দেবাশিস দাস
উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জ। পাহাড়ি এলাকায় এক যাযাবর ব্যাধ জাতির বাস। দলপতির নাম গোবর্ধন। একদিন খাবারের সন্ধানে দলপতির নির্দেশে সমর্থ পুরুষরা বেড়িয়ে পড়ল মৃগয়ায়। বহু স্থানে প্রচুর শিকারের পর সেই দল এসে উপস্থিত হল বর্তমান ভগবানপুরের সুজামুঠা নামের একটা জায়গায়। তখন সুজামুঠা জংলা একটা জায়গা। চারিদিকে জঙ্গল আর সেখানে নানা পশুপাখির বাস। দলপতি সামনে এক জলাশয়ের ধারে বসে থাকতে দেখলেন এক বক তপস্বীকে। পোষা বাজপাখিটিকে ছেড়ে দেওয়া হল বকটিকে শিকারের জন্য। বাজপাখিটি গেল কিন্তু আর ফিরে এল না। খাদ্যের খোঁজে গিয়ে খাদক বাজটিই বকের খাদ্যে পরিণত হল।
প্রকৃতির নিয়ম বিরুদ্ধ খাদ্য-খাদক সম্পর্কের উল্টো ঘটনা ভাবিয়ে তুলল দলপতিকে। সেদিন রাতে তাঁর স্বপ্নে দেখা দিলেন দেবী কালী। দলপতি জানলেন এই পুণ্যভূমিতে দেবী কালীর জাগ্রত অধিষ্ঠান। স্বপ্নাদেশ অনুসরণ করে তিনি শিলা নির্মিত এক কালীমূর্তি খুঁজে পেলেন। প্রতিষ্ঠা করলেন কালীর গড়। পরে যা লোকমুখে হয়ে গেল কাজলাগড়ে।
আমি কোনও স্বপ্ননির্দেশ পাইনি। কিন্তু এক শীতের দুপুরে জমিয়ে ঘুমের পরে বিকেলে একটু ঘোরার ইচ্ছে হল। জেগে উঠে মনে হল, ‘ঘরের কাছে অজানা যত/জানতে হবে নিজের মতো’। চাকরি সূত্রে আমার পূর্ব মেদিনীপুরে আসা। সাময়িক বাস মুগবেড়িয়ায়। মেসশাবক আমি। মেসে বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকদের আস্তানা। আমার সহকর্মীও থাকেন। তাঁদের কয়েকজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। ঘরের কাছের অজানাকে জানতে তাঁদের তিনজনকে সঙ্গী করে নিলাম। ঘুরতে যাওয়ার উদ্যোগটা আমার। কিন্তু জায়গা বেছেছিল পিন্টু গিরি।
পায়ের তলায় সর্ষে নয় বরং নিজের দু’চাকার অশ্বশক্তিতে বলীয়ান যানকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বর্তমানের থেকে অতীত আমাকে বেশি টানে। অতীতকে জানার উদগ্র বাসনা ছুটিয়ে নিয়ে যায় নতুন অচেনার কাছে। অতীত ইতিহাস কখনও কাঁদায় আবার কখনও বা অবাক বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের সামনে। সম্পর্কের ইতিহাস সাক্ষী থাকুক স্মৃতিতে। আর বহমান অতীতের ছোঁয়ায় প্রাণে লাগুক ইতিহাসের স্পর্শ। সেই উদ্দেশ্যেই বেড়িয়ে পড়া কাজলাগড়ের দিকে। যা সুজামুঠা রাজবাড়ি নামেই পরিচিত। ঠিক রাজবাড়ি নয়। সামন্ত রাজা বা জমিদারই ছিলেন সুজামুঠার ভূস্বামী। তাই জমিদার বাড়ি বলাই ভাল একে। এর প্রতিষ্ঠাতা গোবর্ধন রঞ্ঝাপ। যাঁর কথা প্রথমেই বলেছি। তিনি লবণের ব্যবসায় প্রচুর লাভ করে এখানেই থেকে যান। গড়ে তোলেন জমিদারি। রাজবংশের উপাধি ছিল চৌধুরী। তখনকার দিনে প্রভুভক্তির বিনিময়ে এরকম নানা উপাধি মিলত। গান্ধীজির আইন অমান্য আন্দোলনের সময়ে পূর্ব মেদিনীপুরের লবণ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা লবণ সত্যাগ্রহ করেছিলেন।
রাজবাড়িটি তৈরি হয়েছিল অষ্টাদশ শতকে মহেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর আমলে। যিনি সুজামুঠা রাজপরিবারের অধস্তন নবম পুরুষ ছিলেন। কাজলাগড়ের রাজবাড়ির সঙ্গে তৈরি হয় গোপাল জিউয়ের নবরত্ন মন্দির। মাধাখালি থেকে গুগল বাবার সাহায্যে রওনা দিয়েছিলাম চার বন্ধু তথা সহকর্মী মিলে। পিন্টু, প্রকাশ, রাকেশ আর আমি। মাঝে গুগল বাবা পথভ্রষ্ট হলে লোকমুখে রাস্তা খুঁজে পৌঁছে গেলাম সুজামুঠার রাজবাড়িতে।
সন্ধ্যে তখন হব হব। সূর্য পশ্চিম দিকে একটু লাল রেখা ছড়িয়ে দিগন্তের ভালে বিশ্রামরত। সেই আলোয় কাজলাগড়কে দেখলে মনে হয় ভূতের বাড়ি। ছাদের দেখা নেই কোথাও। রাজবাড়ির দেওয়াল ভেঙে পড়েছে এখানে সেখানে। বট অশ্বত্থের ঝুড়ি নেমে গ্রাস করেছে সবটুকু। যেন বিশাল এক অজগর জড়িয়ে ধরেছে আষ্টেপৃষ্টে। রাজবাড়ি কিন্তু চিরকাল চৌধুরী বংশের অধীনে ছিল না। বংশের এক উত্তরপুরুষ গোলকেন্দ্র নারায়ণ ছিলেন খুবই উচ্ছৃঙ্খল। পঞ্চ ম-কারের আকর্ষণে তিনি বহু সম্পদ নষ্ট করেন বাগানবাড়ি প্রতিষ্ঠায়। ‘চালাও পানসি বেলঘরিয়া’ বলে একটি প্রবাদ কলকেতার বাবু কালচারে বেশ প্রসিদ্ধ ছিল। হঠাৎ হওয়া বড়লোকেরা বরানগর, বেলঘরিয়া ইত্যাদি স্থানে বহু বাগানবাড়ি তৈরি করেছিলেন উনিশ শতকে। তাঁরা সেখানে যেতেন বাঈজি নাচ দেখতে এবং মদ্যপান করতে। তাই গোলকেন্দ্রের এই শখ খুবই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু এই খরচ মেটাতে গিয়ে রাজবাড়ি দেউলিয়া হয়। এবং হাতবদলের মাধ্যমে তা চলে যায় বর্ধমানের রানি নারায়ণ কুমারীর হাতে।
কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বহু কবিতায় এই কাজলাগড়ের উল্লেখ আছে। কাজলাগড়ের বকুল গাছের অনুষঙ্গও এসেছে তাঁর লেখায়। কবির স্ত্রী সারাদিন কবির অপেক্ষায় সামনের বকুল গাছের বকুল ফুল দিয়ে মালা বাঁধেন এবং কবির আগমনে বিরহ সমাপ্ত হলে মালাটি পরিয়ে দেন কবির গলায়। ‘শাজাহান’ নাটকের বিখ্যাত গানে কবি তাই লিখেছিলেন ‘আমি সারা সকালটি বসে বসে এই সাধের মালাটি গেঁথেছি’। দ্বিজেন্দ্রলাল কর্মসূত্রে সুজামুঠায় এসেছিলেন। এখানকার সেটেলমেন্ট অফিসার ছিলেন। এই এলাকায় মুঠা দিয়ে অনেকগুলো জায়গার নাম আছে। মাজনামুঠা, জলামুঠা। নামের উৎস আমার জানা নেই।
বর্তমানে রাজবাড়ি ভগ্নস্তুপে পরিণত। রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা গোবর্ধনের আমলে তৈরি হয়েছিল শিব ও কালীর মন্দির। তা থেকেই এর নাম হয় কালীগড়। আর তা থেকে লোকমুখে হয়ে ওঠে কাজলাগড়। শিব ও কালী মন্দির দু’টি আর নেই। এখানে একটি গর্ভগৃহ আছে। আর গর্ভগৃহের চারপাশে রয়েছে ত্রিখিলান পথযুক্ত অলিন্দ আর প্রবেশপথ। রাজবাড়ির ছাদহীন অট্টালিকা।
অতীত গর্বের ইতিহাস জড়িয়ে একাকী দাঁড়িয়ে আছে।
(সমাপ্ত)