শ্রেয়সী সেনশর্মা
এবারের ঘোরার গপ্প একটু দিনলিপি চলবে
২৫.০৮.২০১৯
রাতের ট্রেন, দার্জিলিং মেল আর তিন কন্যে পাড়ি দিলাম গাছ খোঁজার উদ্দেশ্যে, মোটামুটি গন্তব্য গোটা সিকিম চষে ফেলা। এবার একা না। সঙ্গে দুই সাথী নিয়ে চললুম গিরিরাজের কাছে। তাই গল্প হয়তো লম্বা চলবে। গানে, গল্পে ঘুম চলে এল চোখে।
২৬.০৮.২০১৯
বিশেষ নিশাচর নয় বরং ভোরে ওঠা বান্দা। ভোর ছ’টা, আমার সিট ছিল ঠিক লোয়ার বার্থ, জানলার পাশে। ঘুম ভেঙে ড্যাবড্যাব করে জানলা দেখছি। কী দেখলাম জানো? চা বাগানের মাথা দিয়ে রামধনু উঁকি দিচ্ছে। এরকম দৃশ্য হয়তো ভাগ্যবানদের কপালে জোটে। চেটেপুটে খেলাম এই দৃশ্য। তিন মাইল হল্টের সামনে থেকে দেখতে পাচ্ছি, ধীরে ধীরে উঁকি মেরে উঠছেন পাহাড় সারি। পাট চাষ আর চা বাগানের বেশ বন্ধুত্ব। দৃশ্যটা ঠিক এরকম পাট চাষ, পাহাড় আর নেপালের বর্ডার। লেট কান্তি টেরেন ৮ টার জায়গায় নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছল ১১টা। ভারি লটবহর নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে একটু জলখাবার খেয়ে উঠলাম সিকিমের গাড়িতে। রাস্তা একখান পেয়েছিলাম। উফ। একবার করে লাফাচ্ছি আর কোমর চেপে বসে পড়ছি। আমার দুই সাথী তো ঘুমিয়ে পড়ল ধুলোর চোটে। বর্ষায় রাস্তা কম আর জাহানের জাহান্নাম বেশি বা নিকোপার্কের রোলার কোস্টারও বলা যেতে পারে। মুখে প্লাসের (পালসের তিস্তা সংস্করণ বলা চলে) চেপে রাস্তা দিয়ে চলছি। ঘণ্টা পাঁচেক লাগে।
যেতে যেতে তিস্তা যেন পাহাড় জড়িয়ে ভীষণ একটা আদুরে কলকল কন্যা। কিন্তু পাড়ভাঙা অভিমানী। পাড়ে পাড়ে নুড়িগুলো তিস্তার পূজারী আর পথে যেতে পড়ে সেবক রোড মনাস্ট্রি। সেবক রোড কালী মন্দির আর অবশ্যই মহানন্দার অভয়ারণ্য। যেখানে শাল শিমূলের ঘন বনেরা গুরুগম্ভীর বেশে দাঁড়িয়ে। পথ চিরে কাঠের বাড়ি, কখনও বা পর্যটকদের ভিড়। সব পেরিয়ে ৩টে নাগাদ একটি ধাবা, তাতে ধোঁয়া ওঠা মোমো। পিছন ফিরলেই সারি সারি পতাকা, যাতে তিস্তার হাওয়া দোলা দিয়ে যায় অল্পস্বল্প, খানিক অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলাম। নতুন পর্যটক হলে যা হয়।
৫টা নাগাদ সিকিম ঢুকল। লেখা বড় বড় করে Welcome to East Sikkim। অতপর সার্কেল অফিস পৌঁছে চারতলায় গেস্ট হাউসে। আজ্ঞে ঘরটি খাঁ খাঁ করছে। ট্রেনের ধকল সামলে লেগে পড়লুম ঘর পরিস্কারে। বর্ষা ভরা সিকিমে জানলায় টুপটাপ বৃষ্টি দেখতে দেখতে জ্যাকেট পেতে শোয়া আর মেঝেতে স্লিপিং ব্যাগ আর কাপ নুডলস। না হে পাহাড়ের একটা টান আছে, যা সব কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। শুনলুম দু’দিন ধরে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা দিচ্ছেন।
২৮.৮.১৯
চল্লিশ ধাপ হেঁটে, জোঁক মাড়িয়ে, ভোর পাঁচটাতে চললুম। উঠছে উঠছে। ওরে বাবা গায়ে কেরম কাঁটা দিয়ে উঠল। গিরিকন্যা তাঁর সমস্ত রূপের ডালা নিয়ে ধীরে ধীরে আবির্ভূত হলেন। এর সঙ্গে পরেও তিনবার দেখা হয়েছে। সেসব গল্প পরে হবে। আপাতত যজুর্বেদের শোনা শ্লোকটাই মনে এসেছিল। ‘তেজোহসি তেজো ময়ি ধেহি।/বীর্যমসি বীর্যং ময়ি ধেহি।/বলমসি বলং ময়ি ধেহি।/ওজোহ স্যোজো ময়ি ধেহি’।/মন্যুরসি মন্যুং ময়ি ধেহি।/সহোহসি সহো ময়ি ধেহি’।
হে পরমাত্মা! তুমি তেজস্বী, আমাতে তেজ স্থাপন কর। তুমি বীর্যবান, আমাতে বীর্য স্থাপন কর। তুমি বলবান, আমাতে বল স্থাপন কর। তুমি ওজস্বী, আমাতে ওজঃ স্থাপন কর। তুমি অধর্মের দণ্ডদাতা, আমাতে অধর্ম দমনের শক্তি স্থাপন করো। তুমি সহনশীল, আমাতে সহনশক্তি স্থাপন কর।
পরের কিস্তিতে থাকবে পূর্ব, পশ্চিম আর দক্ষিণ সিকিম।