ময়ূখ নস্কর
এতদিনে সে নদী নিশ্চয়ই সাদা চাদর শরীরে জড়িয়ে নিয়েছে। এতদিনে তার শরীর জুড়ে কুয়াশার সফেদ শাড়ি। উত্তুরে হাওয়ায় সে কেঁপে কেঁপে ওঠে প্রপিতামহীর মতো। বৃদ্ধা মুণ্ডেশ্বরী। একাকী মুণ্ডেশ্বরী।
অথচ কয়েক মাস আগেই সে ছিল পূর্ণ যৌবনা। কয়েক মাস আগেই বেহায়া মেঘগুলো তাকে চুমু খাবে বলে দিগন্তের উপরে ঝুঁকে পড়েছিল। মেঘের নিঃশ্বাস গায়ে মেখে ফুলে ফুলে উঠছিল, দুলে দুলে উঠছিল তার বুক। সেদিন সকালে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম কুলিয়ার সাঁকোর উপরে। সেদিন সেখানে মহরমের শোকযাত্রা বেরিয়েছিল।
আমি আর আমার বন্ধু সোমক রায়। আমাদের গৃহলক্ষ্মীরা নিজ নিজ পিত্রালয়ে গমন করেছিলেন। ভরা বাদর, মাহ ভাদর, তার ওপরে মন্দির শূন্য দেখে আমরা হাওড়া স্টেশনে ছুটেছিলাম। এই স্টেশনটার সারা গায়ে কেমন যেন একটা ‘বেড়াতে যাই, বেড়াতে যাই’ গন্ধ মাখা আছে। যেন এখানকার সব ট্রেনই তেপান্তর পেরিয়ে যাবে। পৌঁছে যাবে ছেলেবেলার দেশে।
ছেলেবেলায় বাগদাদ যাওয়ার শখ ছিল। হারুন-অল-রশিদের সঙ্গে দেখা করার শখ ছিল। সেই শখ মেটেনি। তাই ভাবলাম, বাগনানেই যাওয়া যাক। কোথায় যেন পড়েছিলাম, ফেসবুকেই সম্ভবত, বাগনান থেকে নৌকায় ভাটোরা একটা নামে দ্বীপে যাওয়া যায়। সেখানে একটা খুব বড় বাঁশের সাঁকো আছে। বাগনান যেতে অসুবিধা হল না। পাঁশকুড়া লোকালে ঘণ্টাখানেক লাগল। সেখান থেকে ট্রেকারে চেপে বাকসি। ট্রেকার নেমে কয়েক পা গিয়েই দেখি…।
দেখি, হাট বসেছে রবিবারে, বাকসিগঞ্জে…। এই রে মুশকিল হল। কোন নদীর নাম বলব? নদী তো একটা নয়, দু’টো। রূপনারায়ণ আর মুণ্ডেশ্বরী। তাদের সঙ্গে আবার দামোদরের একটা খাল এসে মিশেছে। ঠিকঠাক বললে তিনটে নদী। বেলা সাড়ে ১০টা-১১টা হবে। হাটুরে ভিড়। ঠেলাঠেলি গোঁতাগুঁতি। বর্ষার সময়। গাছের চারা দেদার বিকোচ্ছে। হাঁড়ি-কলসি, মাছ ধরার মগরি, শাক-সবজি তো আছেই! হাটের পাশেই বটগাছতলায় খেয়াঘাট। দু’টো নৌকা। একটা যাবে দুধকোমরা। আর একটা ভাটোরা। আমরা দ্বিতীয়টাতেই উঠলাম। কারণ দুধকোমরার থেকে ভাটোরার দূরত্ব অনেক বেশি।
দুর্গাপুজো আসি আসি করছে। নদীর দুই পাশে কাশের জঙ্গল। এখনও ফুল ধরেনি, কেবল শিষগুলি সামান্য স্ফীত হয়েছে। খেজুর গাছের পাতাগুলি ঝুঁকে পড়ে জলকে প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে। সেই জলের গা ঘেঁষে উলুর বন, বাঁশের ঝাড়, বটের ঝুরি। তার ফাঁকে ফাঁকে, মাঝে মাঝে গ্রামের ঘাট দেখা যাচ্ছে। রূপনারায়ণের একদিকে পশ্চিম মেদিনীপুর, একদিকে হাওড়া। একবার ডানতীরে একবার বামতীরে, দুই জেলার কাদামাটি নিয়ে খেলতে খেলতে ভাটোরা পৌঁছাতে নৌকার সময় লাগল প্রায় দেড় ঘণ্টা।
একদিকে রূপনারায়ণ, একদিকে মুণ্ডেশ্বরী। দু’জনে ভাটোরাকে ভূখণ্ডকে ঘিরে ধরে দ্বীপের আকার দিয়েছে। ভাটোরা ঘাট থেকে টোটো চেপে মুণ্ডেশ্বরীর কাছে যখন পৌঁছলাম তখন বেলা দুপুর গড়িয়েছে। সারাদিন ধৈর্য ধরে ধরে সকালের সেই বেহায়া মেঘগুলো আর সংযম বজায় রাখতে পারছে না। পৃথিবীর ঠোঁটে ঠোঁট প্রায় মিশিয়ে দিয়েছে।
মুণ্ডেশ্বরীর তীরে এই জায়গাটার নাম কুলিয়া। এর উপরে বাঁশের তৈরি একটা সাঁকো। সাঁকো না বলে সেতু বলাই উচিত, কারণ তার উপর দিয়ে গাড়ি চলে যায়, মহরমের মিছিল যায়। মহরমের কথা বললাম, কারণ সেদিন মেঘের মন্দ্রের সাথে ‘হায় হাসান, হায় হোসেন’ ধ্বনি মিশে গেছিল। সাঁকোর উপর দিয়ে চলছিল, প্রাক-মহরম মিছিল। সেই মিছিল শেষ হতে না হতেই আকাশ জুড়ে বেজে উঠেছিল কাড়ানাকাড়া। আকাশ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুণ্ডেশ্বরীর বুকে। আকাশের জল নিয়ে মুণ্ডেশ্বরী ছুটেছিল রূপনারায়ণের দিকে।
আর আমরা দু’জন ছুটেছিলাম সাঁকো পার হয়ে বাকসির ট্রেকার ধরতে। এতক্ষণে হয়তো বৃষ্টির জলে ফেঁপে উঠে রূপনারায়ণ আর মুণ্ডেশ্বরী এ ওর গায়ে উঠে পড়েছে। ‘জোরসে চালাও ড্রাইভার, ওদের ঢলাঢলির দৃশ্য মিস হয়ে না যায়’!
ছবি- লেখক
(সমাপ্ত)