ফারুক আব্দুল্লাহ
মাছ মুর্শিদাবাদবাসীর প্রিয় আমিষ হলেও নিজামত পরিবারের রসুইখানায় মাছের তেমন যাতায়াত ছিল না বললেই চলে। তবে নিজামত পরিবারে মাছ একেবারে অচ্ছুৎও ছিল না। আঞ্চলিকতার প্রভাবে নবাবদেরও মাঝে মাঝে মাছ খেতে ইচ্ছে করত। ফলে নবাবি হেঁশেলের মাছ প্রবেশ করত। তবে সেখানেও শর্ত ছিল। শুধুমাত্র আঁশওয়ালা মাছই নবাবি রসুইখানায় প্রবেশাধিকার লাভ করেছিল। নবাবি রসুইখানায় বাবুর্চিরা মাছ রান্না করত বাঙালিদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক রন্ধন পদ্ধতিতে। বাবুর্চিরা সাধারণত ইলিশ, রুই ও কাতলা মাছের রেজালা, কোর্মা, কালিয়া, দমপওক্ত রান্না করতেন নবাবের ফরমায়েশ মতও।
তবে মাছের নানান পদ নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে গিয়ে একদিন শাহি রসুইখানার কোনও এক বাবুর্চি তৈরি করে ফেলেন মাছ দিয়ে এক ধরনের পোলাও। যেহেতু মাছ দিয়ে তৈরি পোলাও তাই নাম দেওয়া হয়েছিল মাহি পোলাও। সেই নতুন পোলাও নবাবের মুখেও ধরেছিল। পরবর্তী সময়ে এই মাহি পোলাও শুধুমাত্র নবাবের শাহি রসুইখানার অন্দরেই বন্দি থাকেনি ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো নিজামত পরিবারেই।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি দেবব্রতদা ও নিবেদিতাদির সঙ্গে আমি, বিশ্ব ও নিজামত পরিবারের নাফিসুন নিসা বেগম (নাফিসা) বেরিয়েছিলাম দেবব্রতদার জন্মদিন উপলক্ষে। প্রথম থেকেই ঠিক ছিল আমরা যাব মুর্শিদাবাদ শহরের একটি নতুন রেস্তোরাঁয়। শুনেছিলাম, সেখানে নাকি মুর্শিদাবাদের বহু নবাবি পদ পাওয়া যায়। সেখানে ঢুকতে গিয়েও সেই আভাস কিছুটা পাওয়া গেল। রেস্তোরাঁর উচ্চপদস্থ কর্মীরা সব শেরওয়ানি পরে আছেন। তাঁদের পোশাক ও মাথার টুপিতে নবাবি লোগো। রেস্তোরাঁর ঘরগুলিও বেশ মনোরম এবং সাজানো গোছানো। রয়েছে বেশ কিছু নবাবের বাঁধানো ছবি। আমরা ভেতরে প্রবেশ করতেই বলা হল দোতলায় গিয়ে বসতে। দোতলার ঘরও বেশ সুন্দর। সব কিছু বেশ ভালই চলছিল। ওয়েটার এসে আমাদের হাতে মেনু বুক ধরিয়ে দিলেন।
নিবেদিতাদি ও নাফিসাকে মেনু ঠিক করতে দেওয়া হল। মুর্শিদাবাদের নিজামত পরিবারের মেয়ে নাফিসাকে বলা হল সেই খাবারই যেন অর্ডার করা হয় যা মুর্শিদাবাদের নবাবরা খেতেন। কিন্ত এত বড় মেনু বই হাতড়ে নবাবি পদ তেমন পাওয়া গেল না। অনেক খুঁজে পাওয়া গেল মাহি বিরিয়ানির খোঁজ। তবুও আমরা কিছুটা আশ্বস্ত হলাম এটা ভেবে যে, অন্তত একটি নবাবি পদ তো পাওয়া গেল। এই অনেক। অর্ডারও দেওয়া হল মাহি বিরিয়ানি। সেই ফাঁকে আমাদের শুরু হল সেলফি ও গ্রুপ ফোটো তোলার পাগলামি। এর মধ্যেই এসে গিয়েছে আমাদের মাহি বিরিয়ানি। কিন্ত মেনু বুকে মাহি বিরিয়ানি দেখে আমি খুব অবাক হলাম এই ভেবে যে, নবাবি আমলের শাহি মাহি পোলাও কী ভাবে মাহি বিরিয়ানিতে পরিণত হয়ে গেল? একথা নাফিসাকে জানাতেই নাফিসা একগাল হেসে উত্তর দেয় ‘ইঁহা সব মুমকিন হ্যায়। আসলি মাহি পোলাও তো স্রিফ নিজামত ফ্যামিলি মে হি বানতি হে। আগর কিসি কো খানা হ্যায় তো ওহি যানা পাড়েগা’। মাহি বিরিয়ানি এসে গেলেও দেবব্রতদা এবং বিশ্ব ছবি-ভিডিও তুলতে ব্যাস্ত। অন্যদিকে নিবেদিতাদি মন দিয়ে মাহি বিরিয়ানি নিরীক্ষণ করতে শুরু করেছে। দিদি নিজেও একজন ভাল রাঁধুনি। নিজেও বহু রান্নার পদের উদ্ভাবক। ইউটিউবে দিদির নিজের রান্নার চ্যানেলও রয়েছে।
এবার ওয়েটার আমাদের প্লেটে সার্ভ করে দিলেন মাহি বিরিয়ানি। দেখেই আমার কেমন খটকা লাগল। নাফিসা দেখি মুচকি হাসছে। কারণ সে নিজে নবাব পরিবারের মেয়ে। তার আসল মাহি পোলাও খাওয়ার ও রান্নার অভিজ্ঞতা রয়েছে। মাহি বিরিয়ানি প্লেটে রাখতেই নিবেদিতাদি বলে উঠল, ‘‘এ যে সবই ভাত। মাছ কই?’’ ওয়েটারকে দিদি আদেশ দিল বিরিয়ানির ভাতের ভেতর থেকে মাছ উদ্ধার করে আনতে। কারণ ইতিমধ্যেই দেবব্রতদা ভিডিও করতে শুরু করেছে।
সব কিছু শেষ করে শুরু হল খাওয়া। আমি তো চামচ পাশে সরিয়ে রেখে হাত লাগালাম। সবার আগে নিবেদিতাদি এক চামচ মাহি বিরিয়ানি মুখে দিতেই হতাশ হল। বলল ‘এতো সাধারণ বিরিয়ানির মতই খেতে শুধু মাংসের বদলে মাছ’। দিদির মতো সবাই একই কথা বলে উঠলাম আমরা। এবার বিরিয়ানির সঙ্গে দেওয়া এক খণ্ড মাছ চেখে দেখার পালা আমাদের। মাছ ভেঙে মুখে দিতেই আমরা সমস্বরে আঁতকে উঠলাম। একি মাছে কাঁটা কেন? নাফিসা সব দেখেও এতক্ষণ বেশ শান্তই ছিল। কিন্ত এবার সে যথেষ্ট বিরক্ত হয়ে বলল ‘‘মাছলি পে কাঁটা কিঁউ? মাহি পোলাও কি মাছলি মে তো কাঁটা নেহি রহতা।’’ এদিকে মাছের পিস রান্নাও ভাল হয়নি। ভেতরে কোনও মশলা প্রবেশ করেনি। এমনকি লবণও না। এসব দেখে নাফিসা ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করে বসল, ‘মাছলি পে কাঁটা কিউ ভাই? ইয়ে তো নবাবি বিরিয়ানি নেহি বানা। আউর মাহি পুলাও হোতে থে নবাবি দৌর মে, মাহি বিরিয়ানি নেহি’। এসব শুনে ওয়েটার বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে জবাব দিল ‘দিদি সবে তো নতুন হয়েছে, ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।’’ আমরা একথা শুনে হেসে উঠলাম। এবং মাহি বিরিয়ানি বেশ বিতৃষ্ণা নিয়ে খেলাম।
এত বিরক্তিতেও আমাদের মন আনন্দে ভরে উঠল। কারণ নাফিসা আমাদের কথা দিল সে আমাদের অতি শীঘ্রই নিজে হাতে মুর্শিদাবাদি শাহি বিরিয়ানি রেঁধে খাওয়াবে। তা-ও আবার কেল্লা নিজামতের ভেতরে তার বাড়িতেই।
(সমাপ্ত)
বিধিসম্মত সতর্কীকরণ: এখন কোনও ভাবেই মাহি বিরিয়ানির দিকে লোভ দেবেন না। এখন ঘরে থাকার কাল। মন দিয়ে পড়াশোনার কাল। তালিকা তৈরির কাল। অতিমারী কাটিয়ে উঠে আমরা কোথায় ঘুরতে আর খেতে যাব তার তালিকা। ঘরের বাইরে বেরোবেন না। ঘরে বসে সুদিনের স্বপ্ন দেখুন। স্বপ্নে বিরিয়ানি খান।