দীপশেখর দাস
২০১৩ থেকে ২০১৫। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের বিখ্যাত চার কুমার অরিজিৎ (হ্যান্ডসাম), শুভ (কচি), জুয়েল (রত্নকুমার) আর আমি (ডাকনাম কেউ দেয়নি। দিলেও আমায় জানায়নি)। যদিও জুয়েলকে আমি ‘কুমার’ উপাধি দিতে রাজি ছিলুমনি। কিন্তু…রত্নকুমারই রয়ে গেল।
গল্পটা ২০১৭। আমাদের কুমার উপাধি আরও জোরদার হয়েছে। চার জুড়িদারি মিলে ঠিক হল একটা ছোট ট্যুর হবে। ডিসেম্বর মাস। ঠান্ডাটা জাঁকাতে শুরু করেছে। বেড়িয়ে পড়লুম পুরুলিয়ার উদ্দেশ্যে। হাওড়া স্টেশন থেকে চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জারে আদ্রা। সেখান থেকে আসানসোল মেমুতে মুরাডি। গন্তব্য বরন্তি। যদিও এই দুই ট্রেন যাত্রার মধ্যে শীতের আদ্রা স্টেশনের বাহ্যিক রূপ প্রত্যক্ষ করবার বেশ খানিকটা সময় আমরা পেয়েছিলুম। জায়গাটা শহুরে। তবুও স্নিগ্ধ ভোরে সহস্র পাখির কলকল্লোল আমাদের মুগ্ধ করল।
আদ্রা থেকে লোকাল ট্রেন যাত্রাও বেশ মনোরম। ঝড়ের গতিতে ট্রেন ছুটে চলে। ফেলে যায় সবুজ মাঠ, ধূসর প্রান্তর, বেশ কয়েকটি অনুচ্চ পাহাড়, বসতি আর কিছু অজানা ইতিহাস। মাঝে মাঝে চোখে পড়ে বেশ কিছু জীবন দৃশ্য। সে কোনও এক ঘরণীর এক ঝাঁকা কাঠ বা বিচুলি মাথায় চাপিয়ে ঘরে ফেরা হোক বা খেজুর রসের সন্ধানে গাছের ডগায় চড়া মানবের।
মিনিট চল্লিশের ট্রেন যাত্রার পর পৌঁছলাম মুরাডি। স্টেশন চত্বর বেশ জমাটি। স্টেশনে হাত-মুখ ধুয়ে বাইরে বেড়িয়েই অমৃত সন্ধান। বাজারের এক কোণে কচুরি কড়ায় নড়াচড়া করছে। হাওড়া স্টেশনে ট্রেনে চাপা থেকে এ অবধি পেটে চা ছাড়া কিছু যায়নি। রিজার্ভেশন ছিল না। ফলে রাতের ঘুমও বেপাত্তা। খিদের মোচড় সবাই ভালোই বুঝছি। পেটে খেলে সব সয়। পেট সইয়ে এবার ঘরের সন্ধান। না ওটাও রিজার্ভ করা নেই। আমাদের কথায়, এলাকাবাসীর চোখে এক অপার বিস্ময়। তাঁদের ভাবখানা, এ আবার কোত্থেকে সব শহুরে ভূতগুলো এল রে বাবা। হ্যাঁ বাইরে থেকে কেউ গেলে ওঁরা শহুরে বলেই ভাবেন)। কেউ কেউ তো বলেই বসলেন, এখন নেটের যুগ। সব আগে থেকে বুক করে আসতে হয়। আপনারা বোকার মত বুক না করেই চলে এলেন। ওসব ঘর-ফর এখন আর এখানে পাবেন না।
ওঁদের কথায় গুরুত্ব দিলুম না। আমার গুরু কখনও আগেভাগে ঘর বুকিং করে বাইরে বেরোন না। আমিও বেড়োব না। এটাই দস্তুর। বাজার থেকে বেরিয়ে এসে খোঁজখবর শুরু করলুম। দুটো রিকশা নিয়ে গেলুম বরন্তি। ঘর কোথাও খালি নেই। সব হোটেল, রিসর্ট বড় বড় গাড়িতে ভর্তি। সেই বড় বড় গাড়িতে ভরে ভরে বড় বড় লোক এসেছেন। আমাদের মত চুনোপুঁটির কোনও ঠাঁই নেই।
যে রিকশায় বরন্তি গিয়েছিলুম তাতেই আবার মুরাডির পথ ধরলুম। এখন একটাই আলোচ্য, এখানে তো ঠাঁই মিলল না। আমরা যাব কোথায়?
রিকশাচালক দাদারা আমাদের অবস্থা বেশ বুঝলেন। তাঁরা আমদের এক চক্ষু হাসপাতালের সামনে নামালেন। হাসপাতালের উল্টোদিকে একটা বাড়ি দেখিয়ে বললেন, এখানে ঘর ভাড়া দেয়। আপনারা জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। তবে ঘরগুলো ভাল নয়।
যা পেলুম তা চাঁদ হাতে পাবার থেকেও আনন্দের। ছ’জন শুতে পারে এমন একটা ঘর। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন তেমন নয় ঠিকই। কিন্তু আমাদের মতো গ্রাম-শহরতলির ছেলেদের কাছে এটা যথেষ্টই। বাড়ির পিছন দিকে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। তার এক প্রান্তে শৌচাগার আর একটা গভীর পাতকুয়ো। ঘর ভাড়াও বাজেটের মধ্যে।
রিকশাচালক দাদাদের অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে নগদ বিদায় করলুম। এবার ঘোরার সুলুক সন্ধান শুরু হল। যেখানটায় আমরা রয়ে গেলুম সেখান থেকে বরন্তি বেশ খানিকটা দূরে। হেঁটে ঘুরতে গেলে অনেক সময় লাগবে। অতএব চরকিপাকের উপায় খোঁজা।
গ্রাম্য এলাকা। মাথায় বুদ্ধি এল যদি খান দুয়েক সাইকেল পাওয়া যায় তাহলেই কেল্লাফতে। খরচও বাঁচবে আর যেমন খুশি ইচ্ছা এলাকা টহল দেওয়া যাবে। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। বাড়ির মালিককে ডাক দিলুম। তিনি নেতিবাচক হাত তুললেন। আমরাও ছাড়ার পাত্র নই। এলাকায় খোঁজ শুরু করলুম। মুরাডি স্টেশনের কাছে একজন নিত্যযাত্রীদের সাইকেল জমা রাখেন। তিনি ভাড়া দিতে রাজি। চারখানা সাইকেল দিতেই রাজি। কিন্তু সমস্যা হল সেদিন দিতে পারবেন না। আগামীকাল দেবেন। আলোচনায় ঠিক করলুম কিছু না হওয়ার থেকে একদিন সফর হওয়াও ভাল। তাই আগামীদিনের জন্য চার খানা সাইকেল নেওয়ার কথা জানিয়ে বিদায় নিলুম।
আগামিকালের বন্দোবস্ত তো হল। আজ কি হবে! ঘরের কাছে ফিরে চায়ের দোকানে আমাদের আলোচনা চলছিল। বাড়ির মালিকও ছিলেন। তিনি বললেন, আজ আপনারা গড় পঞ্চকোট-জয়চণ্ডী পাহাড় চলে যান না কেন। একটা গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে ঘুরে আসুন। আমরা প্রস্তাব লুফে নিলুম। গাড়িও পাওয়া গেল। গাড়ি যখন হল তখন অল্পেতে খুশি হব কী! খোঁজ শুরু হল আর কোথায় কোথায় ঢুঁ মেরে আসা যায়। ড্রাইভার দাদাকে ধরলাম। দাদা বললেন, আপনারা যদি বলেন তো মাইথন পর্যন্ত ঘুরিয়ে আনতে পারি। বরন্তি ঘুরতে এসে যদি উপরি পাওনা মাইথন-পাঞ্চেত হয় তবে আর তাতে কার না থাকে। আমাদেরও ছিল না। ছুটলুম সাঁই সাঁই।
জয়চণ্ডী পাহাড় আর গড় পঞ্চকোট সৌন্দর্য আজ ইন্টারনেটের কল্যাণে সবার জানা। মাইথন আর পাঞ্চেতও। সেই সৌন্দর্যের রূপ আহরণ আমরাও করেছিলুম। শেষবেলায় মাইথনে নৌকা চেপে জলবিহারে মেতেছিলুম। দিনের সমস্ত ক্লান্তি এক নিমেষে দূর হয়েছিল। রথ দেখতে এসে কলা বেচা ভালোই হল। এক রাশ মানসিক প্রশান্তি নিয়ে ফিরে এলুম মুরাডি। এবার বেশ খানিকটা বিশ্রাম দরকার। আগামিকালই যে আসল রথ দেখা।
কভারের ছবি মাইথনের।
বিধিসম্মত সতর্কীকরণ: নোভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে এখন লকডাউন চলছে। ফলে কোনও সফর নয়।
(চলবে)