অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

ক্ষীরাই নদীর কূলে

দীপক দাস

মানব সভ্যতা নদীমাতৃক হতে পারে। কিন্তু তাতে রেল কোম্পানির কিছু আসে যায় না। নদীর নামে স্টেশন নেই তেমন! অথচ নদী নিয়ে আমাদের আবেগখানা দেখুন। আমাদের মানে বাঙালিদের। কতগুলি শুধু উপন্যাস আছে নদীকে কেন্দ্র করে। ‘ইছামতী’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘গঙ্গা’, ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। কত নাম বলব। নদী নিয়ে কবিতাই বা কম কী! ছোটবেলা থেকেই তো সঙ্গী হয়ে যায় পঙক্তিগুলো। ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে/বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে’।

কেন হঠাৎ এমন জিজ্ঞাসা? পূর্ব মেদিনীপুরের হাউরে একবার মুগের জিলিপি খেতে গিয়েছিলাম চারজন মিলে। আমি, শুভ, দীপু আর চিনি। তখনই দেখা ক্ষীরাই নামের স্টেশনের সঙ্গে। হাওড়া থেকে যেতে পাঁশকুড়ার পরে। ক্ষীরাই আসলে একটা নদী। সেই নদীর নামে স্টেশন! খুব রোমান্টিক লেগেছিল আমাদের। ফলে জিলিপির উৎস সন্ধানে পূর্ব থেকে পশ্চিম মেদিনীপুর চষে এসে নেমেছিলাম ক্ষীরাইয়ে। তার পর গ্রুপে বিজ্ঞপ্তি, নদীর নামে স্টেশন থাকলে জানান বন্ধুরা। সেই সব স্টেশন নিয়ে লেখা হবে। কিন্তু কেউ সাড়া দেননি। ফলে ধরেই নিলাম, রেল কোম্পানি নদী নিয়ে তেমন আগ্রহী নয়। আসলে নদী তো রেলের কাছে বাধা। সেতু তৈরি করা, তাকে রক্ষণাবেক্ষণ করা। বেশ চাপের।

ছায়াময় স্টেশন।

এবার সফরের কথা বলি। ফেরার পথে চারজনে নামলাম স্টেশনে। একটা মজা আছে স্টেশনের। তিনটি প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু তিনটি পরপর নয়। একটি প্ল্যাটফর্ম একটু পাশে। উঁচুতে। গাছগাছালিতে ভরা স্টেশন। হাওড়া-খড়্গপুরের এই রুট খুবই ব্যস্ত। ফলে ঘনঘন ট্রেন। লোকাল, এক্সপ্রেস, মেল, মাল। না হলে স্টেশনটিকে নির্জনই বলা চলে। ট্রেনের শব্দেই নির্জনতা ভাঙে। তখন দু’চারটে যাত্রী বসে আছেন স্টেশনে। একটি সাঁওতাল পরিবার প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে বসে। সকলেই মেয়ে। দলে এক কিশোরী রয়েছেন। তাঁর কলকাকলিতে ভরে আছে পরিবারটি। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে কিশোরীর কলতান কানে এল। সম্ভবত শহরে পড়েন তিনি। পূর্বসূরিদের নানা অভিজ্ঞতার কথা শোনাচ্ছেন। গ্রাম-শহরের গল্প।

ক্ষীরাইয়ের হাল।

প্রবীণ-নবীনার গল্পগাছার পাশ কাটিয়ে আমরা পথ খুঁজছিলাম। স্টেশন থেকে নেমে নদীর কাছে যাওয়ার। নদীর কাছে যাব। তার পর ফুলের কাছে পৌঁছব। ফিরতে হল। আমরা প্ল্যাটফর্মে হাওড়ামুখী হাঁটছিলাম। নামার পথ খুঁজে না পেয়ে হলাম খড়্গপুরমুখী। এক রেলকর্মীকে জিজ্ঞসাবাদ করে জানা গেল। তার পর ছোট রেলসেতু পেরিয়ে নামার পথ মিলল। ক্ষীরাই নদী।

এখন খাল। একসময়ে নদী ছিল হয়তো। এখন চলার ক্ষমতা হারিয়েছে। শরবন, কাশবন, কচুরিপানার দল জলের পথ আটকেছে। সুন্দর একটা নাম নিয়ে নদী এখন শুধু কচুরিপানার ফুলের তাজ পরে কোনও মতে বেঁচেবর্তে আছে। কেন নাম ক্ষীরাই? জানি না। কাউকে জিজ্ঞাসা করার উপায়ও নেই।

কচুরিপানার তাজের ক্ষীরাই।

ক্ষীরাই স্টেশনে নামার অন্য একটা কারণও ছিল। পেশাগত কারণে ক্ষীরাইয়ের অন্য একটা পরিচয় জানতাম। এখানে প্রচুর ফুলের চাষ হয়। আর সেই বাগো কে বাহারে আকৃষ্ট হয় কাছেপিঠের যুবক-যুবতীরা। তারা ফুলের জমিতে নেমে সেলফি মত্ত হয়। কমল বনে মত্ত হস্তির বিচরণে যা ক্ষতি হয় ক্ষীরাইয়ের ফুলের জমিরও সেই হাল হয়। সেখানে হস্তি। এখানে যৌবন মদ মত্ত তরুণ-তরুণী। আমরা নদী দেখার পরে সেই ফুলের খেতে যাবার পথ খুঁজছিলাম।

একজনকে পাওয়া গেল। তিনি জানালেন, হাওড়ার দিকে মুখ করে স্টেশনের ডানদিকেই এখনও ফুলের খেত কিছুটা হলেও আছে। ফুল দেখতে হলে শীতকালে আসা জরুরি। সেই সময়েই ফুলের চাষ হয় বেশি। তা হোক। শীতকালে না হয় আবার আসা যাবে। হাটের মজা আলাদা। ভাঙা হাটের মজাও কম নয়। সুতরাং হাঁটা শুরু।

মাঠের দিকে।

দু’পাশে জঙ্গলে ভরা মেঠো পথ। ঝাঁ ঝাঁ করছে রোদ। তার মধ্যেই আমরা মাঠে নেমে পড়লাম। রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা দূরেই ফুলের খেত। রঙিন হয়ে রয়েছে। রাস্তার সামনের জমিগুলো বেশির ভাগই খালি। একটু যেতেই জমি ভরা ফুল। ডাঁটি ডাঁটি গাছ। ডাঁটির মাথায় থোকা ফুল। অনেকটা কাশফুলের মতো। কিন্তু কাশের মতো আলগা আলগ নয়। আঁটসাঁট। আমরা কী কী ফুল করে যেই আগ্রহ দেখাতে শুরু করলাম, দীপু চুপ করে গেল। ও নিশ্চয় তখন মনে মনে গাইছে, ‘আজ তোমার পরীক্ষা, ঘাসপুস’। ও বটানির গবেষক কিনা। তাই অচেনা গাছ, ফুল দেখলেই আমরা জেরা করি ওকে। দীপু ফুলের বংশ বলতে পারল। কিন্তু নাম বলতে পারল না। শুভ হালকা করে বলল, ‘ম্যাডামকে ফোন করে জিজ্ঞাসা কর’। ম্যাডাম মানে দীপুর অধ্যাপিকা।

নাম না জানা বুনো ফুল।

ফুলের ছবি তুলে সহকর্মী দিগন্তকে পাঠিয়ে দিলাম। ও এই এলাকার ছেলে। কিছুক্ষণ পরে দিগন্ত জানাল, এগুলো বুনো ফুল। এমনই হয়। কেউ জমিতে লাগায় না। তবে দিগন্তও ফুলের নাম বলতে পারল না। আমরা হাল ছেড়ে ফুলের জমির কাছে চলে গেলাম। এখন জমি জোড়া শুধু গাঁদা ফুল। নানা রঙের গাঁদা। সেই জমির গায়ে দাঁড়িয়ে ফটোসেশন চলল দীর্ঘক্ষণ। চিনির তো পোজ দেওয়া শেষই হতে চাইছিল না। শুভ আবার সানগ্লাস এনেছে। সেটা ধার নিয়ে কিছু ফটো উঠল। দীপুর মত, এ সবই ফেসবুকের দুর্দান্ত কভার পিকচার হবে। রাস্তায় ফেসবুক খুললে মৌমাছি দল বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়বে মধুর লোভে।

শোভা।

রোদে টেকা যাচ্ছিল না। শরীরে জলের অভাব। একটু আগেই সেটা টের পেয়েছি। ধীরে ধীরে স্টেশনের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। পথে একটুখানি কৃষিতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা। ক্ষীরাইয়ে কেন এত ফুলের চাষ? সে কি মাটির গুণে? নাকি নদীর দানে?

খেত ভরা।

এলাকায় তেমন বিশেষজ্ঞ পাইনি। তাই উত্তর জানা নেই আমাদের।

ছবি- দীপু, চিনি, শুভ।

কী ভাবে যাবেন— হাওড়া থেকে খড়্গপুর বা মেদিনীপুরগামী লোকাল ধরে ক্ষীরাই। ঘণ্টা দুয়েকের সফর। টিকিটের দাম মাথা পিছু কুড়ি টাকা। টিকিট কাটবেন হাউর পর্যন্ত। ক্ষীরাই ঘুরে হাউরের মুগের জিলিপি খেয়ে, বাড়ির জন্য নিয়ে ফিরবেন। মুধরেণ সমাপয়েৎ।

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *