দীপক দাস
দারুণ একটা তথ্য পেলাম। ঈশ্বর গুপ্ত নাকি প্রতি বছর দুর্গাপুজোর পরে ঘুরতে বেরোতেন। দেশ দেখার নেশায়। পূর্ববঙ্গ, উত্তরবঙ্গ, ওড়িশা নানা জায়গায়। গুপ্ত কবির এমন কীর্তির কথা সম্প্রতি গোচরে এসেছে। আর তাতেই দিল দরিয়া হয়ে কলকল রবে বইতে লাগল। কাব্য করলাম বটে। আসলে মনে বড়র ভাব জাগল। আমরাও তো তাই করি। ঈশ্বর গুপ্তের সফরের কথা না জেনেই। তফাৎ একটুই। উনি পুজোর পরে বেরোতেন। আমরা পুজোর দিনেই ঘুরতে বেরোই। তিনদিনের পুজো পরিক্রমা আমাদের জঙ্গল পাহাড়েই কাটে। গত পুজো পর্যন্ত তা-ই কেটেছে।
তিন জেলায় চরকি পাক খেয়েছিলাম গত পুজোয়। চার তালেবর গিয়েছিলাম তালেবেড়া। বেসক্যাম্প বাঁকুড়ার ঝিলিমিলি। ঠিক ঝিলিমিলি নয়। ঝিলিমিলি বাজার থেকে কিলোমিটারটাক উজিয়ে পোরাডি নামে এক জায়গায়। ভারী সুন্দর জায়গা। ওই জায়গা থেকে পুরুলিয়া এবং ঝাড়গ্রামের বিভিন্ন এলাকা ঘোরা যায়। খুব একটা দূরত্ব নয়। আমরা একদিন চলে গেলাম তালেবেড়া। বাঁকুড়াতেই জায়গাটা। ঠিক নামটা বোধহয় তালেবেড়িয়া। আসলে একটা ড্যাম। জলাধার। কিন্তু কী অপূর্ব।
প্রথমে সুতান গিয়েছিলাম। সে গল্প পরে একদিন হবেখন। আজ তালেবেড়া হোক। সুতান থেকে তালেবেড়া আসতে রাস্তার ধারের প্রকৃতিও বেশ সুন্দর। পথে একটা গ্রাম পড়ল। অদ্ভুত নাম। চোরকুপি। বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার অনেক গ্রাম নামের সঙ্গে এই ‘কুপি’ শব্দটার যোগ হয়। কী মানে ‘কুপি’র? রাস্তায় কাউকে ধরে কুপির অর্থ জিজ্ঞাসার সাহস হয়নি। শেষে পড়া ধরার অভিযোগে কারও কোপে পড়ি যদি! ‘কোপ’ সাংঘাতিক শব্দ। অফিসে, রাজনীতিতে, বিদেশ নীতিতে কোপে পড়ে কত লোক, দেশের সর্বনাশ হয়েছে!
তালেবেড়া আসলে একটা ড্যাম। কৃত্রিম জলাধার। বছর কয়েকের ঘোরাফেরার জীবনে অনেকগুলো ড্যাম দেখেছি আমরা। প্রতিটার আলাদা আলাদা রূপ। বরন্তির ড্যামে দূরের সেই পাহাড়টার ছায়া পড়ে জলে। এই জল-ছায়া যেন বরন্তির প্রতীক হয়ে গিয়েছে। জলাশয় ঘিরে উঁচু বাঁধ আর তার পাশের টিলা, জমি, পলাশ গাছের সারি, জলে টিউব ভাসিয়ে মাছ ধরা— সব মিলেমিশে মনে স্থায়ী ছাপ ফেলে যায়। আবার মাইথন বাঁধে বিপুল জলরাশির মধ্যে দূরে জেগে থাকা দ্বীপটাকে দেখে মনে হয় ‘ওই সিন্দুর টিপ সিংহল দ্বীপ’। তুলনায় পাঞ্চেতকে কিছুটা নির্জন, বিষণ্ণ মনে হয়েছে।
তালেবেড়ারও নিজস্বতা আছে। সেই নিজস্বতা তার গঠনে। কিছুটা ত্রিভুজাকৃতি ড্যাম। কেউ ঘুরতে গিয়ে আবার অঙ্ক বইয়ের সংজ্ঞা মেপে ত্রিভুজ মেলাতে যাবেন না, অনুরোধ। অঙ্কে আমি কাঁচা। আর ত্রিভুজের সংজ্ঞা ভুলে গিয়েছি। তাছাড়া ত্রিভুজের অনেক ভাগ। শেষে দেখা গেল, সংজ্ঞা অনুযায়ী তালেবেড়া একটা ত্যাড়াবাঁকা চতুর্ভুজ বা ফানেলাকৃতি। খুব মুশকিল হবে তখন। বয়স হয়েছে। কানের পর্দা দুর্বল। গালির তোড়ে ফট করে ফেটে চির বধির। তখন দীপু, ইন্দ্রর কাঁকড়া বাঙালি সুলভ কথা বা ছোটা ডন বাবলার মজার ছোট ছোট বাক্যগুলো থেকে বঞ্চিত হব।
কী যেন বলছিলাম? তালেবেড়ার নিজস্বতা। ত্রিভুজাকৃতি (ধরে নিন) তালেবেড়ার শীর্ষবিন্দু বরাবর শুধু জল। এখানে একটা সত্যি কথা বলে নিই। অঙ্কের বইয়ের ত্রিভুজের মতো শীর্ষবিন্দু নয় এই ড্যামের জ্যামিতিক আকার। দুই পার একবিন্দুতে গিয়ে মেলেনি। বরং বয়ে গিয়েছে। তার পর বাঁক নিয়ে চোখের আড়ালে চলে গিয়েছে। ওই দিকে জঙ্গল থাকায় আর দেখা যায় না জলধারার গতিপথ। যেখানে শীর্ষবিন্দু হওয়ার কথা ছিল সেদিকটায় তাকালে দূরে একটা পাহাড় চোখে পড়বে। জলাধারের ডানদিকের বাহুতে কিছুটা চড়া। তার পর ঘন জঙ্গল। বামদিকের বাহুতেও তাই। পাড়ের দু’দিকে চড়ার পরে গাছপালা, দূরে জঙ্গল, তার পর সবুজময় পাহাড় তালেবেড়াকে অন্য ড্যামগুলোর থেকে কিছুটা আলাদা করেছে। ত্রিভুজের পাদভূমির পিছন দিকেও ঘন জঙ্গল। তালেবেড়ার সঙ্গে কিছুটা মিল রয়েছে বুরুডির। চারপাশে জঙ্গলের বিচারে। আর কংক্রিটের নির্মাণের বিচারে। তালেবেড়ার পাদভূমির দিকে কংক্রিটের সব নির্মাণ। ধাপে ধাপে নেমে যাওয়া ঘাট। বসার জায়গা। এক জায়গায় ওয়াচ টাওয়ারের মতো অল্প ছাউনি দেওয়া নির্মাণ। ওইটুকুই। বুরুডির সৌন্দর্য আলাদা, তালেবেড়ার অন্যরকম। তবে সব ড্যামে বোল্ডার দিয়ে বাঁধানো পারেও কৃত্রিমতা আছে। তবে এ কথা ঠিক, বোল্ডার আর সিমেন্টের মধ্যে বোল্ডার বেশি প্রাকৃতিক। তালেবেড়ার পার কংক্রিটের বাঁধানো।
তালেবেড়া বুরুডির থেকে অনেক বেশি নির্জন। বুরুডিতে বহু লোকের যাতায়াত। ফলে বহু দোকানপাট গজিয়ে উঠেছে। ছুটিছাটার দিনে প্রচুর লোক। তালেবেড়ায় পিননিক হয়। তার প্রমাণ মিলবে চারপাশে। তবে স্থায়ী কিছু বেসাতি নেই। তালেবেড়ায় সিমেন্টের বেঞ্চে যদি চুপ করে বসে থাকলে জলের শব্দ শোনা যায়। হাওয়ায় ড্যামের জলে হিল্লোল। সেই হিল্লোল বাঁধানো পারে এসে ধাক্কা খাচ্ছে। একটার পর একটা। অবিরাম। আওয়াজ উঠছে, ছলাৎ, ছলাৎ। কিছুক্ষণ ধরে শুনলে মনে হবে, অন্যরকম আওয়াজে জল ভাঙছে বাঁধানো পাড়ে। সেই আওয়াজের বানান জানি না।
এমন একটা নির্জন, সুন্দর জায়গায় ছবি-সেশন না করলে চলে! ইন্দ্রর আনা ক্যামেরার তেপায়া খাটানো হল। তার পর ছবি আর ছবি। কতরকম তার অ্যাঙ্গেল। একক, জোড়া, দলবেঁধে। দীপু-বাবলা এমন একটা পোজ দিল যেন মনে হল…। ইন্দ্র ওর রোদচশমাটা পরে ফেলেছে। আমার মনে হল ‘রং দে বসন্তী’র সেই দলবেঁধে বসে থাকার দৃশ্যটার অনুকরণ করা যেতে পারে। ওরা রাজি হল। ছবি তোলার সময়ে আমাদের গাড়ির সারথি শিবুকে খুঁজে পাওয়া গেল না। সে কোন জঙ্গলে ঢুকে ফোন করতে ব্যস্ত। এই সফরে যে দৃশ্য বারবার দেখা গিয়েছে।
ছবিটবি তুলে নেমে গেলাম জলাধারের বুকে। না, সিমেন্টের রেলিং ঘেরা সিঁড়ি দিয়ে নয়। সেই রেলিংয়ে বড় জাহির করার রং, নীল-সাদা। যেদিক দিয়ে ঢুকেছি সেই শুরুর দিকে খানিকটা চড়া। নামা যায়। পাড়ে বনকলমির ফুল ফুটে আছে। ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে মার্বেল পাথরের বড় বড় চাঁই। আবার ছবি তোলা শুরু। এবার শিবুকে দেখতে পাওয়া গেল। ওকেও ডেকে নেওয়া হল। তখনই চোখে পড়ল পাড়ে একটা নৌকো। তার মানে এখানে পর্যটকদের ঢল নামে। নির্জনতা ভাঙে তালেবেড়ার।
নৌকার গায়ে লেখা, ‘বাহুবলী জংলি তুফান এক্সপ্রেস’। বিশেষণের বাড়বাড়ন্ত একেবারে। চারটে শব্দ নিয়ে একটু চিন্তা করলুম। আমাদের মধ্যে জংলি কেউ নেই। আর সব ক’টাই লেটুস। ফলে তুফান তোলা বা এক্সপ্রেসের গতি আশা করা অন্যায়। মিল শুধু বাহুবলীতে। সে তো আমাদের ইন্দ্র। শুরু হয়ে গেল ওর পা টানাটানি, ‘‘ইন্দ্র, তোর নামে নৌকা যে রে! তালেবেড়ায় এসে বুঝতে পারলুম তুই কত তালেবড়…!’’
ছবি— ইন্দ্র, দীপু।
(সমাপ্ত)