দীপশেখর দাস
তিষ্ঠানো আমার ধাতে নেই। ভাগ্যেও নেই। একেবারে টিনটিন আর ক্যাপ্টেন হ্যাডকের মতো। ‘চন্দ্রালোকে অভিযান’ মনে পড়ে? দু’জনে সবেমাত্র মার্লিন স্পাইকে ফিরেছে। ক্যাপ্টেন নেস্টরকে ব্যাগপত্র খালি করতে বলল। ঠিক তখনই ক্যালকুলাসের টেলিগ্রাম। তাদের যেতে বলছে বিদেশে। ক্যাপ্টেন নেস্টরকে বললেন, তাহলে আর ব্যাগ খালির দরকার নেই। আমারও তাই দশা। কিছুদিন আগে কর্মসূত্রে যেতে হয়েছিল হিমাচল প্রদেশে। ফিরেই খবর পেলাম অরুণাচলের ইটানগরে যেতে হবে। কাজেই। তাই আবার ব্যাগ প্যাক।
প্রত্যেক ভ্রমণকালেই অল্প বিস্তর উত্তেজিত থাকি। এবারের উত্তেজনা একটু বেশিই। কারণ দু’টো। এক, পূর্ব ভারত আমার অদেখা। আর দুই, যাত্রাপথ ভিন্ন। মানে এখনও পর্যন্ত যত সফর করেছি সবই স্থলপথে। এবার যাত্রা আকাশপথে। যদিও অর্ধেক রাস্তা। বাকিটা স্থলপথ ছাড়া উপায় নেই। তাতে কী! একটু হলেও তো আকাশে ওড়া। প্রকৃতিকে সম্পূর্ণ এক অন্য আঙ্গিকে দেখার সুযোগ।
যাই হোক, যাবার দিন এল। বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে বেড়িয়ে পড়লুম। দুটো ব্যাগ সঙ্গে। একটা ছোট পিঠ ব্যাগ। আর একটা ট্রলি ব্যাগ। প্রথম বিমান সফর তো। তাই বেড়িয়ে পড়ার দু’দিন আগে থেকেই বিস্তর গবেষণা চালিয়েছি। অফিসের দুই সিনিয়রের (যাঁরা বিমান যাত্রায় বেশ অভ্যস্ত) থেকে যথারীতি পাঠ নিয়েছি। সেই সব অর্জিত বিদ্যা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। ছুরি, কাঁচি, নেলকাটার ইচ্ছা করেই নিতে ভুলে গিয়েছি। আমার দাড়ি কাটার যন্ত্রপাতি একটু পুরানো আমলের। ব্লেড লাগিয়ে কাটতে হয়। তাই, ওটাও নিতে ভুলেছি। ভারী জিনিসপত্রগুলো সব ট্রলি ব্যাগে চালান করেছি। ছোটবেলায় ট্রেনে চড়ার আগে বালক রবির যে আতঙ্ক হয়েছিল আমারও সেরকম হল। তা-ও রবি বাবার সঙ্গে ট্রেনে চড়েছিল। আমি যাব একা।
দুপুর ১২টায় উড়ান। শুনেছিলুম ফ্লাইট নাকি ঠিক ট্রেনের মতো নয়। প্লেনের ডাক একবার শেষ হয়ে গেলে আর তাতে চড়া যাবে না। সিনেমার মতও ট্রেন প্লাটফর্ম ছাড়ার শেষ মুহূর্তে কেউ হাত ধরে তুলবে না। আবার প্রেমিকার কথা বলে ‘মেরে তুমসে হ্যায় পেহলে নাতা কই’ গাইলেও প্রবেশ করতে দেবে না। তাই বেশ ভয়েই ছিলুম। আমার তো ছুটেই ট্রেন ধরা অভ্যাস। এই ভয়েই কেমন করে কী জানি বিমান ছাড়ার প্রায় আড়াই ঘণ্টা আগেই পৌঁছে গেলুম নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে।
এরপর সিনিয়রদের কথা মতো পরিচয়পত্র দেখিয়ে ভিতরে প্রবেশ। লাগেজ স্ক্যানিং করে বোর্ডিং পাস নেওয়া এবং হতাশ হওয়া। সিনিয়ররা খুব সুন্দর ভাবে বিমানের আসন বিন্যাস বুঝিয়ে ছিলেন। দেখলুম আমার সংখ্যা ৩১বি। অর্থ্যাৎ মাঝের আসন আমার। আর অভিজ্ঞদের মতে বিমানে চড়ার মজা একমাত্র জানালার পাশে বসেই। মনে একটু দুঃখ নিয়েই সব নিরাপত্তা বেষ্টনী অতিক্রম করলুম। বোর্ডিং পাস দেওয়ার সময়ই বলেছিল ২৩ই দরজার কাছে গিয়ে অপেক্ষা করতে। বিমান ছাড়তে তখনও প্রায় একঘণ্টা। আমি গেটের দিকে এগোলুম।
চক্ষুলজ্জা আমার চিরকালই কম। কে কী ভাববে তা ভাবার ভাবনা আমি কোনওদিনই করিনি। তাই গেটের চত্বরে পৌঁছেই মোবাইল হাতে গিয়েই দাঁড়ালুম স্বচ্ছ কাঁচ লাগানো দরজার সামনে। সামনের উন্মুক্ত প্রান্তরে বাস, লাগেজ ভ্যানের ইতিউতি আনাগোনা। আর সামনে দাঁড়িয়ে বেশ কতগুলো অতিকায় বিমান। মাঝে মাঝে দূরে রানওয়ে দিয়ে আকাশে ঝাঁপাচ্ছে এক একটা। আবার কোনওখানে ভূমি স্পর্শ। বিমানের ওঠা নামা আমার টিভির পর্দাতেই দেখা। এখানেই প্রথম চাক্ষুষ করা।
একসময় বন্দরের ২৩ই দরজা খুলে গেল। দরজার ওপারে দু’টো বাস এসে দাঁড়াল। দুই সুন্দরী আমাদের ডাক দিলেন। এ ডাক শুনতে কান চিরকালই উদগ্রীব। সুতরাং সোজা হাঁটা। আমার জন্য দ্বিতীয় বাসটা। বাস আমাদের নিয়ে গেল বিমানের পেটের নীচে।
আমার বাঁপাশের সিটে এক বাঙালি ভদ্রলোক। আর ডাঁয়ে এক স্মার্ট ছোকরা। ভদ্রলোক বোধহয় প্রথম বাসটায় এসেছেন। সিটে বসেই বেল্ট বেঁধে নিয়েছেন। বুঝলুম ‘ফ্রিকোয়েন্ট ফ্লায়ার’। আমার বেল্ট বাঁধার পদ্ধতি জানা ছিল না। সিনেমা দেখে যা বুঝেছিলুম ওটা বেশ শক্ত কাজ। এমন সময় সেই ছোকরা এলেন। সিট দেখলেন। বসলেন। বেল্ট বাঁধলেন। নিমেষেই। সেই সুযোগে বেল্ট বাঁধার নিয়মটা ভালো করেই দেখা হয়ে গেল। বেঁধেও ফেললুম। বুঝলুম এর মত সহজ কাজ কিছু নেই। সিনেমায় কী অভিনয় যে করতে হয়!
রানওয়েতে গড়াতে শুরু করল বিমান। পকেট থেকে মোবাইল বেরিয়ে এল। বিমান তখন মাটি ছেড়ে উপরে উঠছে। মোবাইল ক্যামেরা অন। অবশ্যই ফ্লাইট মোডে। আকাশ থেকে কলকাতা শহরটা সম্পূর্ণ আলাদা রূপ ধারণ করল। এক বিরাট সভ্যতার বুক চিরে চলে যাওয়া হুগলি নদীটা আর হাওড়া-কলকাতাকে মিলিয়ে দেওয়া হাওড়া ব্রিজটা এক অপূর্ব মোহ সৃষ্টি করল। সভ্যতা মানলাম। কিন্তু আকাশ থেকে নদীর দু’পারের যে রূপ দেখলাম তাতে মনটা দমে গেল। কংক্রিটের জঙ্গল কথাটা পড়া ছিল। এই প্রথম নিশ্চিত হলাম। আমরা জঙ্গলেই থাকি। কংক্রিটের জঙ্গলেই।
বিমানের ক্ষুদ্র বাতায়নের ফাঁক দিয়ে এক টুকরো আকাশ দেখা যাচ্ছিল। সে আশমানি জমিনে মেঘের কাশফুল ফুটেছে। মেঘের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে আমার মেঘবালিকাকে খোঁজার চেষ্টা চলল। খুঁজেছিলাম মেঘের মধ্যে লুকিয়ে থাকা জলধারাকেও। বৃষ্টিরা লুকিয়ে থাকে কোথায়!
সফর ছিল খুবই ছোট। মাত্র এক ঘণ্টার। কলকাতা থেকে গুয়াহাটি। এই এক ঘণ্টায় শুধুই পৃথিবীর রূপ দেখেছি মুগ্ধ হয়ে। ফটোও তুলেছি কয়েকটা। যদিও তা যাত্রার শুরু শুরুতেই। জানলার পাশে বসা যাত্রী আমার প্রকৃতি প্রেমে বেশ ক্ষুণ্ণ বুঝে ফটো তোলায় ক্ষান্ত দিয়েছি। কিন্তু উঁকিয়েছি সব পথটাই। কত নাম না জানা গ্রাম, শহর, বিল, নদী পেরিয়েছি এক পলকেই। এক জায়গায় দেখি এক নদী বিস্তৃত হয়েছে এক বৃহৎ অরণ্য অঞ্চল জুড়ে। মাঝে তৈরি করেছে বেশ কয়েকটা ছোট ছোট ব-দ্বীপ। সবটাই সবুজ। পলক না ফেলে দেখবার মতো ল্যান্ডস্কেপ। মন ভরিয়ে নেওয়ার মতো প্রকৃতি। এক কথায় আহা!
কিন্তু, ভাল কিছুর স্থায়িত্ব কয়েক মুহূর্তেরই হয়। সবুজ গালিচা টপকাতেই আবার কংক্রিটের জঙ্গল। আর আমাদের ঝুপ করে মাটিতে নেমে আসা। আকাশ দুনিয়া থেকে মাটির পৃথিবীতে আবশ্যিক পতন।
(সমাপ্ত)