মাটির পুতুল দেখার ঝোঁক, শিল্পীদের ঝাঁ চকচকে স্টুডিও নিয়ে কথা চলছিল। উনি বললেন, ‘এখানে সবার ঘরেই সার্টিফিকেট রয়েছে। মেলায় চলুন, দেখবেন কত শিল্পীর হাতের কাজ।’ কথাটা মজা করে বললেন বটে। কিন্তু ঘটনা অনেকাংশে সত্যি। বিভিন্ন হাতের কাজে, কোনও এলাকার মিষ্টির স্বাদের ক্ষেত্রে সত্যতা যাচাই করা গিয়েছে। দু’একজন নাম করেছেন। কিন্তু অন্যদের কাজের সঙ্গে তুলনা করলে উনিশ-বিশ তফাৎই হবে।
কৃষ্ণনগরের রাস্তায় বেশ লাগছিল টোটো সফর। অনেকটা হঠাৎ করে ইতিহাসের কোনও এক পর্বে হাজির হওয়ার মতো অনুভূতি। মাঝে মাঝেই বিরাট বিরাট বাড়ি। ছোটখাট প্রাসাদই বলা চলে। এখন বিবর্ণ। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় একসময়ে রাজত্ব করতেন এখানে। হঠাৎ দেখি, একটা বিরাট হোর্ডিংয়ে গোপাল ভাঁড় হাসছেন। ইতিহাসের অনুভবটা জোরদার হল। একটা রোমাঞ্চও জাগল। আমরা আলোচনা শুরু করলাম। বাজারে ছোট ছোট প্রকাশকের কবলে পড়ে গোপাল ভাঁড়ের জাত গিয়েছে। তাঁদের ইচ্ছে মতো ভূতুড়ে কলমচিরা গোপালকে ভূত-প্রেত-শাঁখচুন্নির সঙ্গে বুদ্ধির দৌড়ে নামিয়ে খেলো করেছেন। কিন্তু গোপাল তেনালি রামা, মোল্লা নাসিরুদ্দিনের থেকে কম কিছু নন। ভাবতেই অবাক লাগছিল, এই রাস্তা দিয়েই যাতায়াত ছিল বাংলার সেরা বিদূষকটির।
দেখতে দেখতে বারোদোল মেলা এসে গেল। মেলার ঢোকার বাঁদিকে বিশাল একটা দরজা। দরজা বললে অসম্মান করা হয় দরওয়াজা বা তোরণ বললেই যথোচিত সম্মান দেওয়া হয়। রাজরাজড়াদেরই কোনও এক কীর্তি। দীপু ছবি তুলল। ফিরে এসে বলল, এটা একটা স্কুল। প্রাসাদের ভিতরে স্কুল! দারুণ ব্যাপার তো? তবে স্কুলের রাজকীয় ভাবের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। নামটা পর্যন্ত পড়া যাচ্ছে না। শুধু একসময়ের স্থাপত্যের নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এটাই প্রাপ্তি।
স্কুলের উল্টো দিকেও একটা তোরণ। ওদিকটাতেই মেলা। ঢুকতে গিয়েই একটা ধাক্কা লাগল মনে। তোরণের সামনে প্রচুর ভিক্ষাজীবী। রাজদ্বারে বসে রয়েছেন নানা বয়সী অনুগ্রহপ্রার্থীরা। কেউ গান করছেন, কেউ হাত পাতছেন। মনটা খারাপ হয়ে গেল। ঢুকে গেলাম মেলা প্রাঙ্গণে। তার পর শুরু হল পুতুল খোঁজা।
খোঁজ চলুক। ততক্ষণে বারোদোল মেলার ইতিহাসটা একটু বলে নিই। কী ভাবে শুরু তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। একটি জনশ্রুতির সঙ্গে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের যোগ রয়েছে। রাজা নাকি তাঁর দ্বিতীয় রানির মান ভাঙাতে রাজপ্রাসাজ চত্বরে এই মেলা বসিয়েছিলেন। রানি উলার জাতের মেলা দেখতে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাজা সময়াভাবে নিয়ে যেতে পারেননি। ফলে রানির গোসা। মান করেছে সুন্দরী। মান ভাঙাতে তাই মেলা। এটা সত্যি হলে আরেকটি তত্ত্বও সত্যিই। রাজা থেকে চাষি…সবাই ডরেন। আবার কেউ কেউ বলেন, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র নন। বারোদোল মেলার প্রবর্তক অন্য কেউ। মেলাটি যে শ’তিনেক বছরের পুরনো তা সকলেই মানেন। কৃষ্ণের বারোটি বিগ্রহ নিয়ে মেলা, তাই এর নাম বারোদোল মেলা।
ইতিহাস চর্চার ফাঁকে মেলার এক প্রান্ত আরেক প্রান্ত পর্যন্ত চষে ফেলা হয়ে গিয়েছে। খাবারের স্টল পেয়েছি। আবসাবপত্র, ইমিটেশনের গয়নার পেয়েছি। ফেমাস সার্কাসের ছেঁড়া তাঁবু পেয়েছি। কিন্তু পুতুলের দোকান পাইনি। সবাই বলে, এই তো ওই দোকানগুলোর পিছনেই। পিছু নিতে নিতে চারজন ক্লান্ত। এপ্রিলের প্রচণ্ড গরম। তার ওপর আগের দিন এই এলাকায় ঝড় বৃষ্টি হয়েছে। সেই ঝড়েই সার্কাসের তাঁবু ছিঁড়েছে। দোকানগুলোও লন্ডভন্ড। মেলায় একটু ছন্নছাড়া ভাব। পসারিরা গোছগাছে ব্যস্ত। আজও আকাশটা গুমোট হয়ে রয়েছে। ফলে তাঁরা ভীষণই চিন্তায়। বেশ কিছু পসারের ঝাঁপ ফেলা।
বেশ কয়েকবার চক্কর দেওয়ার পরে মনে হল, পুতুল পসারি আজ দোকানের ঝাঁপ খোলেননি। কৃষ্ণনগর এসেছি। মাটির পুতুল নিয়ে ফিরব না! আবার কোনও দিন আসা হবে কিনা জানি না। মনটা খুঁত খুঁত করছিল। শেষ দিয়ে বেরিয়ে যাব বলে সিদ্ধান্ত হল। আর সেই চক্করেই মিলল দু’টো দোকান। পর পর। কেনাকাটা করলাম। গার্ডবাবু নিল মণিপুরী ঘোড়া। ২০০ টাকা জোড়া। দীপু নিয়েছিল পেন স্ট্যান্ড, নাড়ুগোপাল। আমি নিলাম চাষি পরিবার। চাষি আর চাষির বউ। অপূর্ব হাতের কাজ। টোটোচালকের কথাই ঠিক। হাতের কাজ সকলেরই ভাল। কেউ তা কাচের শোকেসে সাজানোর সুযোগ পান। কেউ ত্রিপলের দোকানে। তবে আক্ষেপ করছিলেন দোকানি। এখন আর তেমন কদর নেই। ফলে কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুলের যে বৈশিষ্ট্য মানব চেহারা ফুটিয়ে তোলা, তা দিয়ে পেট ভরানো যাচ্ছে না। অন্য কাজও করতে হচ্ছে। শিল্পীরা একই হাতে তৈরি করছেন নাড়ুগোপাল, নগর সংকীর্তনে বেরনো বাউলের দল, গোপাল ভাঁড়, আবার মিকি মাউস, মিনি মাউস। রপ্ত করতে হচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শিল্প। গার্ডবাবু যে ঘোড়াটা কিনল সেটা মণিপুরী রীতিতে তৈরি। শুনে আশ্চর্য হলাম।
দেশীয় শিল্পের সর্বনাশ কী ভাবে রোখা যাবে কে জানে!
ছবি- দীপু ছবি তুলেছে। তাই কোনও ছবিতেই ও নেই।
(সমাপ্ত)