শ্রেয়সী সেন শর্মা
২৭ অগস্ট
অফিসের কাজে সারাদিন পার। মাঝে মোমো খেতে এম জি মার্গ দৌড়োলাম। আর সেই সময় শহর জুড়ে ঝুপ্পুস বিষ্টি নামল। এ পাহাড়িয়া বৃষ্টির থেকে বাঁচতে একটি আশ্রয় খুঁজতে যেতে ধপাস, চারটে সিঁড়ি গড়িয়ে পপাত ধরণীতল। দেহভারে সিঁড়ি বেঁকে যাওয়ার ১০০ শতাংশ গ্যারান্টি। ‘Feel pity’ ফর দোস সিঁড়িস। এ তো গেল দিনের গল্প। রাতে খেতে বেরোবার এক গল্প আছে। আমরা খেতে যেতাম বেশ ১০ মিনিট দূরে উতরাই নেমে CPWD canteen এ। সেখানেও বৃষ্টি। বাঙালি খাবার দক্ষিণী ইস্টাইলে খাইনি এর আগে কখনও। বেশ হুড়মুড়িয়ে নামতুম আর জিভ বের হয়ে যেত উপরে উঠতে। পদে পদে জোঁক বাবাজীবনেরও ভয় আছে। আর কোয়ার্টার ফিরে আমি আর আমার লাভ অব লাইফ ‘স্লিপিং ব্যাগ’— এক অনন্য ভালবাসা।
২৮ অগস্ট
লোকে বলে মৃতদেহ দর্শন করলে নাকি যাত্রা শুভ হয়। আমি এসব সংস্কার মুক্ত নারী। যদিও আজ অনেকটাই আমাদের ভাগ্যদেবতা নির্ভর করছে, কারণ একটাই, আমার আরাধ্য গাছদেবতা যদি চোখে পড়ে যায়। বড় ধার্মিক হয়ে যাচ্ছে নাকি? সিকিম রাজ্যটাই যে বড় শান্তির। নামচি যাওয়ার পথে কাঁধে করে একদল বাহক, কাঁধে কোনও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর শব। শব উল্টো করে ঝোলানো, এতে নাকি মোক্ষ লাভ হয় তাড়াতাড়ি। দূর পাহাড়ে সন্তোষ ভাইয়া (আমাদের পথসাথী কাম চালক দাদা) দেখাল এক দিকে চারধাম আর অন্য দিকে সামডুপচে মনাস্ট্রি। দু’টো পাহাড় আর দুদিকে। চারধাম পাহাড়ের উপরে। বেশ সুন্দর। ভারতের বিখ্যাত শিবমন্দির নিয়ে বানানো। অসম্ভব রকম সাদা। তবে সবচেয়ে সুন্দর লেগেছে পদ্মসম্ভবের মনাস্ট্রি। এক গুরুগম্ভীর শান্ত জায়গা। বৃষ্টির গুঁড়ো লাগছে গায়ে। পথ জুড়ে সারি সারি পতাকা।
বিকেল হয়ে এল, সারা রাস্তা জুড়ে কুয়াশা, এপাশ ওপাশ সব ধোঁয়া। জায়গাটার নাম ‘পুত্তলি ভিড়’। শোনা গেল, এটা নাকি ব্রিটিশ আমলে পুতুল বানানোর গ্রাম ছিল। প্রচণ্ড সরু রাস্তা। রাস্তার খাঁজে হনুমানজির ছবি। অসম্ভব রংয়ের ফুল ওই কুয়াশাতেও ফুটে আছে। আর এক দিকে গভীর খাদ। এর মধ্যে পোক্ত হাতে দাদা পৌঁছে দিল দক্ষিণ সিকিমের রাবংলার এক হোম স্টে হোটেল প্যারাডাইসে। এর মধ্যে আমার দুই সঙ্গীর প্রবল হ্যাঁচ্চো, আর জ্বর। রাতের মেনুতে এল স্কোয়াশের তরকারি, ঢেঁকি শাকের তরকারি আর ঝাল চিকেন। মোবাইল টাওয়ার কখন চলে গেছে। বাড়ির সঙ্গে দু’দিন কথা হয়নি। যা হোক করে সে রাত কাটল।
২৯ অগস্ট
প্রচণ্ড অসুস্থ শরীর আর মনের জোরে আমার সখীরা চললেন। গন্তব্য রাবংলা বুদ্ধ পার্ক। রাবং- ‘Abode of Tathagata’। গা বেশ কাঁটা দিয়ে উঠল। বুদ্ধপার্ক জিনিসটা আমার বাড়ির পাশেই ছিল ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু এ যে সুবিশাল। তথাগতশাল যার নাম। টুরিস্টের তেমন ভিড় নেই। মন্দিরটি কাঠের। অসম্ভব সুন্দর তার কারুকাজ। ভিতরে গভীর উচ্চারণ ‘ওম মণিপদ্মে হুম’। এর মধ্যে আমাদের সবার পায়ে চারটে করে জোঁক কামড়ে রক্তপাত বেশ ভালই করিয়েছে। ওই রক্তাক্ত মোজা পায়েই আমরা বুদ্ধ মন্দিরে অহিংস মন দিয়ে প্রার্থনা জানালাম।
এর পর গন্তব্য পেলিং। যেতে যেতে প্রায় বিকেল। হোটেল ম্যানেজার বাঙালি, মেদিনীপুরের লোক। ঘরটা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা নাকি দেখা যায়। ক্লান্তিতে ওরা সব ঘুমিয়ে পড়লেও আমি ব্যালকনিতে মুড়ি মুড়কি খেতে খেতে পাহাড়ের মাথার আলো জ্বলা দেখছিলাম। অন্ধকারেও কী সুন্দর সব আলো। পরেরদিন ভোরে পাঁচটায় নাকি দেখা যাবে। একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, এই পশ্চিম সিকিমে খাবারে বড় ঝাল। ডিনারেও কেবল ডাল, ভাত ডিমের ঝোলে কাজ সেরেছি।
৩০ অগস্ট
ভোর চারটে অ্যালার্ম ‘আপ কি নজরো নে সমঝা’। চোখ কচলে দেখি তখনও ভোর হয়নি। কাঁটায় কাঁটায় পৌনে পাঁচটা। সোনালি চাদর মুড়ে ভোরের আলো গায়ে জড়িয়ে অভিমানী প্রেমিকার মতো দেখা দিলেন। কিশোরীর প্রথমবেলার সলজ্জ সাজের মতো। ভোর সাতটা, দেহ টেনে কোনও মতে ‘Pelling sky walk’এর দিকে রওনা দিলাম। পুরো কাচের রাস্তা আর বুদ্ধ মন্দির। এখানেও দেখছি স্বর্গীয় জানলা দিয়ে উঁকি দিচ্ছেন ‘কাঞ্চনকন্যা’। লোকে একবার পায় না দেখতে, আমরা তিনবার দেখে ফেললাম। রাস্তা জুড়ে গেল্ডিং ফলস-সহ আরও অনেক ঝর্ণা। আর সিকিমের পুরোনো রাজধানী ‘Rabdenste capital’। আধঘণ্টার পায়ে চলা বাঁশঝাড় মোড়া পথ পেরিয়ে রাজাদের রাজধানী, মন্দির, প্যাগোডা, পুজোর ঘর। ইতিহাস এখানে হাতছানি দেয়।
এবার গন্তব্য বারসে রডোডেনড্রন স্যাংচুয়ারি। রাস্তায় ‘চিকেন ফালে’ সহযোগে জলযোগ করে চললাম। আমাদের এই চারদিনের জার্নিতে মোবাইল টাওয়ার নেই বললেই চলে। অর্থাৎ কলকাতায় কী হচ্ছে জানার উপায় নেই। দুপুরের দিকে শুরু হল অসম্ভব বৃষ্টি। ইয়ুকসাম হয়ে ওখরে। আমরা ‘খেচিপেরি লেকের’ দিকে যাইনি। রাতটা স্যাংচুয়ারিতে কাটাব ঠিক করলাম। বৃষ্টিতে যে কোনও মুহূর্তে ধস নামতে পারে। উচ্চতা প্রায় ৩০০০ মিটার। ভালুক বেরোতে পারে। যা হোক করে ভিতরে পৌঁছে যে হোম স্টেতে গেলাম তাতে নাকি আলো নেই। খাবারও যে পাব, ঠিক নেই। অগত্যা স্যাংচুয়ারি থেকে বেরোতেই হবে।
সন্ধ্যা ৬টা। পাহাড়ে রাতে গাড়ি চালানো নিষেধ। তা-ও দেড়ঘণ্টা ওই প্রবল বৃষ্টিচ্ছন্ন রাস্তা দিয়ে ভাইয়া গাড়ি চালিয়ে পৌঁছে দিল আমাদের এক হোম স্টেতে। সাহসী বলে সুনাম হওয়া সত্ত্বেও প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেছিলাম। যাই হোক সেখানেও অসাধারণ খাবার। ডিমের ঝোল ভাত। আমার সাথীরা সুস্থ হলেও হ্যাঁচ্চো শুরু হল আমার, সঙ্গে জ্বর। আমার ঘরে একটি সানবার্ডের ছবি। মূলত নাকি ‘White Tragopan’ এর জন্য টুরিস্ট আসে। এটা একধরনের ফেজান্ট। সুন্দর দেখতে পাখি। শুনলাম। হোমস্টের নাম ‘বার্সে রেসিডেন্সি’। মালিকের ব্যবহার খুবই ভাল, তার সঙ্গে পাখির উপর তাঁর অসাধারণ পড়াশোনা। একটি রডোডেনড্রনের ওয়াইন নেওয়া হল, দাম ৩০০ টাকা। চার বছরের পুরনো।
৩১ অগস্ট
প্রচণ্ড জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। জ্ঞান প্রায় নেই। কোনও মতে বিকেল বেলা গ্যাংটক পৌঁছলাম। এই দিনের ঘটনা প্রায় কিছু মনে নেই। কেবল মনে আছে আরও একদিন অসুস্থ ছিলাম।
(এর পরের কিস্তিতে পূর্ব ও দক্ষিণ সিকিম)