দীপক দাস
ঘাঁটি গেড়েছিলাম ওমরাহ গঞ্জে। আমি আর ইন্দ্র। জায়গার নাম শুনেই মালুম অভিজাত এবং ক্ষমতাবানদের এলাকা। নবাবি আমলের আমির ওমরাহ থাকতেন এখানে। দিল্লির কনট প্লেসের মতো।
ভাবছেন নিশ্চয় নবাবি খানা খেতে ঘাঁটি গেড়েছি আমরা? ভাবনার জন্য দোষ দেওয়া যায় না। সঙ্গে যখন ইন্দ্র আছে তখন এমন ভাবনাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা নবাবি খানার খোঁজে ওমরাহ গঞ্জে আসিনি। এসেছি মিষ্টির খোঁজে। ছানাবড়া। মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত মিষ্টিকুল গৌরব। অনেকদিনের ইচ্ছে ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে ভাণ্ডার লুটব। ভাণ্ডারই তো। মিষ্টির দোকানের নামের সঙ্গে ভাণ্ডার যুক্ত থাকে না!
আগে আমরা কোনও জায়গায় ঘুরতে গেলে শুধু নামটা শুনেই পাড়ি জমাতাম। খুঁজে পেতে দেখব, জানব। তাতে আবিষ্কারের মজা। কিন্তু সম্প্রতি ভ্রমণ বিষয়ে মুজতবা আলীর একটা মতামত জানতে পেরেছি। তিনি বলেছেন, কোথাও ঘুরতে গেলে জায়গাটা নিয়ে কিছু পড়াশোনা করে নেওয়া দরকার। না হলে অনেক কিছু হারাতে হতে পারে। গুরুজনদের বাক্য অমান্য করতে নেই। পড়াশোনা করলাম। আর তাতেই লালবাগে আস্তানা। ওমরাহ গঞ্জ লালবাগের একটি পাড়ার নাম।
ইন্টারনেট এবং পরে পড়া প্রণব রায়ের ‘বাংলার খাবার’ বইয়ে ছানাবড়া সম্পর্কে কিছু তথ্য আছে। এই দুই সূত্রের দাবি, লালবাগে ছানাবড়ার উৎপত্তি। এখানকার এক মোদক নিমাই মণ্ডল ছানাবড়া প্রথম তৈরি করেন। তিনি মুর্শিদাবাদের নবাবের প্রাসাদেও ছানাবড়া সরবরাহ করতেন। তথ্য পেলে যাচাই করতে হয়। তখন রাত আটটা। লালবাগ বাজারে শুরু হল পুরনো মিষ্টির দোকানের খোঁজ। লোকজন নিমাই মণ্ডলকে চিনতে পারছিলেন না। তাঁরা কাছাকাছি দু’টো মিষ্টির দোকানের নাম করছিলেন। বাজারের এক জায়গায় দেখলাম, কয়েকজন বয়স্ক আড্ডা মারছিলেন। দু’জনে হাজির তাঁদের কাছে। কিন্তু প্রবীণরা প্রাণে বড়ই ব্যথা দিলেন। বললেন, লালবাগের পুরনো মিষ্টির দোকানগুলো সবই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। নিমাই মণ্ডলের দোকান এই চত্বরে ছিল কিনা বলতে পারলেন না। একজন আঙুল তুলে রাস্তার ওপারে দিকনির্দেশ করে জানালেন, ওইখানেই ছিল লালবাগের সবচেয়ে পুরনো মিষ্টির দোকান।
আমি আর ইন্দ্র ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। যে দিকে আঙুল দেখিয়েছেন, সেটা একটা জুতোর দোকান। প্রবীণ হেসে বললেন, ‘‘মিষ্টির দোকান বন্ধ করে জুতোর দোকান করেছে মালিক।’’ বাঙালির ঐতিহ্যের কী হাল রে বাবা! ছানাবড়ার বদলে জুতো! লালবাগে থাকাটাই তো বৃথা হয়ে যাবে দেখছি। প্রবীণদের আবার জিজ্ঞাসা করতে হল, অন্তত একটা ভাল দোকানের নাম বলুন। ওঁরা জানালেন, কাছেই একটা দোকান আছে। ওদের ছানাবড়া ভাল। পথ নির্দেশ মেনে হাজির সেই দোকানে। দু’টো করে ছানাবড়া নেওয়া হল। কিন্তু দেখেই তেমন সুবিধের মনে হচ্ছিল না। মুখে দিয়ে দেখি, ছানাবড়ার গায়ে চিনি ছড়ানো। রংটাও কালো। যেন পোড়া মিষ্টি।
ইন্দ্র কিছু বলেনি। চুপচাপ খেয়ে নিয়েছিল। দোকান ছেড়ে রাস্তায় নামতেই আমার ওপর চোটপাট শুরু হল, ‘এ কী মিষ্টি খাওয়ালে গো! এ ছানাবড়া না ছানাপোড়া?’ এমন করছিল যেন দোকানটা আমার। আমিই ছানাবড়া পুড়িয়ে ছানাপোড়া বানিয়েছি। কেন এমন ঠেস, তা ভালই জানি। আমি ছানাবড়া আগে খেয়েছি। আমার অফিসের ব্রাদার জিয়ার বাড়ি মুর্শিদাবাদ। ও এক বন্ধুকে দিয়ে আনিয়েছিল বহরমপুরের ছানাবড়া। আমার ভাগে দু’টো জুটেছিল। বাড়ি নিয়ে এসেছিলাম। আমাদের মঙ্গলবারের আড্ডায় সেদিন ইন্দ্র, বাবলা, শুভ কেউ আসেনি। শুধু দীপু। তা-ও দু’টো ছানাবড়া পাঁচ টুকরো করা হয়েছিল। আমাদের বাড়ির চারজনও তো ভাগিদার। ওইটুকু টুকরোতেই সেই ছানাবড়ার যে স্বাদ পেয়েছিলাম তার কাছে লালবাগের এই দোকানের উৎপাদন ইনিংস এবং দশ উইকেটে পরাজিত হবে। দীপু তো আঙুলগুলো আচ্ছা করে চাটল। ছানাবড়া দু’টো ও-ই ভাগ করেছিল কিনা। ইন্দ্র আসতে চেয়েছিল। কিন্তু ভাগে কম পড়ে যাবে বলে আসতে দিইনি। মাত্র দু’টো ছানাবড়া। প্রভু যিশুর দু’টো রুটি তো নয় যে গোটা গ্রামকে খাওয়ানো যাবে! ও সেই না পাওয়ার বেদনা থেকে এমন ঈর্ষার ঝাড় ঝাড়ছে। ওকে সান্ত্বনা দিলাম, ‘কাল তো বহরমপুরে যাচ্ছি। তোকে ভাল দোকানের ছানাবড়া খাওয়াব।’
পরদিন প্রবল ঘোরাঘুরি হল। বহরমপুর ছাড়িয়ে চলে গিয়েছিলাম জলঙ্গি। রাতে ফিরলাম। বাসের টিকিট কেটে, খাওয়াদাওয়া সেরেও দেখি অনেকটা সময়। আবার ছানাবড়া অভিযান। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল, কাছাকাছির ভাল দোকান আছে টেক্সাইল মোড়ে। হেঁটে হেঁটে হাজির দু’জনে। কিন্তু ছানাবড়া নেই। দোকানদার বললেন, ‘‘আজ রাখি পূর্ণিমা। তার উপর স্বাধীনতা দিবস। সব শেষ। একজন অর্ডার দিয়েছেন। তাঁর জন্য ১২০টি ছানাবড়া করা হয়েছে। সেগুলোই শুধু আছে। কিন্তু সেখান থেকে দেওয়া যাবে না।’’ তাহলে ঝুড়ির দই দিন? মুর্শিদাবাদ আসার আগে খাবারের খোঁজ করতে গিয়ে এমন বিস্ময়কর জিনিসের সন্ধান পেয়েছিলাম। দোকানে মাটির পাত্রে দই পাতা হয়। এঁরা পাতেন ঝুড়িতে। দোকানদার জানালেন, ঝুড়ির দইও নেই। পরামর্শ চাওয়া হল, তিনি একটা দোকানের নাম বলুন যার ছানাবড়া ভাল। ভদ্রলোক বললেন বহরমপুর জেলখানা পেরিয়ে একটা দোকানের নাম। টোটো ধরে সেখানেও গিয়ে ঠেকতে হল। গামলায় শিবরাত্রির সলতের মতো একটাই ছানাবড়া। ঝুড়ির দইও নেই।
টোটোয় চেপে ফিরছিলাম। মাঝ রাস্তায় এক প্রবীণা উঠলেন। আমরা সবসময়েই সহযাত্রীদের সঙ্গে ভাব জমাই। তাতে এলাকার অনেক তথ্য মেলে। প্রবীণা কথায় কথায় জানালেন, ছানাবড়ার ভাল দোকান কল্পনার মোড়ে। মৌচাক, আমন্ত্রণ। ওঁরা চিরকাল ওইসব দোকানের ছানাবড়াই খেয়ে আসছেন। ইন্দ্রকে বললাম, ‘‘যাবি?’’ ও নিমরাজি ছিল। ওটাই সম্মতি ধরে হাজির কল্পনার মোড়ে। কিন্তু মৌচাক বন্ধ। গেলাম আমন্ত্রণে। সেখানে ছানাবড়া নেই। তবে ঝুড়ির দই রয়েছে। তাই নিতে চাইলাম। কিন্তু ইন্দ্র প্রস্তাব দিল, দোকানেই দধিমাধব হতে। মানে খেয়ে নিতে। বাড়িতে বয়ে নেওয়ার ইচ্ছে ওর নেই। চিরকালই তো বওয়ার কাজটা ও ফ্র্যাঞ্চাইজি দিয়ে চালিয়েছে। কিন্তু আমি রাজি হলাম না। দোকানে মাত্র দু’টো ঝুড়ি আছে। একটার দই এক কেজি। আরেকটা সাড়ে সাতশো। ছোটটাই যদি ভাগ করে খাই ভাগে সাড়ে তিনশো গ্রাম পড়বে। সাড়ে তিনশো গ্রাম দই খাওয়া আমার কম্মো নয়। ইন্দ্র হয়তো পারবে। ও এরকম উদ্ভট প্রস্তাব দেয়। কিন্তু আমরা পাত্তা দিই না। ফলে দু’টো ঝুড়ি আমাদের অধিকারে এল। বড়টা আমার। ছোটটা ওর। ২৫০ গ্রাম তো বইতে কম হল। অথচ ওর বাড়িতেই লোক বেশি।
ঝুড়ির দই তো হল। কিন্তু ছানাবড়া? দোকানে দাঁড়িয়েই আক্ষেপ করছিলাম। শুনে মালিক জানতে চাইলেন কোথা থেকে আসছি? বললাম। মালিকের নাম সাধন ঘোষ। তিনি পশ্চিমবঙ্গ মিষ্টান্ন ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতি। ভদ্রলোকের সঙ্গে গল্প শুরু হল। সাধনবাবু নতুন ইতিহাস বললেন। জানালেন, ছানাবড়া বিখ্যাত হওয়ার পিছনে কোনও নবাবি আমলের যোগ নেই। রয়েছে বহরমপুরের রাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীর অবদান। এই মণীন্দ্রচন্দ্রের নামেই কলকাতার শ্যামবাজারে মণীন্দ্র কলেজ। ইনি ছিলেন মহারাজা কৃষ্ণনাথের ভাগ্নে। কৃষ্ণনাথ এবং রানি কাশীশ্বরী ছিলেন সন্তানহীন। তাই তাঁরা দত্তক নিয়েছিলেন ভাগ্নেকে। একবার কোনও ইংরেজকে কর্তাকে তুষ্ট করতে মণীন্দ্রচন্দ্র মুর্শিদাবাদের গোরাবাজারের পটল ওস্তাদকে ছানাবড়া তৈরির বরাত দেন। সেই ছানাবড়া খেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন ইংরেজ কর্তা। ছানাবড়ার নাম ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে।
আমরা লালবাগের ছানাবড়ার অভিজ্ঞতার কথা জানালাম। সাধনবাবু জানালেন, স্বাদের ছানাবড়া তৈরি করতে সময় দিতে হয়। অন্তত তিনদিন রসে ডুবিয়ে রাখতে হবে ছানাবড়া। তবেই সেটা বিক্রির যোগ্য হবে। সেই রস করতে হবে নতুন চিনির। না হলে স্বাদ হবে না। ছানা মাখতে আটা লাগে। সুগন্ধের জন্য বড় এলাচ দেওয়া হয়। আগে ঘিয়ে ভাজা হত। এখন ডালডায় হয়। গাওয়া ঘিয়ে ভাজা ছানাবড়ার দামটা বেশি পড়ে। ২৫ টাকা পিস। কিন্তু ডালডায় ভাজা মাত্র ১০ টাকা। ছানাবড়ার উপরে কি চিনি ছড়াতে হয়? সাধনবাবু জানালেন, তৈরিতে সময় না দিলে চিনি ছড়াতে হবে। ওই যে তিনদিন রসে ডুবিয়ে রাখতে হয় তাতেই চিনির রস ছানাবড়ার গায়ে আস্তরণের মতো জমে। কিন্তু যদি একদিনেই বিক্রির জন্য দোকানের শোকেসে আনা হয় তাহলে চিনি ছড়াতে হয়। কারণ রসের আস্তরণ জমার সময় পায় না।
আর ঝুড়ির দই? ঠিক কোথায় প্রথম তৈরি তা বলতে পারেননি সাধনবাবু। তবে এটা মুর্শিদাবাদের একান্ত নিজের দই। এই দই আর কোথাও তৈরি হয় না। বাঁশের ছোট ছোট ঝুড়ির গায়ে দইয়ের সাজার প্রলেপ দিয়ে পাত্র তৈরি করা হয়। মানে ঝুড়ির ফাঁকগুলো বন্ধ করা হয়। এর পর পাতা হয় দই। দইয়ের উপরে ঘিয়ে রঙের আস্তরণ। আস্তরণ তুলে ফেললে সাদাটে দই। মিষ্টি দই। তবে অন্য মিষ্টি দইয়ের তুলনায় একটু টকের আভাস। খেতে অপূর্ব।
ঝুড়ির দই হাতে ঝুলিয়ে বেরিয়ে আসছি, সাধনবাবুর বোধহয় একটু দয়া হল। তিনি সত্যনারায়ণ দোকানে ফোন করে ছানাবড়া আছে কিনা জানতে চাইলেন। সেখানেও নেই। আমাদের ম্লান মুখ দেখে সাধনবাবু ভরসা দেওয়ার সুরে জানালেন, শিগগির কলকাতার বাগবাজারে মিষ্টি উৎসব হবে। এবার তাঁরাই হবেন মুর্শিদাবাদের প্রতিনিধি। ছানাবড়াও নিয়ে যাবেন তাঁরা। সাধনবাবুদের ছানাবড়া রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ও খেয়েছেন। তিনি অবশ্য তখন বিদেশমন্ত্রী ছিলেন। তাঁকে ৩০ কিলো ওজনের ছানাবড়া উপহার দেওয়া হয়েছিল। শুনে ইন্দ্রর কাঁধে একবার টোকা দিলুম। ঘরের কাছে যাবে যে ছানাবড়া। তখন ঠুসে খাস।
বাঙালির সেরা উৎসবের মরসুমে আরেক উৎসবের অপেক্ষায় রয়েছি। সেই উৎসবে ইন্দ্রর ছানাপোড়া ব্যঙ্গের জবাবটা দিতে হবে ভাল করে।
ছবি— ইন্দ্রজিৎ সাউ
(সমাপ্ত)