Uncategorized ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

ফরাসি গঙ্গার পার আর ওলন্দাজ গোরস্থানে বিপদ

দীপশেখর দাস

আমাদের যথা ইচ্ছা তথা যা দলের পথচলা শুরু মঙ্গলযাত্রা দিয়ে। দলের অধিনায়ক দীপকদার সাপ্তাহিক ছুটি মঙ্গলবারে। সহ-অধিনায়ক (সময় বিশেষে অধিনায়ক) ইন্দ্রদাও ব্যবসা বন্ধ রাখে ওই দিন। বাকি আমি, বাবলা, সৌগতরা তখন অকেজো। কাজেই আমাদের অফুরন্ত সময়। তাই আমাদের যাত্রা হত ওই মঙ্গলেই। ক্রমেই আমি, বাবলা, সৌগত বড় হলুম। মঙ্গলবারে ব্যস্ত হয়ে পড়লুম। ক্যাপ্টেন বুড়ো হলেন। প্রায় মঙ্গলেই ভাইরালে আক্রান্ত হতে থাকলেন। ভাইস ক্যাপ্টেনের কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি হল। এখন মঙ্গলেও ডিউটি তাঁর। ব্যবসার সঙ্গে পরি-বারও সামলাতে হয়। প্রায় মঙ্গলেই তার দর্শন নাস্তি।

অনেকদিন পর আবার আমাদের মঙ্গলযোগ হয়েছিল। আমার মহরমের ছুটি। গার্ডবাবু সৌগত বলল সেও ছুটি পাবে। ক্যাপ্টেনও সুস্থ। বাধ সাধল ভাইস ক্যাপ্টেন আর ছোটা ডন বাবলা। বাবলার কাজ চালু। সামনেই রান্নাপুজো। মাছ শিকারের দিন। তাই এখন সে কাজ কামাই করতে পারবে না। ইন্দ্রদা কেনাকাটায় যাবে পরি-বার সহ। তবুও আমরা নাছোড়। ঠিক করলাম তিনজনেই যাব।

ঠাকুরবাড়ি। ফটকগোড়ার কাছে।

বেড়িয়ে পড়লাম ইতিহাস ছুঁতে। বড়গাছিয়া থেকে বাসে সলপ। সলপ থেকে বালি। বালি থেকে ব্যান্ডেল লোকালে চড়লুম। গন্তব্য ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগর। আমার বন্ধু দেবপ্রিয়ার বাড়ি চুঁচুড়ায়। ট্রেন তখন বৈদ্যবাটি স্টেশনে থামছে। ওকে ফোনে ধরলুম একটু রাস্তাঘাটের সুলুকসন্ধান জানব বলে। জানতে পারলাম বন্ধু আমার ভদ্রেশ্বর স্টেশনে ট্রেনের প্রতীক্ষায়। আর কী! সোজা নির্দেশ, চন্দননগর স্টেশনে নেমে দাঁড়া। আমরা আসছি।

চন্দননগরে আমাদের শুরু হল গলিপথ যাত্রা। বন্ধুকে ধরে নিয়ে এসেছি। সেই আমাদের অলিগলি পথ চিনিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। গন্তব্য ফটকগোড়া। স্টেশন থেকে এক দেড় কিলোমিটার পথ হেঁটেও কোনও ফরাসি নিদর্শন চোখে পড়েনি। পড়েছে পুরোনো আমলের মহলের ধাঁচে তৈরি করা ঝাঁচকচকে প্যান্টালুন্সের শোরুম। আর তার পাশে মুখ লুকিয়ে থাকা এক ঠাকুরবাড়ি। এই ঠাকুরবাড়ির ইতিহাস আমাদের কর্ণগোচর করার মতো কোনও সহৃদয়কে পাইনি যদিও। আমাদের ক্যাপ্টেন কোনও একসময় এ রাস্তায় পথ হেঁটেছিলেন। কাজের সন্ধানে। কিন্তু তিনিও কোনও কিনারা খুঁজে পাড়ছিলেন না। তাঁর স্বগতোক্তি, সব কেমন পাল্টে গেছে।

আকাশবাণীর সেই গীতিকারের বাড়ি।

আমরা পথে বেরোলে পায়ের সঙ্গে পেট-মুখও কাজ করে। পায়ের না সইলেও পেটে বেশ ভালোই সয়। এবারে আবার সঙ্গে বিশেষ অতিথি। রাস্তার আশে ঝকঝকে মিষ্টির দোকান। মিষ্টি মুখ আবশ্যক। পেটে দিয়েই আবার চলা। যদিও এবার আর পদব্রজে নয়। টোটোয়। সোজা ছবিঘর মোড়ে। শ্রী দুর্গা ছবিঘরের সামনে দিয়ে সোজা চলে যাওয়া রাস্তা ধরে এগোতে থাকলুম। সেখানেই প্রথম পেলুম এক টুকরো ইতিহাসকে। ভগ্নদশার শ্রী সত্যবরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দয়ালমঞ্জিলকে। ভদ্রলোক একসময়ের আকাশবাণীর গীতিকার ছিলেন। হয়তো সে সময় দয়ালমঞ্জিলের লাবণ্য অন্যরকম ছিল। বর্তমানে স্থানে স্থানে আবর্জনা ডাঁই করা। মহলের ইতিউতি বট-অশ্বত্থের শাখামূলবিন্যাস।

পবিত্র হৃদয় গির্জা।

সে পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতেই পৌঁছে গেলাম পবিত্র হৃদয় গির্জার (সেক্রেড হার্ট চার্চ) সামনে। ১৬৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত ফরাসি স্থাপত্যের নিদর্শন। চার্চের সামনেই শহিদ বিপ্লবী মাখনলাল জীবন ঘোষালের মূর্তি। চট্টগ্রাম বিদ্রোহের অন্যতম নেতা মাখনলাল। ইংরেজদের সঙ্গে সম্মুখ সমরে আত্মবলিদান দেন।

বিপ্লবী মাখনলালের মূর্তি।

আরেকটু সামনে এগোলেই চন্দননগর স্ট্র্যান্ড। স্বর্গীয় দুর্গাচরণ রক্ষিত মহাশয়ের স্মৃতিরক্ষার্থে নিমির্ত ঘাটে। বর্তমানে যা চন্দননগরের ভিউ পয়েন্ট। দুর্গাচরণ কে ছিলেন জানি না। প্রথমে তো বুঝতেই পারিনি এই ঘাট দুর্গাচরণের স্মৃতিতে নির্মিত। রক্ষিত নামটা ফরাসি উচ্চারণে কিন্তু রোমান হরফে লেখা। পড়ে কার সাধ্য। কোথায় যে ফট করে চন্দ্রবিন্দু বসে যাবে কে জানে! আমাদের গার্ডবাবু অনেকক্ষণ নজর রেখেছিল লেখাটায়। কিন্তু পাছে ইংরেজি পড়তে পারছে না বলে আমরা গালি দিই, সেই সংকোচে কিছু বলেনি। পরে বাংলায় লেখা নামধাম দেখে বুঝতে পারে ইনি বাঙালি। তখন গার্ডবাবুর সে কী আনন্দ। আবিষ্কারের আনন্দ। আমরাও বুঝলুম, মঁসিয়ে দুর্গাচরণের ফরাসি এই উপনিবেশে কেউকেটা একজন ছিলেন। তাই তাঁর স্মৃতিরক্ষায় এমন তোড়জোড়। তা-ও ফরাসিতে। স্ট্রান্ডের ভিউ পয়েন্টে তো ফটোসেশন আবশ্যিক। চারজনে ছবিটবি তোলা হল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকা হল গঙ্গার দিকে। দেবপ্রিয়া বলল, গঙ্গার ওপারটা কাঁকিনাড়া। সে আর বলতে। কাউকে আর নাড়াতে হয় না। ওই জায়গা এখন নিয়মিত নড়ে। দেবপ্রিয়া বলে ওঠে, ‘‘আর আমাদের ট্রেন বন্ধ হয়ে যায়। ইউনিভার্সিটি যেতে পারি না।’’

স্ট্র্যান্ডের দিকে।

সেদিন মাঝে মাঝেই বৃষ্টি পড়ছিল। আবহাওয়া বেশ ভাল। আমরা ঘাটে অনেকক্ষণ কাটিয়ে বাম দিক ধরে এগোলাম। ঘাট থেকে বেরিয়ে গঙ্গার পাড় ধরে বামদিকে এগোলেই ইন্সটিটিউট দে চন্দননগর। ফরাসি উপনিবেশের আর এক নিদর্শন। বর্তমানে এটি একাধারে ফরাসি ভাষা শিক্ষণ প্রতিষ্ঠান, সংগ্রহশালা এবং গ্রন্থাগার। ভাগ্যিস সেদিন বন্ধ ছিল। না হলে আবার সেই চন্দ্রবিন্দুর ধাক্কায় পড়তে হত। বইপত্র, নির্দেশিকা সব বোধহয় ফরাসিতে লেখা এখানে। ফরাসি সুগন্ধ, শিল্প আর মাদাম-মাদমোয়াজেল ছাড়া আর কিছুকে অত পাত্তা দেওয়ার দরকার আছে কি? শিল্পবোধের কথা যখন উঠল, তখন বলি, এই গঙ্গার পারটা ফরাসি শাসকেরা বেশ সুন্দর করে সাজিয়েছে। বিভিন্ন সৌধের পাশে সাজানো রাস্তা তার পর গঙ্গা, হাঁটতে বেশ লাগছিল।

অসাধারণ বুলেভার্ড।

চন্দননগর স্ট্র্যান্ড শেষ করে আবার টোটো সফর। উদ্দেশ্য যুগান্তর দলের বিপ্লবী সদস্য কানাইলাল দত্তের জন্মভিটা। যদিও বিপ্লবীর আস্তানার খোঁজ সহজে মেলেনি। থানা-পুলিশ পর্যন্ত করতে হয়েছে। লোকাল গাইড দেবপ্রিয়া ডাহা ফেল। স্থানীয় কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। তাঁরাও অথৈ জলে। শেষে দীপকদা থানা থেকে বিপ্লবীর খোঁজ নিয়ে এল। বিপ্লবীর বাড়ি চুঁচুড়া যেতে পড়বে। চন্দননগর থানা স্ট্র্যান্ডের কাছেই। থানার বাড়িটাও একটা দেখার মতো স্থাপত্য।

কানাইলালের বাড়ি রাস্তার পাশেই। লালা রঙা। বাড়ির এক অংশে এক কুঠুরি। তার সামনে লোহার গরাদ। ভিতরে বিপ্লবীর প্রস্তর মূর্তি। সবটাই বেশ পরিচ্ছন্ন। বিপ্লবীর প্রতি এলাকাবাসীর শ্রদ্ধা হয়ত এখনও অমলিন। বিপ্লবীর স্মৃতিচিহ্ন ছুঁয়ে আরও এগিয়ে চললুম। আবারও টোটোতে। বাধ্য হয়েই। মহরমের শোকযাত্রার কারণে বড় রাস্তা বন্ধ। তাই টোটোই ভরসা। ফরাসি উপনিবেশ ছাড়িয়ে এসে পড়লুম ওলন্দাজদের আস্তানায়। চুঁচুড়ার বিখ্যাত ডাচ গোরস্থানে। ঢুকতে গিয়েই গন্ডগোল হয়ে যাচ্ছিল। আমরা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে। দেবপ্রিয়া চট করে একবার বাড়িতে গিয়েছে। কাছেই বাড়ি। তখনই দেখি, একটা ছেলে সমাধিস্থল থেকে বাঁশ হাতে বেরিয়ে এল। তার পর লোহার ঘুরন্ত গেটটাকে বাঁশ দিয়ে আড়াআড়ি আটকানোর চেষ্টা করতে শুরু করল। বন্ধ নাকি? দীপকদা জিজ্ঞাসা করল ছেলেটাকে, ঢোকা যাবে? ছেলেটা বলল, ‘মুঝে মালুম নেহি, অন্দর আনা হ্যায় কি নেহি। ইয়ে ভি নেহি মালুম, ইয়ে বন্ধ হ্যায় কি নেহি।’ শুনেই বুঝতে পারলুম, মিসড কল করে ফেলেছে দীপকদা। ছেলেটার হেড অফিসে গন্ডগোল আছে। হাতের বাঁশটা দিয়ে এতক্ষণ গেটটা বন্ধ করার চেষ্টা করছিল।

বিপ্লবী কানাইলালের বাড়ির সামনে।

সমাধিস্থলটা বেশ পুরনো। সম্ভবত ১৭৪৩ সালে স্যর কর্নওয়ালিস জঙ্গের সমাধি থেকেই। পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগ এটিকে হেরিটেজ ঘোষণা করে রক্ষণাবেক্ষণ করেছে। এর দু’টি ভাগ। একভাগে ইংরেজ ও অন্যান্য স্থানীয় খ্রিস্টানদের সমাধিস্থল। যেখানে আজও সমাধি দেওয়া হয়। অন্যভাগে ওলন্দাজদের সমাধি। সমাধিগুলোর আশপাশ সুন্দর করে সাজানো। বাঁধাই করা রাস্তা। ছাঁটাই করা গাছ। মাঝে মাঝে রংবাহারি ফুল। সবুজ গালিচা চিরে ইতিহাসের নমুনা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ডাচ সাহেবদের স্মৃতিস্তম্ভ। দীপকদা বলছিল, সেই কোথাকার কোন দেশ থেকে ব্যবসা বাণিজ্য করতে এসেছিলেন লোকগুলো। তার পর মিশেই গেল অচেনা এক দেশের মাটিতে। পিতৃ-মাতৃভূমি আর ছোঁয়া হল না তাঁদের। আমরা কর্নওয়ালিস জঙ্গের সমাধি খোঁজার চেষ্টা করছিলুম। সফল হয়নি। হয়তো দেখেছি। কিন্তু এখানে তো আবার ওলন্দাজ ভাষায় রোমার হরফে ওবেলিস্ক লেখা। আমাদের কাছে যা ফরাসি তাই ওলন্দাজ। ও হ্যাঁ, সমাধিস্থলের ঢোকার মুখে বাংলায় লেখা একটা বোর্ড আছে। তার বাংলাটা সাংঘাতিক। ওই পাগলটার মতোই। পাগল না হলে কেউ এমন বাংলা লিখতে পারে না। অথবা এই সমাধিস্থলে যাঁরা চিরঘুমে তাঁদের সময়ের বাংলা। গার্ডবাবু বলল, গুগল ট্রান্সলেটরে ফেলে ইংরেজি থেকে বাংলা করেছে। তাই এমন ওলন্দাজি বাংলা।

ওলন্দাজ সমাধিস্থল।

সমাধিস্থলের একটা জিনিস ভাল লাগছিল। অনেক ছেলেছোকরার ভিড়। এক সমাধিস্থলের উপরে দুই যুগলে প্রেম করছে। হাত ধরাধরি করে বসে রয়েছে। সমাধিতে যিনি শুয়ে তাঁর নিশ্চয় ভাল লাগছিল। নতুন জীবনের এই প্রস্তাবনা অংশটি দেখে। সমাধিস্থলে দু’টো বিশাল বিশাল মরা গাছ। আর হাতে ক্যাঁচম্যাচ করছে কত টিয়াপাখি। মরা গাছকে আশ্রয় করে বেড়ে উঠেছে কিছু অন্য গাছও। এখানে তো দেখছি, মৃতদের শরীরে প্রাণের উষ্ণতা নিত্য জাগে। বেশ ভাল লাগল।

কত অতিথি শায়িত এই স্থানে।

গোরস্থানেই সূর্য মুখ লুকালো। আমাদের কাছে সময় বড়ই কম। আবার টোটোয় চড়লুম। ঘড়ি মোড় হয়ে চলে এলুম মহসিন কলেজের সামনে। দেবপ্রিয়ার কলেজ। তিনি তখন বাড়ি থেকে জামাকাপড় পাল্টে সতেজ হয়ে এসেছেন। কলেজ দেখে একটু স্মৃতি বিজাড়িত হয়ে পড়েছিল বোধহয়। তার কয়েকখান ছবি তোলার আবদার মেটাতে হল। কলেজ হয়ে গেলাম চুঁচুড়া ঘাটে। বঙ্কিমের একসময়ের আবাস। ঘাটের পাশে এই ঘরে বসেই তিনি লিখেছিলেন বন্দেমাতরম গান। অবশ্য সে ঘরে এক আরামকেদারা ছাড়া তাঁর চিহ্ন আর কিছুই নেই।

বঙ্কিমচন্দ্রের আরাম কেদারা।

সন্ধ্যা ক্রমশ ঘন হচ্ছিল। স্থানীয়াকে বাড়ি রওনা করিয়ে আমরা চুঁচুড়া স্টেশনে পৌঁছুলুম। আমাদেরও বাড়ি ফিরতে হবে। তবে ফেরার আগে একটা বড় কাজ বাকি রয়ে গেছে। মাঝ রাস্তায় একবার ঝাঁপ দিতেই হবে।

চন্দননগর মানে কি শুধু ফরাসি ইতিহাস নাকি! মিষ্টি-ইতিহাসও তো আছে!

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *