দীপক দাস
আমরা যে বাসে ঝিলিমিলি চলেছি তার নাম ‘নীলকণ্ঠ’। বাস ফাঁকা হয়ে যাওয়ায় কন্ডাক্টর রোহিণীদার আর তেমন কাজ ছিল না। মাঝে এক রসিক ছোকরার লোক হাসানোর চেষ্টার ঠেলায় অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। রসিক মানে রসবোধওলা নয়। পানরসিক। পুজোর সময়ে যাচ্ছে শ্বশুরবাড়ি। সেই খুশিতেই চড়িয়েছে দু’পাত্তর। বা দুই পলিথিন। কী টেনেছে সেটা তো আর জিজ্ঞাসা করা হয়নি। ব্যাটা নেমে গেল কোনও এক তলে। আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
অনেক গল্প বলছিলেন রোহিণীদা। বিশেষ করে বিপ্লবীদের গল্প। দু’ধরনের বিপ্লবী। স্বাধীনতা সংগ্রামী। আর স্বাধীনতা পরবর্তী সংগ্রামী। প্রথম শ্রেণির লোকজন বিদেশি মেরে দেশের মানুষের মুক্তি এনেছিলেন। দ্বিতীয় শ্রেণি দেশের মানুষকে মেরে দেশের মানুষের ভাল চেয়েছিলেন। থাক সেসব কথা। রোহিণীদা যা বলছিলেন বলা যাক। জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতেন বিপ্লবীরা। বহু কষ্ট করে। ইংরেজদের পক্ষে সেই জঙ্গল চিনে ভিতরে ঢোকা অসম্ভব ছিল। ছেন্দাপাথরের কাছেই একটা গুহা আছে। সেখান ক্ষুদিরাম লুকিয়েছিলেন। ভ্রমণ পিপাসু পার্থ দে ছেন্দাপাথর সফর নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলেন। তা থেকেই তথ্য পেয়েছিলাম। বাসরাস্তা থেকে গুহাটা দেখা যায় না। শুধু রাস্তার পাশে ওই ক্লাবে ক্ষুদিরামের নাম আর ছবি পেয়েছিলাম।
কিছু বছর আগে যে বিপ্লবীরা এসে জঙ্গলে লুকিয়েছিলেন তাঁদের কিছু চিহ্নও রাস্তার পাশে দেখলাম। এক সিআরপিএফ কমান্ডান্টের শহিদ বেদি। মাওবাদী বিস্ফোরণে মারা গিয়েছিলেন। সম্ভবত আইইডি বিস্ফোরণে। পড়ে থাকা ব্যাগের চেন খুলতে গিয়ে মারা যান তিনি। আমরা জঙ্গলমহলের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরেছি। সেগুলোর বেশ কিছু মাওবাদী প্রভাবিত। হয়তো তাঁদের বিপ্লব উচ্চতর কোনও স্বপ্নের দেশ তৈরির জন্যই সংগঠিত হচ্ছিল। আমরা কোথাও কিন্তু তাঁদের কথা বলার সময়ে শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভাব লক্ষ করিনি। সব জায়গাতেই মনে হয়েছে একটা ভয় কাজ করেছে। বুরুডি ড্যামের কাছে এক প্রাক্তন মাওবাদীর ভাতের হোটেল আছে। ওখানকার লোক তাঁকে দেখিয়ে বলেন, লোকটা আগে মাওবাদী ছিল। তার মানে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের সঙ্গে এখনও মিশে যেতে পারেননি তিনি। অথবা তাঁকে নিতে এখনও কিছুটা হলেও দ্বিধা আছে ওঁর চেনা মহলেই। তাহলে ‘ও আগে মাওবাদী ছিল’ কথাটা বলতেন না। এই এলাকায় একটা পর্যটন আবাস ছিল। পার্থ জানিয়েছিল। মাওবাদী পর্বে সেটি বন্ধ হয়ে যায়। সেই ভয়।
বহু আগে বাসে উঠেছি। সেই সাড়ে ১১টার সময়ে। এখন ৩টে বাজে। খারাপ রাস্তায় নেচে নেচে চলেছে বাস। হাড়-মাস খই ফোটার মতো লাফাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এলাকার গল্প আর প্রকৃতি সেই কষ্ট ভুলিয়ে দিচ্ছে। রোহিণীদা জানালেন, জঙ্গলে ময়ূর আছে। হরিণ আছে। শিয়াল, খরখোশও আছে। শুনে আমি আর দীপু দুখখু পেয়ে গেলুম। বন্যপ্রাণী দর্শন কি আমাদের ভাগ্যে ঘটবে! কোনওদিন ঘটেনি। বড্ড জোর জম্বুক দর্শন হতে পারে।…
পুজোর সময়ে এই সব এলাকায় সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষজন ভুয়াং নাচের দল বের করেন। রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকেন দলবেঁধে। টাকা পয়সা দেন বাসকর্মীরা। কখনও পাড়ার লোকজন। আগে যখন মুকুটমণিপুরে এসেছিলাম তখনও দেখেছিলাম। এবারও চোখে পড়ল। একসময়ে বাস রাস্তা থেকে কিছু দূরে একটা জলাশয় দেখতে পেলাম। বেশ ভিড়। ছিপ ফেলে মাছ ধরা চলছে। রোহিণীদা বললেন, ‘‘সুতান নামে একটা ড্যামে বিশাল বিশাল মাছ আছে। এত বড় মাছ যে বঁড়শি গেঁথেও টেনে তোলা যায় না। বর্শেলকে টেনে জলে নামিয়ে দেয়।’’ মাছ ধরার কথা শুনে বাবলার কথা মনে পড়ল। সেই রানিবাঁধে দেখা হয়েছিল। একসঙ্গে খাবার সময়ে। একসঙ্গে না বসলে কী মজা হয়! দীপুকে বললুম, ‘‘ডাক ছোটা ডনকে।’’ দীপু হাঁক দিল। বাবলার নো সাড়া। ফোন করা হল। আমাদের কাছে আসতে অস্বীকার করল। বাসের কেবিনে বসেছে তো। পুরো প্রকৃতি সামনে থেকে দেখতে পাচ্ছে। পরমা প্রকৃতির জন্য পরম সাথীদের অস্বীকার করল।
তাহলে ইন্দ্রকে ডাকা যাক। ডাকতে যাব, দেখি ইন্দ্র মাথা নিচু করে বসে আছে। ঘুমোচ্ছে? আরেকটু লক্ষ করলাম। না, মাথা নিচু করে কানটা সহযাত্রীর মুখের কাছে নিয়ে গিয়েছে। দূর থেকে কানটাই মনে হল। সহযাত্রী নন যাত্রিনী। তিনি কিছু বলছেন। ইন্দ্র সেটা মন দিয়ে শুনছে। পিছনে বসে লাফাতে লাফাতে আরও কিছুক্ষণ ইন্দ্রর কানের যাওয়া-আসা দেখলাম। স্থানীয় কোনও মেয়ে। ইন্দ্র হয়তো এলাকার খুঁটিনাটি সংগ্রহ করছে। আমাদের সফরে কাজে লাগবে। এই ভেবেই মনকে সান্ত্বনা দিলাম। আর অপেক্ষা করতে লাগলাম, এই বুঝি ইন্দ্র লাফিয়ে উঠে গাইতে শুরু করল, ‘দেখা না হায় রে সোচা না হায় রে’। ‘বম্বে টু গোয়া’ সিনেমায় অমিতাভ বচ্চন যেমন গেয়েছিলেন সহযাত্রিনী অরুণা ইরানিকে লক্ষ করে। না সেসব কিছুই হয়নি। তবে ওর বাম কর্ণসেন আমাদের কিছু উপকারও করতে পারেনি। পরে জানতে পারব, ইন্দ্র এলাকার তথ্য নয় সহযাত্রিনীর জীবনপঞ্জি জোগাড় করেছে কান নিয়ে গিয়ে। এই যেমন, তিনি কবে উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছেন। তাঁর বাড়ি কোথায়? হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর আছে কিনা। ছেলেটা যদি কোনওদিন আমাদের দলের কিছু কাজে আসে!
তার পর জঙ্গলের পথ ধরে বাস ধীরে ধীরে এগোতে লাগল। ইন্দ্রর সহযাত্রিনী তাঁর গন্তব্যে নেমে গেলেন। তাঁর স্টপের নামও কোনও তল দিয়ে কিনা খেয়াল করতে ভুলে গেলাম। পাহাড়ি রাস্তায় এঁকেবেঁকে চলতে লাগল বাস। ঠিক যেন পাকদণ্ডি। স্পষ্ট দেখলে পেলাম ডানদিকে টিলার উপরে বাড়ি। কিছুক্ষণ পরে সেটা চলে এল বাঁদিকে। কী আনন্দ আমাদের। এক সময় রোহিণীদার ‘নীলকণ্ঠ’ এসে থামল ঝিলিমিলি বাজারে। বেশ জমজমাট বাজার। আমাদের অবশ্য প্রথমেই চোখে পড়ল বিশাল মিষ্টির দোকানটা। মিষ্টির দোকানের পাশেই কাপড়ের দোকান। লজের মালিক আর কাপড়ের দোকানের মালিক একই। রোহিণীদা কথা বললেন মালিকের সঙ্গে। লজ ফাঁকা নেই। মালিক জানালেন, অন্য গেস্ট হাউসও সব ভর্তি। আমরা পরস্পরের দিকে তাকালাম।
মালিকই পরামর্শ দিলেন, পোড়াডিতে মনোরঞ্জন নামে একজনের কাছে চলে যেতে। ঘর মিলতে পারে। রোহিণীদা আমাদের একটা দোকানে নিয়ে গেলেন। সেই খাবারের দোকানের মালিকের গাড়ি আছে। তিনি পোড়াডি নিয়ে যাবেন। জায়গাটা ঝিলিমিলি বাজার থেকে প্রায় দু’কিলোমিটার। গাড়িতে উঠে আমাদের দলের সেই কালো বিড়াল বলল, ‘‘পোড়াডিতেও বাড়ি পাবে না।’’ বলেই সে কী অপার্থিব হাসি। সে হাসি শয়তানের সঙ্গে মেলে। বা বিচ্ছু নর্স দেবতা লোকির সঙ্গে। কালো বিড়ালের কথা শেষ হল আর ঠিক সেই সময়েই সত্যি সত্যি একটা কালো বিড়াল রাস্তার একপাশ থেকে অন্য পাশে দৌড়ে গেল। আমি চেঁচিয়ে বললাম, ‘‘তোর দোষ কেটে গেল মনে হচ্ছে।’’ সকলে হইহই করে উঠল অপয়ার দোষ কাটার আনন্দে।
কিন্তু পোড়াডিতেও কোনও ঘর নেই। উপরে গেস্ট হাউস। নীচে হোটেল। মনোরঞ্জনদা ছিলেন না। তাঁর স্ত্রী আমাদের হাঁকিয়েই দিলেন। আমরা বললাম, মনোরঞ্জনবাবুকে ডেকে দেওয়া হোক। স্ত্রী রাজি হচ্ছিলেন না। বেশ কয়েকবার আবেদনের পরে ডেকে দিলেন। মনোরঞ্জনবাবুও জানালেন, ঘর নেই। দীপু ফিসফিস করে বলল, ‘‘ফেরার ট্রেন দেখতে বলো ইন্দ্রদাকে।’’ আমাদের গাড়ির মালিক বোধহয় ফিসফিস করে একজনকে জিজ্ঞাসা করলেন, আর কোথায় যাওয়া যায়? তখনই মনোরঞ্জনবাবু বললেন, ‘‘একটু দাঁড়ান।’’
তার পর? দেখলাম, প্যাকেটের পর প্যাকেট নামছে ছাদের ঘর থেকে। কিছুক্ষণ পরে একটা মাল সরানো হল। আর আমরা সেই অস্থায়ী গুদাম ঘরে ঠাঁই পেলাম। না, বিছানাপত্তর, আলো, পাখা সবই ছিল। ঘরের দখল নিয়ে আমরা একসঙ্গে কালো বিড়ালটার দিকে তাকালাম।
ওর গোঁফের আড়ালে তখন হেরে যাওয়ার হাসি।
(সমাপ্ত)