ফারুক আব্দুল্লাহ
ছোটবেলায় গ্রামের বাড়ি গেলে প্রায়ই বায়না ধরতাম দাদুর সঙ্গে হাটে যাব। পাশের গ্রাম শঙ্করপুরে বিকেলে হাট বসত। দাদুও রাজি যেতেন এক কথাতেই। দাদুর হাত ধরে ছোটবেলার সেই হাটে কাটানো সময়গুলো আজও মনে আছে। হাটের গুঞ্জন এখনও কানে ভাসে। খোলা মাঠে বসা ঝুরি, জিলিপি, ঝালবড়ার দোকান থেকে হাওয়ায় ওড়া সুগন্ধ এখনও টের পাই।
হাটের ভালবাসায় বুঁদ হয়ে আছি এখনও। নতুন কোনও হাটের কথা শুনতে পেলেই বেরিয়ে পড়ি। মুর্শিদাবাদের বহু হাট ঘোরা হয়ে গিয়েছে। কয়েকটিকে নিয়ে লিখেও ফেলেছি। একদিন এক প্রকাশক দাদার ফোন পেলাম। তিনি হাট নিয়ে আমার একটি লেখা পড়ে ফোন করেছিলেন। মুর্শিদাবাদের একটি বহু পুরানো হাটের সন্ধান চাইছিলেন। জানালেন, সেই প্রাচীন হাট বসে মুর্শিদাবাদের রানিনগর থানার সুপারিগোলা গ্রামে। দারুণ তথ্য। মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল হাটে যাওয়ার ইচ্ছে। কিন্ত তার আগে তো খোঁজ নিতে হবে! কবে, কখন সেই হাট বসে। কী ভাবে যেতে হবে। এই প্রশ্নগুলো সেই প্রকাশক দাদাকেও করেছিলাম। কিন্ত দাদাও জানালেন, তিনি কিছুই জানেন না।
তাহলে উপায়? পাওয়া গেল আমাদের রোজ বিকেলের আড্ডার এক কবিকে। সে জানাল, সুপারিগোলা হাট তার গ্রাম থেকে খুব দূরে নয়। আমাকে কথা দিল হাটের যাবতীয় খোঁজখবর নিয়ে জানাবে। কিন্ত প্রায় দু’মাস পার হওয়ার পরে হাটের তথ্য জানিয়েছিল।
আর দেরি করিনি। বেরিয়ে পড়েছিলাম। সঙ্গী হল বিশ্বজিৎদা এবং ভাই আনোয়ার। ওদের ইচ্ছে ছিলই। আমি বলতেই এক কথায় রাজি হয়ে যায়। আমরা বেরিয়েছিলাম গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসের কোনও এক শনিবারের বিকেলে। সুপারিগোলার হাট বিকেলেই বসে। লোকজনের কাছে যাত্রাপথের হদিস জানলাম। মুর্শিদাবাদের ইসলামপুর থেকে টোটোয় চড়ে বসলাম। গাড়িতে বসেই মোবাইলে স্যাটেলাইট ম্যাপ খুলে আমাদের গন্তব্য সেট করতেই দেখি ১৬ কিলোমিটারের পথ দেখাচ্ছে। গাড়িতে বসে একটু নিশ্চিন্ত হতেই গাড়ির চালক বললেন, তিনি সুপারিগোলা যাবেন না। এমনিতেই বিকেল হয়ে গিয়েছে। ব্যাটারিচালিত টোটোর সেখানে পৌঁছতে সময়ও লাগবে। ফেরার সময় কোনও যাত্রী পাবেন না। ফাঁকা গাড়ি নিয়ে ফিরতে হবে। ফলে কিমি চার-পাঁচেক গিয়ে কালিকাপুর মোড়ে আমাদের নামিয়ে দিলেন। আমরা সেখান থেকে অন্য একটি গাড়ি ধরলাম। সুপারিগোলা মোড়ে যখন পৌঁছলাম তখন দেখি বিকেল গড়িয়েছে অনেকটাই। মোড়ের চায়ের দোকানগুলোয় ভিড় জমছে। আড্ডার জায়গা তো এগুলোই। আমাদের তিনজনকে দেখে চায়ের দোকানের আড্ডাধারীরা কেমন যেন অপ্রস্তুত। তবে হাটে যাওয়ার রাস্তা জিজ্ঞেস করতেই বেশ কয়েকজন উৎসাহিত। নির্দেশিত পথে পা বাড়ালাম। দেরি হওয়ার ভয় ছিল। সন্ধ্যে হয়ে গেলে ভাল ছবি উঠবে না। সেই চায়ের দোকান থেকে কিছুটা পরেই সুপারিগোলা হাট।
কিন্ত এ কেমন হাট? এই হাটের সম্পর্কে যা শুনেছিলাম তার তো কিছুই মিলছে না। দেখি রাস্তার ধরে বেশ কিছুটা ফাঁকা জায়গায় বহু পসারি নানান পসরা সাজিয়ে বসেছেন। তাতে আনাজের দোকানই বেশি। গ্রামের এমন টাটকা শাকসব্জি দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে। কেউ বসেছেন পাকা কলার সম্ভার নিয়ে, কেউ বিক্রি করছেন নিজের তৈরি খাঁটি গুড়। কেউ ভাজছেন ঝুরি, জিলিপি তো কেউ আবার ঝালবড়া, বেগুনি, পেঁয়াজি। কোথাও বসেছে খাজার দোকান, কোথাও আবার পান পাতা ও সুপারির দোকান।
আমরা তিনজন হাট দেখতে শুরু করলাম। কিন্ত রথ দেখা হলেও কলা বেচা তখনও বাকি। কারণ তখনও হাটের ছবি তোলা শুরু করিনি। সেটা শুরু করতে হবে। আবার হাটের ইতিহাসটাও জানতে হবে। এসব ভাবতে, ভাবতেই মোবাইল ক্যামেরা অন করে ফেললাম। কিন্ত এখানেও সমস্যা। ভিড়ের মধ্যে ছবি তোলার বহু অভিজ্ঞতা থাকলেও তখন হঠাৎই কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। সবাই প্রথম থেকেই আমাদের দিকে এমন ভাবে তাকাচ্ছিলেন যেন আমরা অন্য গ্রহের জীব। এদিকে বেলাও শেষ হয়ে যাচ্ছে। অস্বস্তি ছেড়ে ছবি তুলতে শুরু করলাম। যার যা ইচ্ছে তাই ভাবুক। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তরও মনে মনে ঠিক করেই রেখেছিলাম।
ছবি তোলার শেষে গল্পের সন্ধানে। কিছু প্রবীণের সন্ধান দরকার। একটু খোঁজ করতেই কয়েকজন প্রবীণের সন্ধান মিলল। তাঁদের কাছে নিজেদের ইচ্ছের কথা জানালাম। প্রবীণেরা একের পর এক গল্প বলতে শুরু করলেন। কিছু তাঁদের পূর্বপূরুষদের মুখে শোনা এবং কিছু ছোটবেলায় দেখা অভিজ্ঞতা। আমরা তিনজন পড়ন্ত বিকেলে সেই গ্রাম্য হাটের পুরানো গল্প শুনতে শুনতে তলিয়ে গেলাম অতীতে। শুনলাম এই হাট নাকি প্রায় দু’শো বছরের পুরনো। এক সময় প্রায় ৩৫ বিঘা জমির উপর হাট বসত সপ্তাহে দুই দিন। মঙ্গলবার ও শনিবার। এখনও তাই বসে। এলাকার তিনজন জমিদার হাটের তত্ত্বাবধান করতেন। হাটের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল এলাকার গণ্ডি পেরিয়ে দূর দূরান্তে। সুপারিগোলার হাটে নদিয়া, বীরভূম, বর্ধমান, মালদা এবং বর্তমানে বাংলাদেশের রাজশাহি-সহ আরও বহু এলাকা থেকে লোকজন আসতেন কেনাবেচা করতে। হাটের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন দ্রব্যের পসরা নিয়ে বসে যেতেন ব্যবসায়ীরা। হাটে সমস্ত ধরনের শস্য, সব্জি থেকে শুরু মশলা, চিনি, গুড়, খাজা, গজা, ঝুরি, জিলিপি, ঝালবড়া-সহ বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের দোকান বসত। এছাড়াও হাটে পানপাতা, সুপারি, জর্দা, জামাকাপড়, পশুপাখি-সহ বহু দ্রব্যই পাওয়া যেত। হাটে বসত হাতুড়ে ডাক্তারের চেম্বার। সেখানে পড়ত মানুষের লম্বা লাইন।
হাটের দিনগুলিতে বসত সার্কাস, ম্যাজিক খেলার আসর। সেখানে বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ ভিড় জমাতেন। হাটে এত ভিড় হতো যে বহু দূর থেকেও হাটুরে গুঞ্জন শোনা যেত। হাটের ভিড়ে অনেকেই আবার হারিয়ে যেতেন। এই সমস্যায় সবথেকে বেশি পড়তে হত বাচ্চাদের নিয়ে। যাঁরা বহু দূর থেকে আসতেন তাঁরা গরুর গাড়িতে করে একদিন আগেই এসে হাজির হতেন হাট প্রাঙ্গণে। হাটেই রাত্রিবাস। নিজেরাই রান্না করে খেতেন। বহু ব্যবসায়ীরা আবার তাদের পণ্য স্থল পথে না এনে নিয়ে আসতেন শিয়ালমারি নদীতে নৌকায় করে। সেখান থেকে গরুর গাড়িতে করে পণ্য নিয়ে যাওয়া হত হাটে। শিয়ালমারি এখন মৃত। তার কোনও অস্তিত্ব নেই।
ইতিহাস শ্রুতি চলছিল। আরও এক প্রবীণ হাজির হলেন। তাঁরও বেশ কৌতূহল। আসলে জানতে চান, হাট নিয়ে আমাদের এত আগ্রহ কেন? চেষ্টা করলাম কৌতূহল মেটানোর। তাঁর সঙ্গে বেশ সখ্য তৈরি হল। তাঁর নাম শরিফুল। তিনি আবার কবিয়ালও। হাট নিয়ে কথা বলার আগেই তিনি তাঁর প্রতিভার পরিচয় দিলেন বেশ কয়েকটি কবিগান শুনিয়ে। জানালেন বহু অভিজ্ঞতার কথা। তিনি বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত। রাজ্যের বহু প্রান্তই তাঁর নখদর্পণে। সেই অভিজ্ঞতাই শোনাতে শুরু করে দিলেন। কিন্ত আমরা তো এসেছি হাটের ইতিহাস জানতে। আমি সুকৌশলে তাঁকে হাটের কথায় ফিরিয়ে আনলাম। হাটের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে হারিয়ে গেলেন অতীতে। হাতের ইশারায় তিনি নানান জায়গা দেখিয়ে বলতে শুরু করলেন এইখানে একটি তেঁতুল গাছ ছিল। তার নীচে বসত বেগুনের হাট। ওইখানে ছিল বটগাছ। সেখানে বসত চালের হাট। ওই দূরের বাঁশঝাড়ের কাছে বসত সার্কাস। সেখানেই আমাদের মুদিখানার দোকান ছিল। গল্প চলতে লাগল। যখন বলা শেষ করলন দেখি তাঁর চোখের কোণে চিকচিক করছে জল।
গ্রামের নাম সুপারিগোলা। হাটের নামও তাই। কেন এমন নাম? স্পষ্ট করে কেউ কিছু বলতে পারলেন না। তবে জানালেন, একসময় এখানে প্রচুর সুপারি হত। সেসবের গোলা ছিল। বাইরে থেকেও আসত সুপারি। শিয়ালমারি নদীতে একটা সুপারি বোঝাই নৌকা ডুবেও গিয়েছিল। পরে উদ্ধার হয় সেই নৌকা। সম্ভবত সুপারির গোলা থেকেই গ্রামের নাম। হতে পারে সুপারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গেই ধীরে ধীরে আরও পসরা বসতে থাকে। বাড়তে থাকে হাট। বা জমিদারেরাও হাট বসাতে পারেন। লিখিত কোনও ইতিহাস না থাকায় প্রকৃত ঘটনা জানা মুশকিল।
সন্ধ্যা নেমেছে ইতিমধ্যেই। সুপারিগোলার হাটে জ্বলে উঠেছে আলো। হাট আরও কিছুক্ষণ চলবে। কিন্ত আমরা বেরিয়ে পড়লাম। বেরিয়ে পড়তেই হল। খোঁজ নিয়েছি সন্ধ্যার পর ইসলামপুর যাওয়ার গাড়ি পাওয়া যায় না তেমন। কারণ তখন গ্রামের অটো বা টোটোগুলো বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যাত্রী নিয়ে ফেরে। চালকেরা আর নতুন করে যেতে চান না কোথাও। হাট থেকে বেরোতেই আবার দেখা হয়ে গেল সেই কবিয়াল শরিফুল সাহেবের সঙ্গে। আমাদের চা না খাইয়ে কিছুতেই ছাড়বেন না। বলে উঠলেন, হয় আমার আমন্ত্রণ গ্রহণ করে চা খেতে হবে। না হলে আমাকে চা খাওয়াতে হবে। আমরা দ্বিতীয় অপশনটাই বেছে নিলাম। দোকানে চায়ের অর্ডার দিয়ে একথা-সেকথায় জানা গেল। তিনি এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতা। ফলে আমাদের আপ্যায়নে রাজনৈতিক দলের অফিস থেকে চেয়ার আনালেন। এর মধ্যে চা এসে গিয়েছে। একেবারে খাঁটি দুধের চা।
চায়ে চুমুক দিতেই নজরে পড়ল আশেপাশের বহু মানুষের দৃষ্টি আমাদের দিকে। বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। কিন্তু তাঁদের কাছেও উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলাম আমরা। এদিকে তখন সন্ধে ৭টা পার হয়ে গিয়েছে। গাড়ি পাওয়ার চিন্তাটা তখন মাথায় চেপে বসেছে। অথচ মানুষগুলো চাইছিলেন আমরা যেন আরও কিছুটা সময় তাঁদের সঙ্গেই কাটাই। আমাদেরও যে মন চাইছিল না তা কিন্তু নয়। কিন্ত আমরা নিরুপায়। গাড়ি না পাওয়ার কথা বলতেই তাঁরা তাঁদের বাড়িতে থেকে যাওয়ার কথা বললেন। অনেকে রাতের খাবারের নিয়ন্ত্রণ করলেন। কিন্ত আমাদের যে এবার উঠতেই হবে। সবাইকে বিদায় জানিয়ে উঠে পড়লাম।
কিছুটা দূরে অটোস্ট্যান্ড। কিন্ত কোনও গাড়ি নেই। প্রায় ৪০ মিনিট অপেক্ষার পর এক অটোর দেখা মিলল। কিন্ত তিনি কিছুতেই রাজি নন। আমাদের এই গ্রামে আসার কারণ জানার পর রাজি হলেন। আমরা তিনজন চেপে বসলাম অটোয়। গ্রামের সড়ক পথ ধরে অটো এগিয়ে চলল। পিছনে পড়ে রইল পুরনো গ্রাম, পুরানো হাট আর মজলিশি মানুষগুলো।
ছবি- লেখক
(সমাপ্ত)
অসাধারণ। পড়তে পড়তে দেখছিলাম। আর ভাবছিলাম, নিজে থাকলে কী কী করতাম। চমৎকার বিবরণ।
অসংখ্য ধন্যবাদ