ময়ূখ নস্কর
‘এই ইছামতীর জলের মতোই কাল, গভীর ক্ষুব্ধ, দূরের সে অদেখা সমুদ্রবক্ষ, এই রকম সবুজ বনঝোপ আরব সমুদ্রের সেই দ্বীপটিতেও। সেখানে এইরকম সন্ধ্যায় গাছতলায় বসিয়া এডেন বন্দরে সেই বিলাতযাত্রী লোকটির মতো সে রূপসী আরবী মেয়ের হাত হইতে এক গ্লাস জল চাহিয়া খাইবে। চালতেপোতার বাঁকের দিকে চাহিলে খবরের কাগজে বর্ণিত জাহাজের পিছনে সেই উড়নশীল জলচর পক্ষীর ঝাঁককে সে একেবারে স্পষ্ট দেখিতে পায় যেন’।
…আমার ছোটবেলায় একটা স্বপ্ন ছিল জানেন। ছোটবেলা মানে, খুব ছোট নয়, নিজে নিজে পথের পাঁচালী পড়তে শিখে গেছি। নিজেকে মনে মনে অপু ভাবতেও শিখে গেছি। তাই অপুর মতোই মনে বড়ো সাধ হয়েছিল, ‘এডেন বন্দরে সেই বিলাতযাত্রী লোকটির মতো রূপসী আরবী মেয়ের হাত হইতে এক গ্লাস জল চাহিয়া খাইব’। এডেন বন্দরটি ঠিক কোথায় তা জানা ছিল না, কিন্তু এটুকু বুঝেছিলাম যে আরব সাগরের তীরেই হবে। নইলে আরবি মেয়ে আসবে কোথা থেকে? এডেন বন্দরে কখনও যাওয়া হয়নি। কিন্তু সেবার গিয়েছিলাম লাক্ষাদ্বীপে। নিজের পয়সায় যাইনি। অত পয়সার জোর ছিল না। বাবা তখনও চাকরি করে, আমারও ২৫ বছর বয়স হয়নি, প্রায় বেকার, কাজেই এলটিসি-র সুবিধা পাওয়া গেছিল।
লাক্ষাদ্বীপ কেমন জায়গা, কীভাবে যেতে হয়, সেসব কথা জানার জন্য আমার লেখা পড়ার প্রয়োজন নেই। সেখানে গেছেন এমন লোকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। তাঁদের ভ্রমণকাহিনি ইংরেজি, বাংলা দু’টো ভাষাতেই পাওয়া যায়। আমিও দু’তিন জায়গায় লিখেছি। মনে হলে আবার না হয় লিখব আপনাদের জন্য। আজও লাক্ষাদ্বীপের কথাই বলব। তবে প্রকৃতির কথা নয়। চুপচাপ পড়বেন। কী ভাবে গেলেন, কী খেলেন, কী দেখলেন, কত খরচ এসব প্রশ্ন এই লেখাটায় করবেন না। ‘ফর গডস সেক হোল্ড ইওর টাং’।
দ্বীপপুঞ্জের সব দ্বীপে পর্যটকদের যেতে দেয় না। আমরা গেছিলাম তিনটে দ্বীপে। কাভারাত্তি, কালপেনি, মিনিকয়। এদের মধ্যে সব থেকে সুন্দর কালপেনি। আহা! শুধু তাকে নিয়েই আলাদা একটা লেখা হয়। কিন্তু ওই যে শুরুতেই বলেছি, আজ প্রকৃতির কথা বলব না। বলব অন্য কিছু কথা। তাই চলে যাব মিনিকয়ে।
লাক্ষাদ্বীপের সবথেকে বড় দ্বীপ মিনিকয়। এখানকার লেগুনটিও সবথেকে বড়। লেগুনের কথা একটু বলে নিই। লাক্ষাদ্বীপের সব দ্বীপকে বেষ্টন করে প্রবাল প্রাচীর আছে। প্রাচীর ভেদ করে জাহাজ দ্বীপের কাছে যেতে পারে না। অনেকটা দূরে জাহাজ থেকে নেমে নৌকায় উঠতে হয়। নৌকা প্রাচীরের ফাঁকফোকর গলে গলে যাত্রীদের নিয়ে যায় দ্বীপে। এই প্রাচীরের ভিতরের অংশই হল লেগুন। এর জল নীলকান্ত মণির মতো উজ্জ্বল, আয়নার মতো স্বচ্ছ, কিন্তু দিঘির মতো শান্ত আর ডোবার মতো অগভীর। এই জলে কায়াকিং করুন, স্নান করুন, সাঁতার কাটুন। যা খুশি করুন।
আমিও তাই করছিলাম। মানে যা খুশি করছিলাম। একা একা একটা কায়াকের দাঁড় বাইতে বাইতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম লেগুনময়। কিন্তু সব খুশিরই একটা সীমা আছে। সেটা অতিক্রম করলেই মুশকিল হয়। সব লেগুনেরই একটা মুখ খোলা থাকে যেখান দিয়ে মূল সমুদ্রের জল ঢোকে এবং বেরোয়। দাঁড় বাইতে বাইতে হঠাৎ অনুভব করলাম শান্ত লেগুনের জলে একটা মৃদু টান এবং বুঝলাম টানটা ক্রমশ বাড়ছে। সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখলাম অন্য পর্যটকেরা জল থেকে উঠে গেছে অনেকক্ষণ। আমি একা চলে এসেছি অনেক দূরে, লেগুনের খোলা মুখের জলস্রোতের কাছে। প্রাচীরের বাইরেই দাঁত মুখ খিঁচিয়ে অপেক্ষা করছে আরব সাগর। দূর থেকে তার গর্জন শোনা না গেলেও গাঢ় নীল দাঁতের সারির ফাঁকে ফাঁকে ফেনার কুণ্ডলী স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
সমূহ বিপদের সম্ভাবনা ছিল। হল না, জলের গভীরতা বেশি ছিল না বলে। জল বড় জোর আমার কোমর পর্যন্ত। দাঁড়, কায়াক সবকিছু আক্ষরিক অর্থে জলে ফেলে কিছুটা সাঁতরে, কিছুটা হেঁটে উঠলাম কাজু বনের ভিতরে। মিনিকয়ের লেগুন ঘিরে কাজুবন আর কেয়াবন। সত্যেন দত্তর ‘ইলশে গুঁড়ি’ কবিতাটা পড়া ছিল ‘কেয়াফুলে ঘুন লেগেছে, পড়তে পরাগ মিলিয়ে গেছে’ কিন্তু কেয়া ফুল কখনও দেখিনি। মিনিকয়ে দেখলাম। আর দেখলাম সাইদাকে।
সাইদা কে? কে আবার! যার কথা আপনাদের বলতে বসেছি, সে। বনের মধ্যে আধ ঘণ্টা খানেক হেঁটে তার দেখা পেয়েছিলাম। যেখান থেকে কায়াকিং শুরু করেছিলাম ঠিক সেখানে। ফাজিল সমুদ্র ফুঁ দিয়ে দিয়ে কেয়াবনের আলগা চুলের গুছিগুলোকে নাড়াচ্ছিল। আর সেই ফুঁয়ে সোভিয়েত পতাকার মতো পতপত করে উড়ছিল তার ওড়না। টকটকে লাল। আমাকে দেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসেছিল। তারপর হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে, যেমন দ্রুত পায়ে এসেছিল, তেমনই ফিরে গেল দ্রুত। তারপর আবার ফিরে এল, হাতে এক গ্লাস ডাবের জল নিয়ে। নাই বা হল এডেন বন্দর, নাই বা হলাম আমি বিলাতযাত্রী, নাই বা হল সে আরবি মেয়ে। কিন্তু মেয়ে তো! রূপসী তো! আমাকে এক গ্লাস জল (তা-ও আবার না চাইতেই) এনে দিল তো!
স্বপ্নপূরণের ঘোর কাটতে না কাটতেই দেখি সে একটা ডেটলের বোতল, তুলো আর ব্যান্ড নিয়ে এসেছে। বোঝো কাণ্ড! লেগুনের বোল্ডারে অথবা কেয়াবনের ঝোপে, কোথায় যে আমার হাঁটুতে ধাক্কা লাগল, কখন যে রক্ত বেরল, তা আমি নিজেও খেয়াল করিনি। কিন্তু সে করেছে। এর পরেও যদি তার সঙ্গে আলাপ না করে উঠতে না পারতাম, তাহলে আমার পুরুষ জন্ম বৃথা হতো। আলাপের আদিতে হল নাম। অমিত রায়কে স্মরণ করে তার নাম জিজ্ঞাসা করেছিলাম। জানিয়েছিলাম, আমি কলকাতায় সাংবাদিকতা করি। (সবে শুরু করেছি তখন।) শুনেই সে আবার ছুটে গেল। খুব তন্বী ছিল না, কিন্তু সমুদ্রের এলোমেলো হাওয়ার মধ্যে তার ছুটে যাওয়াটা ভাল লেগেছিল। ভাল লেগেছিল, যখন সে হাঁফাতে হাঁফাতে একটা খবরের কাগজ এনে আমার হাতে দিয়েছিল। তাদের দ্বীপপুঞ্জের একমাত্র খবরের কাগজ ‘লাক্ষাদ্বীপ টাইমস’।
সেই ‘লাক্ষাদ্বীপ টাইমস’ এখনও আমার কাছে আছে। একমাত্র অভিজ্ঞান হিসাবে। তার নাম-ঠিকানা লেখা চিরকুটটিও অনেক দিন ছিল। এখন আর নেই। কারণ অপুর জীবনে এখন অপর্ণা এসে গেছে, কাজল এসে গেছে এবং অপর্ণাটি ভাল তবিয়তে বেঁচে আছে। এখন কি আর রূপসী মেয়ের হাতে জল খাওয়ার…।
বিঃ দ্রঃ ১৫/১৬ বছর আগেকার কথা। তখন আমার ডিজিটাল ক্যামেরা ছিল না। রিল ভরা খচাখচ ক্যামেরাই সম্বল। সেই রিল ফুরিয়ে গেছিল, কাজেই সাইদার ছবি আমার কাছে নেই। আশা করি, তাতে আপনাদের কোনও অসুবিধা হবে না। বঙ্গবাসী কাগজের সেই বিলাতযাত্রীর চিঠিতেও তো রূপসী আরবি মেয়েটির কোনও ছবি ছিল না।
ছবি— লেখক
(সমাপ্ত)