শ্রেয়সী সেনশর্মা
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০
‘আরে ম্যাডামজি ৬০০ রুপিয়া’। হাওড়ায় দাঁড়িয়ে হতভম্ব আমি। কাঁধে একটি নীল রঙের ট্রেক ব্যাগ, আর বাবার পুরোনো ট্রলি হাতে, যাতে এ কে সেনশর্মা লেখা। ওই ৬০০ টাকাকে ১৫০ করেছি। বচন হাওড়া স্টেশনে কুলি কাকার। মহিলাদের দর কষাকষির অসাধারণ ক্ষমতা থাকে। ওই মুহূর্তে নিজেকে মনে হচ্ছিল সুন্দর দিদা। সুন্দর দিদার বয়স ৯৬ বছর। বিয়ে করেননি। শয্যাশায়ী। কিন্তু কই মাছ না দিলে ছোট ঠাকুমার সঙ্গে দর কষাকষি ঝগড়া বাধান বুড়ি। সম্পর্কে বাবার পিসি। বিখ্যাত লেটুস পূর্বায় আমার টিকিট। এবার দেরাদুন আর লখনউ গন্তব্য। দেরাদুনে থাকব ২৯ অব্দি। লিপইয়ারের অতিরিক্ত দিনে রাতে দুন এক্সপ্রেসে লখনৌ যাওয়ার কথা। পরের কথা পরে।
আপাতত পূর্বার গল্প বলি। হাতে শরদিন্দুর ঐতিহাসিক গপ্প। ‘কালের মন্দিরা’ বাজছে মগ্ন মনে। পুরুলিয়া এই বসন্তে বড় রুক্ষ। এই করে দুপুর বেলা ট্রেন বিহারে ঢুকল। এইখানেই শুরু হলো ঝুপঝাপ। বিহার আসা মানেই নিজের সিট ছেড়ে দিতে হবে। এক মহিলা উঠলেন। সামনের সিটে বসলেন। গল্প জুড়লাম। ভাষাটা দেহাতি। ছেলে রেলে চাকরি করেন। উনি যাচ্ছেন দাঁতের ডাক্তারের কাছে। নাম দৌলতা দেবী। নিবাস রাজাকুইন্যা গ্রাম। তিনি শুরু করলেন তারাদেবী আর রুকমনের কাহিনী। লোককথা নাকি আমি জানি না। কিন্তু গুগলে সব আছে। ভক্তিমতী সরল মহিলা, জীবনযাপন ও সাধারণ। ১০ বছর বয়সে বিয়ে। তার পর আর ‘মায়কে’ ফেরেননি। ভারী ভাল। বক্তিয়ারপুরে নেমে গেলেন। তার পর শুরু হল উৎপাত। বিহার পেরোলে উৎপাত কমে গেল।
১৯ ফেব্রুয়ারি
দিল্লি ঢুকতে ঢুকতে সকাল ১১টা। পাঁচ ঘণ্টা লেট। পুরো দিল্লি স্টেশনে এসকেলেটর। বড় সুন্দর। অটোর দর এখানেও ২৫০। কমাল না। ইন্টার স্টেট বাস টার্মিনাস (আইএসবিটি) যাব। সেখান থেকে দেরাদুনের বাস ১২টায়। মুগ্ধতা একরাশ লালকেল্লা, রাজঘাট দেখে। অটোওয়ালা ওই পাঁচতলা বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। টার্মিনাল ১২ থেকে দেরাদুনের বাস ছাড়ে। পৌঁছোয় বিকেল ৬টা। অনলাইনে সহজেই বুক করা যায়। আইএসবিটি বাসস্ট্যান্ডে অসংখ্য বইওয়ালা ঘুরে বেরান, হাফ দামে পাওলো কোহেলো পেলাম। দিল্লির চায়ের বেশ স্বাদ। বাঙালিদের খিটমিটে কালো চা নয়, ঘন দুধ দেওয়া। এসি বাস, ভাড়া ৪০০ টাকা। বাস দিল্লি পেরিয়ে কানপুর, রুরকি ছাড়িয়ে দেরাদুন যাবে। লালমাটি উড়িয়ে, কত শত ধুলো মাখা পথ পেরিয়ে চলছে। দেরাদুন ঢুকতে বেলা ৪টে। পাহাড় শুরু হল। আমার পাশে একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা বসেছিলেন। দেখা করতে যাচ্ছিলেন ওর একমাত্র মেয়ের সঙ্গে। মেয়ের দেরাদুনে পোস্টিং। বিকেল ৫টার মধ্যে বাস দেরাদুনে পৌঁছল। আমার মালপত্র নামাতে অসুবিধা হচ্ছিল। ওই ভদ্রলোক মালপত্র নামিয়ে আমাকে অটোতে তুলে দেন। ২০০-৩০০ টাকার দর কষাকষির পর অবশেষে অটো যেতে রাজি হল। আমার গন্তব্য ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট, কলাগড় রোড।
পাক্কা দু’দিনের পর অবশেষে নরম বিছানায় মাথা এলিয়ে দিলাম। আশেপাশে কোনও হোটেল না থাকায় আমাদের অফিসের দারোয়ান কাকু তাঁর বাড়িতে খাবার জন্য তিন বেলা ব্যবস্থা করলেন। আমি যে ক’দিন তাঁর বাড়িতে খেয়েছি একটা পয়সাও নেননি। এরকম মানুষ গাঙ্গেয় দেশে পাওয়া মহা মুশকিল। দুর্লভ প্রায় বলতে গেলে। বোটানিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার ক্যাম্পাস গাছে ভরা আলো ছায়ায় ঢাকা এবং বাইরের জগৎ থেকে বড় আলাদা। সমস্ত সার্ভে অব ইন্ডিয়ার উত্তর ভারতের অফিস এখানে অবস্থিত। দারোয়ান কাকুর মেয়ের নাম সুরভি। সে ছিল আমার দেরাদুন বাসের এবং ঘুরে বেড়ানো অন্যতম সঙ্গিনী।
২০ ফেব্রুয়ারি
পরেরদিন অফিসের কাজকর্ম সেরে আমরা দু’টিতে মিলে চললাম মুসৌরি যাওয়ার পথের ভিউ পয়েন্টে। আমাদের বাহন সুরভির স্কুটি। ক্লক টাওয়ার পেরিয়ে অবশেষে ঝলমলে দোকানপাট পেরিয়ে মুসৌরি যাওয়ার পথে এক শিব মন্দির পরে সেখানে থামলাম। শিব মন্দিরের একটি বৈশিষ্ট্য হল সেখানে কোনও দান বা পয়সা কিছু নেওয়া হয় না। সেখানকার অপূর্ব পায়েস এবং সুজির হালুয়া এবং মোটা দুধের চায়ে মন চনমনিয়ে উঠল। পরের গন্তব্য ম্যাগি পয়েন্ট। দেরাদুনের ভিউ ভাল ভাবে দেখা যায়। ঠান্ডা হাওয়া যেন গায়ে কাঁপুনি দিচ্ছিল।
ম্যাগি পয়েন্টে পৌঁছে দেখতে পেলাম এক অপরূপ দৃশ্য। দেরাদুন মুসৌরির রাস্তায় বাইক বা মোটরসাইকেল জাতীয় যানবাহনে করে যাওয়ার মজাটাই আলাদা। নীচের সাজানো আলোমাখা শহর অসম্ভব এক মায়াবী রূপকথায় ভরিয়ে রেখেছে। ওই মুহূর্তে সন্ধ্যার অন্ধকারে মনে হচ্ছিল যেন কোনও মায়াবী রাজ্যের হাতছানি। এর পরের গন্তব্য তপকেশ্বর শিব মন্দির। মাটির তলায় এই শিব মন্দিরে যখন পৌঁছলাম তখন বেশ ভিড়। পরদিন শিবরাত্রি। সন্ধ্যা থেকেই শিব মন্দিরের সামনে ভিড় জমেছে। নানা রঙের মানুষ হাতে নানা রকমের ফুল বেলপাতা এবং মনোকামনা মনে নিয়ে মন্দিরের উদ্দেশ্যে চলেছেন। রাত বাড়ছে বলে গর্ভগৃহ না দেখেই বিদায় নিলাম। শিব মন্দিরের মেলার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল ভাঙের নানা জিনিসপত্র খোলামেলা বিক্রি। ভাঙের নেশা করতে ভালবাসেন এখানকার বাসিন্দারা।
২১ ফেব্রুয়ারি
আজ শিবরাত্রি। চারিদিকে গমগম করছে শিবের ভজনে। বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ আমরা হৃষিকেশের দিকে রওনা দিলাম। উদ্দেশ্য গঙ্গা আরতি দেখার। শাক ভাত খেয়ে আমরা রওনা দিলাম হৃষিকেশের উদ্দেশ্যে। এবারের যাত্রায় আমাদের চালক ত্রিলোক ভাইয়া। গাড়ি যাচ্ছে ধনৌল্টি পাহাড়ের পাশ দিয়ে, হাতি যাওয়ার করিডর দিয়ে, ঘন জঙ্গল এবং রাজীব গান্ধী স্টেডিয়ামের পাশ দিয়ে। আকাশে তখন সদ্য মেঘের ছোঁয়া। শিবরাত্রির দিন নাকি দেরাদুনে বৃষ্টি হবেই হবে, এমনটা জনশ্রুতি।
তিনটে সাড়ে তিনটে নাগাদ আমরা হৃষিকেশ পৌঁছলাম। লোকাল গাইড নেওয়া হল। তিনি আমাদের নৌকোয় চাপিয়ে ওপারে নিয়ে গেলেন। নৌকোয় নানা দেশের নানা ভাষার লোক। আমাদের গাইড, গীতা ভবন ইত্যাদি নানা ইতিহাস বলছিলেন। একটি মন্দিরে গীতা খোদাই করা। রুদ্রাক্ষ গাছ, ঘাট, শিবমন্দির, বন্যা, হৃষিকেশের অলিগলি, আর শান্তির মন্ত্র উচ্চারণ, এখানেই থেকে যেতে ইচ্ছে করছিল। যাওয়ার সময় রাস্তায় বেশ জ্যাম। অবশেষে ত্রিবেণী ঘাটে আরতি দেখতে গেলাম। বিকেল ৫টা। নানা রাজ্যের মানুষ এবং প্রচুর বিদেশি । আরতির ব্যবস্থা হতে হতেই চোখে পড়ল বিভিন্ন মানুষ এবং তাঁদের মনোকামনা নিয়ে পূর্ণ প্রদীপের ডালি গঙ্গার বুকে তারা ভাসিয়ে দিচ্ছে। প্রদীপের ডালি স্রোতের টানে কোথায় চলেছে কে জানে। দিগন্তে সূর্য ডুবছে এবং ধীরে ধীরে প্রদীপগুলো গঙ্গাবক্ষে এক অদ্ভুত ঘোর লাগিয়েছে। আরতি শুরু হল। গম্ভীর মন্ত্র উচ্চারণের সঙ্গেই প্রথমে ফুল, ধুনো তারপর প্রদীপ। অপরূপ স্বর্গীয় সে দৃশ্য। ওই দৃশ্যের জন্য আমি আজন্ম অপেক্ষা করেছি যেন। পেটে জিলিপি পুরে এবার দেরাদুন মুখো হলাম।
হৃষিকেশের মোড়ে একধরনের ফল দেখতে পেলাম। ফলওয়ালা বলছিলেন, এর নাম রামফল। নামেই বোঝা যাচ্ছে, এর সঙ্গে একটা পুরাণ প্রসঙ্গ জুড়ে আছে। কথিত আছে, রাবণকে হত্যা করায় রামের ব্রহ্মহত্যার পাপ হয়। সেই পাপ নাশ করতে রাম হৃষিকেশ এসে এই ফলটি খান। তখন থেকেই এর নাম রামফল। নতুন ফলের স্বাদ নিলাম। টকটক খেতে। নুন দিয়ে দেয়। খেতে চেনা কোনও টক ফলের মতো নয়। কাঁচা আমও নয় ঠিক। আমড়াও নয়। হালকা মিষ্টির ছোঁয়া। স্বাদটা এদের কারুর মতোই নয়। জিভে দিলে গলে যায়। সুখকর টক। বাংলায় সীতাফল পাওয়া যায়। উত্তরাখণ্ডে পেলাম রামফলকে। সীতা মাইয়া চির দুখী মানুষ। সংসারের সুখ ভোগ তাঁর কপালে নেই। কোথায় পশ্চিমবঙ্গ আর কোথায় উত্তরাখণ্ড। গাছপালা নিয়ে পড়াশোনা। শুধু খেয়ে থেমে গেলে তো চলবে না। ফলে বংশ বিচার শুরু হল। রামফলের বটানিক্যাল নাম Opuntia dilenni। সম্ভবত একমাত্র ভারতে হৃষিকেশে পাওয়া যায়। আদতে এরা উত্তর আমেরিকা আর মেক্সিকোর বাসিন্দা।
২২ ফেব্রুয়ারি
সকালে উঠে আমি আর আমার ড্রাইভার ভাইয়া চললাম ধনৌল্টির পথে। আলু পরোটা খাচ্ছিলাম। এক বাঁদর নিয়ে চলে গেল। মনো কষ্টে গাড়িতে বসলাম। গাড়ি ছুটে চলল ন্যাড়া রুক্ষ পাহাড় পেরিয়ে মুসৌরি হয়ে ধনৌল্টির পথে। ঘননীল আকাশের সঙ্গে গাড়ি চলছে। ক্রমশ ঠান্ডা বাড়ছে। আর বাড়ছে পাঞ্জাবি গানাওয়ালা বাবুর সংখ্যা। ধনৌল্টিতে বরফ পড়েছে। মানস চক্ষে ফ্রিজ ছাড়া ছড়াছড়ি বরফ দেখে মনে হল, ওমা এতো সগ্গ। চতুর্দিক সাদা। এরপর গেলাম একটি ইকো পার্কে। সেখানকার ভিউটি বড় সুন্দরী। চারিদিকে ওক, পাইন, বার্চ আর তার মধ্যে বরফ, এক কাপ গরম চায়ের থেকে লোভনীয় এবং স্বপ্নালু কিছু হয় না। পাশে দেখা যাচ্ছে হিমালয়রাজি। যদিও সে লুকোচুরি খেলতে ভালই পারে।
ধনৌল্টির বরফ ছাড়িয়ে পৌঁছলাম মনাস্ট্রিতে। রাস্তা বন্ধ থাকায় সেদিক পানে পা বাড়ানো গেল না। এর পরের গন্তব্য কোম্পানি গার্ডেন, যেখানে বাচ্চারা নির্দ্বিধায় খেলতে পারে। বড়দের জন্য কেবল একটি ফোয়ারা এবং তার সামনে হাজারো ফটোগ্রাফারের জোরাজুরি ছাড়া আর কিছু নেই। তিলক ভাইয়ার জোরাজুরিতে ওখানকার রাজমা চাউল দুপুরের লাঞ্চের জন্য অর্ডার করলাম। দুই চামচ মুখে দিয়েই আর খেতে পারছি না। রাজমা চাউল একদমই বাঙালির মুখে উঠবে বলে মনে হয় না। কোনও মতেই পেট ঠুসে ক্লাউড এন্ডের দিকে চললাম।
১৮০০ সালের শেষের দিকে বানানো ব্রিটিশদের ব্যবহৃত সামগ্রী, সেকালের দেরাদুনের ছবি দিয়ে বানানো একটি গ্যালারি। এবং নিভৃতে থাকা একটি ইকো পয়েন্ট। আদ্যিকালের জংধরা গেট পেরিয়ে ক্লাউডে ঢুকলাম। মনে হল, যেন সুইজারল্যান্ডের এক টুকরো গ্রাম উঠে এসেছে। নুড়ি বিছানো পথ ধরে ক্রমশ ইকো পয়েন্টে এসে চুপ করে খানিকক্ষণ বসে রইলাম। এই নির্জনতা সমাজ সংসারকে মুহূর্ত খানিকের জন্যে যেন ভুলিয়ে দেয়। চতুর্দিকে পাইন বনের সারি গভীর খাদ মনে বৈরাগ্য আনে। ব্রিটিশদের বানানো মিউজিয়ামে সেকালের ব্যবহৃত অ্যাপেল ভিনিগার, সুরাপাত্র, গরম জলের ব্যাগ, কফি তৈরির মেশিন এবং মূল্যবান বাঘছাল। তার সঙ্গে নানা রকমের ডিনার সেট এবং গ্যালারিতে সেকালের অপরূপ সুন্দর মুসৌরি এবং দেরাদুনের ছবি। যেন ইতিহাসের পাতার মতোই জীবন্ত মনে হবে। যেন ইতিহাস থেকে তুলে আনা এক টুকরো জীবন্ত পাতা। আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে পরের গন্তব্য জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ডিরেক্টর জর্জ এভারেস্টের গ্রীষ্মকালীন নিবাস।
প্রচণ্ড গাড়ির ভিড়ে সরু রাস্তায় যাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। পার্কিংয়ের সমস্যা এড়িয়ে আমি এবং ত্রিলোক ভাইয়া চললাম গন্তব্যের দিকে। যাওয়ার রাস্তা শুরুর পাশে এক সুবিশাল মাঠ। মাঠের মধ্যে বার্চ গাছ পড়ে এক অভূতপূর্ব সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। তারই মধ্যে সমস্ত পাহাড়ি শিশুরা ক্রিকেট খেলার জন্য জড়ো হয়েছে। বর্ণনাতীত সুন্দর। জুস এবং জলের সাহায্যে হাঁফাতে হাঁফাতে এক ঘণ্টা কাটিয়ে অবশেষে গেটের কাছে এসে পৌঁছালাম। নির্মাণ ক্যাম্প চলছে। সেনা শিবির হচ্ছে। দু’বছর পর হয়তো এই জায়গাটা ভিড়াক্কার হয়ে যাবে।
অবশেষে এভারেস্টের বাড়ির কাছে এসে পৌঁছলাম। আশেপাশে প্রচুর পর্যটক। দূরে একটি পাহাড়ে ট্রেকিং হচ্ছে। পাহাড়টি বেশ উঁচু। তখন সূর্যাস্তের সময়। সূর্যাস্তের শেষ আলো ওই বাড়ির উপর এসে পড়ছে। এখানে জর্জ এভারেস্ট বিকেলের দিকে তাকিয়ে চা পান করতেন। বাড়িটা সারাই চলছে। হয়তো খুব শিগগিরই এটি আগের চেহারা ফিরে পাবে। কিন্তু আগেকার নির্জনতার কৌলিন্য হয়তো খুঁজে পাবে না। ট্রেক শেষে পরের গন্তব্য মুসৌরি ম্যাল। শতবর্ষের থেকে কিছু বেশি পুরনো লাইব্রেরি, গান্ধীজীর ভিউ পয়েন্ট সব মিলিয়ে মুসৌরি বারবার ব্রিটিশ আমলের কথা মনে পড়ায়। বাজারের মাঝখানে একটি অভূতপূর্ব স্থাপত্য রয়েছে। যেটি না দেখলে মুসৌরি আশা বৃথা। চতুর্দিকে দোকানপাট, সোয়েটারের পসরা ইত্যাদি। কেনাকাটির পাট চুকিয়ে আলু পরোটা সাঁটাতে বসলাম। আলু পরোটার চেহারা দেখে রাতের খাবার প্ল্যান বাতিল করেছি এর মধ্যেই। অবশেষে মুসৌরি আলো জ্বালানো রাস্তা পেরিয়ে পাহাড়ি রাস্তা ধরে দেরাদুন ফিরলাম।
২৩ ফেব্রুয়ারি
আজ একদম আকাশ ভাঙা বৃষ্টি। বেরনো একদমই সম্ভব না ।আশেপাশে দোকানপাট দেখার প্ল্যান বাতিল করলাম। কোনও মতে দারোয়ান কাকুর কোয়ার্টার থেকে দু’টো মুখে দিয়ে দৌড়ে নিজের ঘরে ফিরলাম। আজ দিনটা কেবল ঐতিহাসিক গল্পেই কাটবে মনে হচ্ছে।
২৪ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি
এই ক’দিন ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটে কাজ থাকায় তেমন ভাবে আর বেরোনো হয়নি। ইনস্টিটিউট বড় সুন্দর, চতুর্দিকে ঘন জঙ্গল, কোথাও গুরুগম্ভীর মুখের স্কলাররা স্কুটি নিয়ে তাঁদের ইনস্টিটিউটে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে সুন্দর পাখির আওয়াজ। সব মিলিয়ে দেরাদুন শহরের প্রাণ এই ইনস্টিটিউট। চারিপাশে প্রচুর প্রচুর দর্শনার্থী আসেন। আমি যেখানে কাজ করছিলাম সেই বিল্ডিংটা অনেকটাই দূরে। এই মাঠের পাশেই বিশাল ইংরেজ আমলের বাড়ি। যেখানে সিনেমার শ্যুটিং হয়েছে বহু।
গথিক নকশা কাটা ভারি ভারি খাম দিয়ে গোটা বাড়িটা তৈরি। গ্যালারি পর গ্যালারি যেন কোনও ঐতিহাসিক সিনেমার সেটে দাঁড়িয়ে আছি। চারটি মিউজিয়াম দর্শনার্থীদের জন্য খোলা। একটি বন্ধ থাকে। একটি ফরেস্টের মিউজিয়াম, একটি গাছের রোগ সংক্রান্ত মিউজিয়াম এবং আরেকটি নানারকম কাঠের মিউজিয়াম। টিকিট লাগে ঢুকতে। উদ্ভিদপ্রেমীদের জন্য এই মিউজিয়াম আদর্শ। কাজকর্ম শেষ করে অটো ধরে চললাম পাড়াতুতো এক ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। আলাপ জমল দেরাদুনের বিখ্যাত এবং ঘন দুধের চা দিয়ে। চায়ের ওপরে মোটা সর। ক্লক টাওয়ার থেকে ঘুরে বেড়ানো শুরু করে সমস্ত শহরটা পায়ে হেঁটে ঘুরেছি অথচ ভিড়ের মধ্যে নির্জনতা থাকাটাও সবাই হয়তো পায় না।
বলতেই হয় উমেশ চাচার কথা। একদিন শহরে যাওয়ার জন্য অটো ধরব বলে দাঁড়িয়ে আছি। অটোটি পাত্তা না দিয়ে চলে গেল। পর মুহূর্তেই একজন বয়স্ক লোক স্কুটার নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে বললেন ‘‘তুমি আমার স্কুটারে উঠলে তোমাকে ক্লক টাওয়ারে ছেড়ে দিতে পারি।’’ আমি ইতস্তত করছিলাম এবং সামান্য ভয় পেয়েছিলাম। কারণ কলকাতায় এটি আকস্মিক ব্যাপার। চাচা মহাখুশি। জিজ্ঞাস করল কোথা থেকে আসছি? কলকাতার কথা শুনে বলতে থাকলেন, কলকাতা নাকি তাঁর অত্যন্ত প্রিয় শহর। সেখানে কিছু দিন কাটিয়েছেন। কথার মাঝে বলে ফেললেন, দেরাদুনে বাড়ি কিনতে চাইলে যেন তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি।
২৭ ফেব্রুয়ারি
খান ভাইয়ার অটোতে করে চললাম মালসি ডিয়ার পার্ক। এটি দেরাদুন থেকে মুসৌরি যাওয়ার পথে পড়ে। চিড়িয়াখানাটি ভারী সুন্দর। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, প্লাস্টিক নিষিদ্ধ। নানা রকমের পাখি। নানা রকমের প্যাঁচা, বাঘ, হরিণ। পাহাড়ের উপরে ছিমছাম সুন্দর চিড়িয়াখানাটি দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট।
২৮ ফেব্রুয়ারি
সমস্ত গোছগাছ করে দারোয়ান কাকা, সুরভি, আমার একলা বাসের কোয়ার্টারকে বিদায় জানিয়ে অটোতে চেপে বসলাম। এবার গন্তব্য দেরাদুন স্টেশন দেরাদুন এক্সপ্রেস এবং গন্তব্য লখনউ। ক্রমে দুনের চাকা দেরাদুনের মাটি ছাড়াল। পিছনে পড়ে রইল পাহাড়ি শহর, বন, বরফ, গাছপালা। আর স্মৃতি।
কভারের ছবি— ধনৌল্টির বরফ।
(সমাপ্ত)