দীপক দাস
১৯৩৮ সালের ১১ অগস্টের একটি প্রচারপত্র। একটা মিষ্টির দোকানের উদ্বোধন হবে। দোকানটা আসলে এক সংস্থার শাখা। খুলবে শিয়ালদহে। নতুন দোকানের প্রচারের জন্যই এই প্রচারপত্র। তাতে লেখা ছিল, ‘বাংলা ও বাঙ্গালীর বৃহত্তম মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠান’। প্রচারপত্রে আরও লেখা ছিল, ‘ভারতের সর্বত্র এবং বাহিরে সরবরাহ হইতেছে’।
যেদিন প্রথম এই প্রচারপত্রটির বয়ান গোচরে আসে সেদিন বক্ষদেশ ৫০ ইঞ্চি পর্যন্ত ফুলেছিল। গর্বে! বাঙালির যে বৃহত্তম মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠানটির কথা বলা হচ্ছে সেটি যে আমাদের এলাকাতেই। দু’টো গ্রাম পরেই। বাইকে ১০ মিনিট লাগবে বড় জোর। কথাতেই আছে, গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না। মিষ্টি চাখতে, ইতিহাস খুঁজতে কোথায় না কোথায় গিয়েছি। আর ঘরের কাছে কিংবদন্তীর খোঁজ জানি না!
জানতে পারতাম না। ‘দেশ’ পত্রিকার মিষ্টি নিয়ে প্রচ্ছদ করা পুরনো সংখ্যাটা ভাগ্যিস হাতে এসেছিল। তাই জেনেছিলাম, দ্বারিক ঘোষ হাওড়ার জগৎবল্লভপুর ব্লকের নিজবালিয়া গ্রামের বাসিন্দা। এখান থেকেই কলকাতায় গিয়ে মিষ্টির সাম্রাজ্য তৈরি করেছিলেন। এমন তথ্য হাতে আসার পরে কি আর ঘরে বসে থাকা যায়? এদিকে করোনাভাইরাস, লকডাউন। ‘যথা ইচ্ছা তথা যা’র নিয়মিত সদস্যদের দেখা সাক্ষাৎ পর্যন্ত বন্ধ। তা-ও গ্রুপের হোয়াটসঅ্যাপে প্রস্তাব রাখা হল। যেতে রাজি প্রায় সকলেই। তবে মুখোশ আঁটা এই সময়ে এতজন যাওয়া ঠিক হবে না ভেবে আমি আর দীপু যাব বলে ঠিক হল। চিনির দোকান নিজবালিয়ার পাশের গ্রামে। ফলে সে নাছোড়। এক মঙ্গলবার বাইক নিয়ে সাঁইসাঁই। তার আগে অবশ্য এই গ্রামের এক ব্যবসায়ী শ্রী অমর ঘোষের কাছ থেকে বাড়ির সঠিক অবস্থান জেনে নেওয়া হয়েছিল।
রাস্তার উপরেই বাড়ি। এবং দেখলেই বোঝা যায়, একসময়ে বৈভবের অধিকারী ছিলেন এই বাড়ির মালিক। বেশ কিছুটা এলাকা নিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে বাড়ির চৌহদ্দি। এই বাড়িতে এক কেয়ারটেকার থাকেন বলে শুনেছি। কিন্তু বাড়িতে কথা বলার মতো লোক পাওয়া গেল না। এক তরুণী জানালেন, কাছাকাছি এক গ্যারেজে পাওয়া যাবে একজনকে। চিনি চিনিয়ে নিয়ে গেল। দেখা হল অভিজিৎ হাজরার সঙ্গে। তিনি কেয়ারটেকার রজনীবাবুর ছেলে। কিন্তু তাঁর কাছে তেমন তথ্য মিলল না। অভিজিৎ বললেন, তাঁর বাবার সঙ্গে কথা বলতে। আবার ফিরে গেলাম দ্বারিক ঘোষের বাড়ি। রজনীবাবু তখন ফিরে এসেছেন বাড়িতে। তিনিও বিশেষ কিছু বলতে পারলেন না। না জানাটাই স্বাভাবিক। উনিশ শতকের কথা। রজনীবাবু কেয়ারটেকার হয়েছেন মাত্র বছর তিরিশেক আগে। দীপু ততক্ষণে প্রয়োজনীয় ছবি তুলে নিয়েছে।
ইতিহাস জানতে গেলে সেই ‘দেশ’ পত্রিকাই ভরসা। নিজবালিয়া গ্রামের বাসিন্দা রমানাথ ঘোষ ও কালীসুন্দরীর দুই মেয়ে, চার ছেলে। গোষ্ট, দ্বারিক, বিনোদ ও সুরেন। দ্বারিকানাথ ছিলেন মেজো ছেলে। ইতিহাস বলছে, ছোটভাই বিনোদই প্রথম কলকাতায় মিষ্টির দোকান খুলেছিলেন। পরে কলকাতায় আসেন দ্বারিক। তাঁর জন্ম ১৮৬৫ সালে। আর কলকাতায় তিনি দোকান খুলেছিলেন ১৮৮৫ সালে। কম্বুলিয়াটোলার ৭৭ নম্বর শ্যামপুকুর স্ট্রিটে। দোকানের নাম ‘দ্বারিকানাথ ঘোষ’। প্রথমদিকে দোকানে ক্ষীরের প্যাঁড়া, বরফি, দানাদার হত। আর হত মাখা সন্দেশ। দ্বারিকের দইয়ের খ্যাতি ছিল।
এই একটা দোকান থেকেই তাঁর খ্যাতি। কোনও শাখা ছিল না। দ্বারিকের বয়স যখন ৬০ বছর তখন তিনি দ্বিতীয় দোকান খুললেন শ্যামবাজারে। ১৯২৫ সালে। এর এক বছর পরে দ্বারিকের মৃত্যু হয়। দ্বারিক ও গয়াসুন্দরীর তিন ছেলে। জ্ঞানেন্দ্রনাথ, নিশিকান্ত, অবলাকান্ত। তাঁদের সময়েই ব্যবসা বাড়তে থাকে। তিন ভাই মিলে ১৯২৬-৩৮ সালের মধ্যে নতুন আটটি দোকান খুলে ফেলেছিলেন। হাতিবাগান, ভবানীপুর, এন্টালি, নিউমার্কেট, কাস্টমস হাউস, হ্যারিসন রোড, শিয়ালদহ আর হরি ঘোষ স্ট্রিট। এছাড়াও শ্যামবাজারে আরেকটি দোকান খোলা হয়। শিয়ালদহের দোকানটি খোলার সময়েই সেই বিজ্ঞাপনী প্রচার, ‘বাংলা ও বাঙ্গালীর বৃহত্তম মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠান’। ১৯৪৮ সালের মধ্যে খুলল আরও ছ’টি দোকান। গড়িয়াহাট, বাগবাজার, ডালহৌসি, অ্যাসেম্বলি, ওয়েলসলি স্ট্রিট আর লেক মার্কেটে। দ্বারিকানাথের দ্বিতীয় পুত্র নিশিকান্ত ঘোষই ছিলেন এই মিষ্টি সাম্রাজ্যের প্রধান পরিচালক। ততদিনে মিষ্টির বৈচিত্র বেড়েছে। কোনও বিশেষ মিষ্টির জন্য দ্বারিকের খ্যাতি নয়। তাঁর খ্যাতি গুণমানে সেরার জন্য। তাহলেও দ্বারিকের আইসক্রিম সন্দেশের নাম ছিল। ভাল চাহিদা ছিল আইসক্রিম শরবতের। দুধ, বরফ, ভ্যানিলা এসেন্স, সিরাপ। আজকের যা মিল্কশেক সেটাই বহু বছর আগে আইসক্রিম শরবত হিসেবে বিক্রি করতেন। দ্বিতীয় দোকান চালু হওয়ার পরেই দোকানে নোনতা খাবার চালু হয়। লুচি, বেগুন ভাজা, ছোলার ডাল আর আলুর দম।
নিশিকান্তদের আমলে কেমন ছিল দ্বারিকের মিষ্টি সাম্রাজ্য? তাঁদের খদ্দেরদের তালিকায় একবার চোখ বোলানো যাক। ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, জবাকুসুম হাউস, চিত্রতারকা প্রমথেশ বড়ুয়া, মার্টিন রেলের মালিক স্যার বীরেন মুখার্জি, পাহাড়ী সান্যাল, অসিতবরণ, কানন দেবীর বাড়িতে নিয়মিত খাবার যেত। কলকাতার বিখ্যাত কিছু পরিবারের উৎসব, অনুষ্ঠানে দ্বারিকের দোকান থেকে খাবার যেত। কলকাতায় অবস্থিত বর্ধমান, নাটোর, লালগোলা, কোচবিহার রাজবাড়িতে খাবার যেত। ১৯২৫-৪৫ সাল পর্যন্ত রোজ খাবার যেত লিপটন, ব্রুক বন্ড, জার্ডিন হেন্ডারসন, ডানলপ, টার্নার মরিসন সংস্থা এবং দমদম সেন্ট্রাল জেলে। দ্বারিক থেকে কেটারিং করা হয়েছে বেঙ্গল কেমিক্যালে। লালগোলার মহারাজার জন্য ট্রেনেও এবং ব্রিটেনের রাজা ষষ্ঠ জর্জের অভিষেক পর্বে কলকাতার অনুষ্ঠানেও কেটারিং করেছে দ্বারিক। সংস্থার নিজেদের খাটাল ছিল। ২০০টির বেশি গরু-মোষ ছিল। দোকানের মিষ্টি তৈরি হত খাটালের গরু-মোষের দুধেই। ব্যারাকপুর এরোড্রোমের কাছে ৬৭ বিঘা এলাকা জুড়ে ছিল প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ডেয়ারি। আরেকটা গোয়াল ছিল হালসিবাগানে।
আর বিক্রি? ১৯৩৮ সালের প্রচারপত্রের হিসেব বলছে, ন’টি দোকানের কাঁচামাল নিয়ে বিক্রি হত বছরে ন’লক্ষ টাকা। একসময়ে বিক্রি পৌঁছেছিল বছরে ২০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত। অজ পাড়াগাঁয়ের এক গোপ তরুণের ছোট্ট একটা দোকান থেকে বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন। কিন্তু পরিবেশ আর পরিস্থিতি বারবার সেই সাম্রাজ্যের উপরে আঘাত হেনেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্যারাকপুরের খাটাল ২৪ ঘণ্টার নোটিসে ব্রিটিশ সরকার দখল করে। মাত্র ৫০টি গরু নিজবালিয়ার বাড়ির গোয়ালে পাঠানো সম্ভব হয়েছিল। বাকিরা হারিয়ে যায়। হাতিবাগানের দোকানের কাছে ওই সময়ে বোমা পড়ল। ভয়ে দোকান বন্ধ হয়ে গেল। হালসিবাগানের গোয়ালও উঠে যায়। শ্যামবাজারের দোকানটা ভাঙা পড়ল সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ তৈরির সময়ে। ১৯৪৫ সালে মিষ্টির দোকানের উপরে কর চাপায় সরকার। মিষ্টি ব্যবসায়ীরা মামলা করেন। কিন্তু জিততে পারেননি। দ্বারিকের ব্যবসা বিশাল। ফলে বিপুল করের বোঝা চাপে। চিনি বণ্টন নিয়ে কিছু ঝামেলায় পড়েছিলেন নিশিকান্ত। সেসব থেকে মুক্তি পেলেন বটে, কিন্তু আর্থিক ক্ষতি হল বিরাট। পরে তো তিন ভাইয়ের মধ্যে ব্যবসা ভাগ হয়ে গেল। দোকানের নাম বিভিন্ন সময়ে পাল্টেছে। ১৯২৫ সালে দোকানের নাম পাল্টে হল ‘দ্বারিকানাথ ঘোষ অ্যান্ড সন্স লিমিটেড’। ১৯৪৮ সালে আবার পরিবর্তন, ‘দ্বারিক সুইটস (ইণ্ডিয়া) লিমিটেড’। ১৯৫৫ সালে আবার পরিবর্তন। দু’টো নাম হল দোকানের। একটা আদি ‘দ্বারিকানাথ ঘোষ’, আরেকটি ‘দ্বারিক গ্র্যান্ডসন্স’। দোকানের সংখ্যাও ১৫ থেকে কমে ন’টি হয়ে গিয়েছিল।
দ্বারিক কে কি শুধু তাঁর সাম্রাজ্যের জন্যই মনে রাখবে মিষ্টির ইতিহাস? ফোনে কথা হল দ্বারিকের প্রপৌত্র সিদ্ধার্থ ঘোষের সঙ্গে। তিনি জানালেন, কলকাতায় মিষ্টির দোকানে চেয়ার-টেবিল পেতে খাবার ব্যবস্থা দ্বারিকের দোকানেই প্রথম হয়। দোকানে ছিল ফ্যামিলি রুমও। কলকাতায় ‘চেন সিস্টেমের’ ব্যবসাও দ্বারিক প্রতিষ্ঠানের দেখানো। দ্বারিকের আগে বাঙালির মিষ্টির দোকানে নোনতা খাবারের রেওয়াজ ছিল না। তাঁদের বিভিন্ন দোকানে একসময়ে হাজারের বেশি কর্মী কাজ করেছেন। এত কর্মী ভারতের কোনও মিষ্টির দোকানে নেই। আর হ্যাঁ, গ্রামকে কখনও ভোলেননি দ্বারিকের উত্তর পুরুষেরা। নিজবালিয়া গ্রামের বহু বাসিন্দা দ্বারিক ঘোষের দোকানের কর্মী ছিলেন। তাঁদের কেউ কেউ পরে মিষ্টির দোকানও খুলেছেন।
মানুষের পাশে দাঁড়ানোর গুণটা বরাবরই ছিল দ্বারিক ঘোষেদের। একসময়ে শিয়ালদহের একটি ছাত্রাবাসের পুরো খরচ চালাত দ্বারিক ঘোষের প্রতিষ্ঠান। নিজবালিয়া গ্রামে একটি প্রাথমিক স্কুল প্রতিষ্ঠাতেও তাঁদের ভূমিকা রয়েছে। রজনীবাবু বলছিলেন, দুর্ভিক্ষের সময়ে মার্টিন রেলের কামরা বোঝাই করে গ্রামের মানুষের জন্য খাদ্যদ্রব্য আনতেন ঘোষ পরিবার। মাঘি পূর্ণিমায় তিনদিন ধরে হরিনাম সংকীর্তন হত। গ্রামের সকল বাসিন্দাদের থাকত নিমন্ত্রণ। এখনও বছরে একবার নিজবালিয়া গ্রামে যান সিদ্ধার্থবাবুরা।
ও একটা কথা বলা হয়নি। দ্বারিক ঘোষকে সবথেকে দামি শংসাপত্রটি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কথা উঠেছিল সাহিত্যিক বনফুলের স্ত্রীয়ের রান্নার প্রশংসা প্রসঙ্গে। বনফুলের স্ত্রী লীলাদেবীর রান্নার হাত খুব ভাল। তাঁর রান্না খেয়ে রবীন্দ্র্নাথ একবার বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে দু’জন রসস্রষ্টা ছিল। প্রথম দ্বারিক, দ্বিতীয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’। এমন ‘দ্বারিকের ক্ষুদ্র প্রয়াস আজ ভারতের বৃহত্তম মিষ্টান্ন প্রতিষ্ঠানে পরিণত’ হবে তা তো স্বাভাবিক। কিন্তু কালেরও একটা নির্দিষ্ট গতিপথ রয়েছে।
এখন দ্বারিক অ্যান্ড গ্র্যান্ড সন্সের মাত্র তিনটি দোকান রয়েছে। শ্যামবাজার, এন্টালি আর লালবাজারে।
তথ্য ঋণ: দ্বারিকের মিষ্টি— গৌতম গুপ্ত, দেশ পত্রিকা
কভারের ছবি— শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ের দোকান। ছবি সিদ্ধার্থ ঘোষের সৌজন্যে
ছবি— দীপু
(সমাপ্ত)