ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

নবাবি কেল্লার আংনা মহলের খোঁজে

ফারুক আব্দুল্লাহ

ফারুক আবদুল্লাহ।

বাংলার নবাবেরা যে দুর্গের মধ্যে বসবাস করতেন সেই দুর্গকে বলা হত কেল্লা নিজামত। খুব সম্ভবত অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে নবাব সুজাউদ্দিনের শাসন কালে নবাবি দুর্গটি নির্মিত হয় ভাগীরথী নদীর পূর্ব পারে। কিন্ত বর্তমানে কালের গ্রাসে সবই ধ্বংসপ্রাপ্ত। বর্তমানে অবস্থা এমন শোচনীয় যে কেল্লা নিজামত বলে আলাদা করে চেনার কোনও উপায় নেই। তবে নবাবি কেল্লায় ঢোকার প্রধান ফটকটি আজও রয়ে গিয়েছে। রয়ে গিয়েছে বেশ কিছু প্রাসাদ। যদিও সেগুলির অধিকাংশই আজ ধ্বংসের প্রহর গুনছে। কেল্লার মধ্যে থাকা নির্মাণের মধ্যে শুধুমাত্র হাজারদুয়ারি প্রাসাদ এবং ইমামবাড়া  সংরক্ষিত হয়েছে। পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগ এ কাজ করেছে। এছাড়াও রয়েছে বেশ কয়েকটি অক্ষত মসজিদ ও কয়েকটি ইমামবাড়া।

নবাবি আমল না থাকলেও রয়েছেন মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর। তিনি আজও কেল্লা নিজামতে বসবাস করেন। নবাবদের বহু বংশধরেরাও বংশ পরম্পরায় কেল্লার মধ্যে বসবাস করে। যে কেল্লায় এক সময় বিনা অনুমতিতে একটি মাছিও প্রবেশ করতে পারত না সেই কেল্লা আজ বেদখল হয়ে গেছে। কেল্লার ভিতরে আজ গড়ে উঠেছে অজস্র দোকানপাট ও হোটেল। প্রতিদিন একটু একটু করে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে কেল্লার ঐতিহ্য।

নবাবি আমলের কেল্লা।

গত কয়েক বছরে আমি অজস্র বার কেল্লায় গিয়েছি। কেল্লার অলি-গলি আমার নখদর্পণে। কেল্লায় বসবাসকারী নিজামত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও বেশ সখ্য। সেই সুবাদে নবাবি আমলের বহু কিছুই জানার সৌভাগ্য হয়েছে। যত জেনেছি ততই বেড়েছে কৌতূহল। ফলে আজও সুযোগ পেলেই চলে যাই নবাবি কেল্লায়। কেল্লায় ঘুরে ঘুরে অনুভব করি পুরনো আমল। ভাবতে গিয়ে মাঝেমাঝেই মনে হয়, অতীত যেন মূর্ত হয়ে ওঠে আমার সামনে। কেল্লায় বসবাসকারী নবাব পরিবারের প্রবীণদের কাছে রয়েছে নবাবি আমলের বহু কিসসা। সেগুলিও খুব টানে। ভাগীরথীর ধারে কোনও ভাঙা প্রাসাদে বসে সেই নবাবি কিসসা শুনতে গিয়ে কখন, কী ভাবে যে সময় পার হয়ে যায় কিছুতেই টের পাওয়া যায় না।

কেল্লার প্রধান ফটক।

বছর দুই আগের কথা। বহুদিন থেকেই আমার খুব ইচ্ছে, মুর্শিদাবাদের বর্তমান নবাব বাহাদুরের সঙ্গে একবার আলাপ করার। দিনটি ছিল ৩০ জানুয়ারি ২০১৮। নবাব সাহেবের সাক্ষাৎ প্রার্থী হয়ে তাঁর সঙ্গে সকালে যোগাযোগ করা হলে, তিনি সময় দিয়েছিলেন সেদিনই সন্ধ্যা ৭টায়। কিন্ত আমার বাড়ি অনেক দূরে, বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল। ফলে মাত্র ৩০ মিনিট সময় চেয়ে নিয়েছিলাম। যখন কেল্লার প্রধান ফটক পার করে নবাবের বাড়ির সামনে উপস্থিত হলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা ৬.৩০ বাজে। খুব ভাল লাগছিল, ৭টা বাজতে তখনও ৩০ মিনিট বাকি। কিন্ত এই ৩০টা মিনিট আমার ভাবনাতেই কী ভাবে কেটে গেল ভাবতেই পারিনি। খুব মনে হচ্ছিল, নবাবি আমলে যে কেল্লায় সন্ধ্যার পর বাইরের কোনও মানুষের থাকার অনুমতি থাকত না সেই কেল্লায় আমি সন্ধ্যা বেলাতেই হাজির। কেমন যেন গা ছমছম করছিল। মনের মধ্যে নবাবি আমল বার বার ফিরে আসছিল। ভাবছিলাম, এই যে নবাব বাহাদুরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি এটা যদি নবাবি আমল হত তবে পুরো ব্যাপারটি হয়তো অন্যরকম হত। ঠিক ৭টার সময় মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর সৈয়দ মহাম্মদ আব্বাস আলি মির্জা তাঁর বাড়ির গেট খুলে আমন্ত্রণ জানালেন। ভিতরে ঢুকলাম। তাঁকে সালাম জানালাম। তিনি তাঁর উত্তর দিয়ে আমাকে বসতে বললেন। প্রথম ঝলকেই মুগ্ধ হলাম তাঁর নম্র ও বিনয়ী আচরণে।

বর্তমান নবাব বাহাদুর ও লেখক।

সোফায় বসতেই ঘরের দিকে চোখ গেল। ঘরটি প্রায় ২০০ বছরের বেশি পুরনো। দেওয়ালে অসংখ্য পুরনো বাঁধাই করা নবাবদের ছবি। ঘরে রাখা সোনালি রঙের কৃত্রিম স্তম্ভ শোভা বাড়াচ্ছে। পরিচয়পর্ব পার করে শুরু হল নবাবি আমলের নানান কথা। নবাব বাহাদুরের কর্মজীবনের কথা। নবাব হওয়ার কথা। একথা, সেকথার মাঝে আমি জিজ্ঞেস করে বসেছিলাম, ‘‘নবাব সাহেব, আজ আপনি নবাব। অথচ আজ নবাবি আমল নেই আপনার নবাবদের মতো সেই ক্ষমতাও নেই। কেমন লাগে আপনার?’’ তিনি এই প্রশ্ন শুনে একটু হাসলেন। তাঁর পর বললেন, ‘‘এটা যদি নবাবি আমল হতো তবে কি আপনি এত সহজে আমার দেখা পেতেন? এত রাত পর্যন্ত আমি কি আপনার সাথে গল্প করতাম?’’ তাঁর পর জানালেন, তিনি সব হারিয়েও শুধুমাত্র অতীতের স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে আছেন। সব কিছুই তিনি মেনে নিয়েছেন। জানালেন, মুর্শিদাবাদ শহরবাসী আজও তাঁকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান জানান। এ প্রসঙ্গে নানান অভিজ্ঞতাও শোনালেন। কিন্ত নবাব সাহেবের কথা শুনতে গিয়ে কখন যে রাত ১০টা বেজে গিয়েছে আমাদের কারওই খেয়াল নেই। আমি বাধ্য হলাম এমন সুন্দর একটি আলোচনা মাঝ পথে থামিয়ে দিতে। কারণ একটাই। আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে। কেল্লা থেকে আমার বাড়ি প্রায় ২৭ কিমি দূরে ইসলামপুরে। নবাব বাহাদুরের কাছে অনুমতি নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।

ওয়াসিফ মঞ্জিল।

অন্য একদিনের কথা। নবাবি আমলের কেল্লার দু’টি ভগ্ন প্রাসাদ নিয়ে লিখব ভাবছি। ফলে প্রাসাদ দু’টি দেখতে যেতে হবে। এদিকে প্রাসাদ দু’টি জঙ্গলে ঢাকা। সবাই চাইলেই যেতে পারে না। যেহেতু আমি প্রথমবার যাচ্ছি আমারও কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল একা যেতে। তাছাড়া আমি ভাবছিলাম, আমার সঙ্গে নবাব পরিবারের কোনও প্রবীণ সদস্য পেলে আরও ভাল হত। এমনটা হলে আমি তাঁর কাছে আরও ভাল ভাবে প্রাসাদ দু’টি সম্পর্কে জেনে নিতে পারব। কিন্ত এই আবদার করাও তো খুব কঠিন। কারণ আমার জন্য কেনই বা এই জঙ্গলের ভিতরের ভাঙা প্রাসাদে আসতে যাবেন তাঁরা? তবুও সাতপাঁচ না ভেবে বলেই ফেললাম নিজামত পরিবারের এক প্রবীণ সদস্য সৈয়দ রেজা আলি মির্জাকে। উনি ছোটে নবাব। আমার কথা শুনে উনি এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। আমাকে নিয়ে গেলেন সেই ভাঙা প্রাসাদে।

সাদা মসজিদ।

প্রথমে আমরা গেলাম বেগম মহলে। তিনি জানালেন এই মহল তৈরি করেছিলেন তাঁর নানা (দাদু) নবাব ওয়াসিফ আলি মির্জা। এই মহলেই ছোটে নবাব সাহেবের জন্ম হয়েছে। কোন ঘরে তাঁর জন্ম হয়েছিল সেই ঘরটিও তিনি আমাকে দেখিয়ে দিলেন। তিনি আমাকে একের পর এক ভাঙা ঘর দেখাতে গিয়ে নিজেই যেন কেমন নস্টালজিক হয়ে পড়লেন। বেগম মহলের নানান গল্প, ছোটবেলায় তাঁর কাটানো বিভিন্ন মুহূর্ত, কোন ঘরে নাচ হত, কোন ঘরে খাওয়া হতো, কোন ঘরে থাকতেন, সব দেখালেন। জঙ্গলে ঢাকা সেই ভগ্ন মহল যেন জীবন্ত হয়ে উঠছিল তাঁর বর্ণনায়। বর্ণনা করতে গিয়ে তাঁর চোখের কোণা ভিজে উঠেছিল জলে। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, নবাবি আমলের শেষ সময়ের জৌলুস তিনি দেখেছেন। অথচ আজ কিছুই নেই। ধ্বংসস্তূপ শুধু ধ্বংসস্তূপ। কেমন লাগে তাঁর? ছোটে নবাব সাহেব এই কথার উত্তর দিলেন তাঁর লেখা কবিতার দু’টি লাইন আবৃত্তি করে।

হামনে ভি কাভি জাম এ সুবু দেখা থা, জো কুছ দেখা থা রুবারু দেখা থা

আব জো ইস বাত কো গৌর কারতে হো নবাব, কুছ খাব সা থা জো কাভি দেখা থা’।

ছোটে নবাবের সঙ্গে। বেগম মহলের সামনে।

তার পর তিনি নিয়ে গেলেন বালাখানায়। এই মহলের আরও একটি নাম ছিল আমির মহল। তিনি আমির মহলে গিয়ে জানালেন, এ মহল তৈরি করেন নবাব নাজিম হুমায়ুন জা। কিন্ত তিনি জানালেন এই মহল নাকি অসম্পূর্ণ। এর পিছনের একটি গল্প আছে। এই মহল যখন নির্মিত হচ্ছিল তখন নবাব হুমায়ুন জা ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন। সেখানে বাকিংহাম প্যালেস দেখে নবাব ভীষণ মুগ্ধ হন। এবং তিনি মহারানি ভিক্টোরিয়ার কাছে বাকিংহাম প্যালেসের মতো একটি প্যালেস নির্মাণ করার লিখিত অনুমতি নিয়ে ফিরে আসেন মুর্শিদাবাদে। বালাখানা বা আমির মহলের নির্মাণ কাজ বন্ধ করে শুরু হয় হাজারদুয়ারি নির্মাণ। বাকিংহাম প্যালেসের সঙ্গে হাজারদুয়ারি প্রাসাদের আকৃতির অনেকটাই মিল পাওয়া যায়। যা এই ঘটনার সত্যতা কিছুটা প্রমাণ করে।

বেরা উৎসব।

কেল্লার ভিতরে আরও একটি সুরম্য প্রাসাদ রয়েছে যার নাম ওয়াসিফ মঞ্জিল। ছোটে নবাব সাহেব সেই প্রাসাদের সামনে আমাকে নিয়ে এলেন এবং জানালেন এটি তাঁর নানার বাড়ি ছিল। ছোটবেলায় এই বাড়িতেই তাঁর শৈশব কেটেছে। অথচ ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস। ১৯৬৯ সালে নবাব ওয়ারিশ আলি মির্জার মৃত্যুর পর যোগ্য উত্তরাধিকারীর অভাবে নবাব পদটি ফাঁকা থেকে যায় দীর্ঘদিন। তখন মুর্শিদাবাদের নবাবি কেল্লার অবশিষ্ট জৌলুসটুকুও নিঃশেষ হয়ে যায়। নিজামত পরিবারের সদস্যদের অধিকাংশের অবস্থাও শোচনীয় হয়ে পড়ে। তখন জীবন-জীবিকার স্বার্থে ছোটে নবাব সাহেবকে তাঁর নানার বাড়িতে চাকরি নিতে হয়। কারণ ততদিনে ছোটে নবাব সাহেবের নানার বাড়ি পরিণত হয়েছে সরকারি দফতরে।

নবাব বাহাদুরের বাড়ি।

২০১৮ সালের কথা। বালাখানা বা আমির মহলের উপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের কথা ভেবেছিলাম আমরা কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে। সেই সুবাদে আমাদের প্রায় প্রতিদিনই বিকেল বেলায় বালাখানায় যেতে হত। একদিন এক শীতের সন্ধ্যায় আমরা চা খেতে নেমেছি বালাখানার পাশেই একটি চায়ের দোকানে। চা খেতে খেতে হঠাৎ চোখ পড়ে দুই বৃদ্ধার দিকে। তাঁরা আমাদের দিকে কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন। আসলে তাঁরা ভাবছিলেন, আমরা সিনেমা করতে এসেছি। তার পর কথা প্রসঙ্গে উঠল বালাখানার কথা। জানতে পারলাম, সেই দুই বৃদ্ধার একজনের নানি বালাখানায় নবাবদের পরিচারিকা ছিলেন। নানির কাছে তিনি নবাবদের বহু গল্প শুনেছেন। আমি বসে পড়লাম গল্প শোনার লোভে। গল্প শুরু করলেন বৃদ্ধা, বালাখানায় একটা জিন থাকত। শীতের সন্ধ্যায় গরম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জিনের গল্পের আমেজই অন্যরকম ছিল। তিনি উর্দুতে গল্প বলতে শুরু করলেন। জিন তাঁর নানিকে নাকি খুব বিরক্ত করত। রান্না করতে গেলে উপর থেকে ধুলো ফেলত। নবাবদের জন্য ভাল কিছু রান্না করলেও নাকি একটি রহস্যময় বিড়াল এসে সব খেয়ে ফেলত। প্রতিদিন এমন ঘটনা ঘটতে থাকায় নবাবের কানে একদিন সেই খবর গিয়ে পৌঁছয়। একথা শুনে নবাব ভীষণ বিরক্ত হয়ে পরিচারিকাদের দোষারোপ করেন। বলেন, তাঁরাই খাবার চুরি করে বিড়ালের নামে দোষ দেয়।

অভিযোগ প্রমাণ করতে একদিন রাতে হাতেনাতে ধরা হয় সেই রহস্যময় বিড়ালকে। নবাবকে জানালে তিনি নাকি আদেশ দিয়েছিলেন সেই বিড়ালটিকে বালাখানার ছাদ থেকে বস্তাবন্দি করে নীচে ফেলে দেওয়ার। সেই কাজটি বৃদ্ধার নানিকেই করতে হয়েছিল। তিনিও কাজটি করে নিশ্চিত হয়েছিলেন। কারণ তাঁকে দেওয়া খাবার চুরির অপবাদ ভুল প্রমাণিত হয়েছিল। কিন্ত ফেলে দেওয়ার দিন রাতেই সেই বৃদ্ধার নানির স্বপ্নে বিড়াল এসে জানায়, সে একটা জিন। বিড়ালের রূপে খাবার খেতে আসত। তাকে কেন ছাদ থেকে ফেলে কষ্ট দিল? সে খুব আঘাত পেয়েছে। প্রতিশোধ নিতে তাকে মেরে ফেলবে। একথা শুনে সেই বৃদ্ধার নানি ক্ষমা চেয়ে নেন। জানান যে, নবাবের আদেশে এ কাজে বাধ্য হয়েছে। এতে তার কোনও দোষ নেই। বহু কাতর অনুরোধে তিনি নাকি নিস্তার পেয়েছিলেন সেই জিনের হাত থেকে।

নিজামত ইমামবাড়া।

গল্পের মাঝেই নিজামত পরিবারের আরও একজন সদস্য এসে হাজির। সে জানাল সোনা মহলের কথা। বলল নবাবের একটা প্রাসাদ ছিল বালাখানার কাছাকাছি। যার নাম ছিল সোনা মহল। এই মহলের সব কিছুই নাকি সোনার ছিল। মহলের ছাদ, দেয়াল মেঝে থেকে সমস্ত আসবাব পত্র থেকে শুরু করে বিছানার কভার এমনকি খাওয়ায়ার থালাবাটি ও ছিল সোনার জলে রং করা। অবশ্য সেই প্রাসাদের কোনও কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। তিনি আরও জানালেন, নবাবেরা ঘোড়ার গাড়ি করে কী ভাবে যেতেন, কী ভাবে বেগমরা পর্দা করে চলাফেরা করতেন। কত কথা। আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম।

কেল্লার ভেতরে রয়েছে চাঁদনি চক নামে একটা এলাকা। সেখানে আমি প্রায়ই যাই। এখন সেখানে দেখার মতো বলতে একটা পুরনো মসজিদ, একটি বৃহৎ ফটক ও তিনটি ছোট ছোট বাংলা, বিহার ও ওড়িশা ফটক রয়েছে। এই ফটক তিনটি বাংলা সুবার তিন একালাকে মাথায় রেখে নির্মিত হয়েছিল অষ্টাদশ শতকের প্রথমদিকে। নবাব সুজাউদ্দিনের আমলে। আরও পরবর্তীকালে খুব সম্ভবত মীর জাফরের পত্নী মুন্নি বেগম সেখানে একটি বাজার চালু করেন দিল্লির চাঁদনি চকের মতো। সেই বাজারে নাকি তৎকালীন হিন্দুস্থানের সমস্ত কিছুই পাওয়া যেত। কথিত, এই বাজারে নাকি মানুষও কেনা বেচা হত। আজ কিছুই নেই। চকে গিয়ে কিচ্ছুক্ষণ দাঁড়ালে অতীত ধরা দেয় এখনও।

চাঁদনি চকে বিহার-ওড়িশা ফটক।

নবাবি আমল না থাকলেও সেই আমলের বহু অনুষ্ঠান পুরনো রীতি মেনেই পালিত হয় কেল্লায়। যেমন বেরা উৎসব, মহরম, নাওরজ। কেল্লা এই সব অনুষ্ঠান উপলক্ষে সেজে ওঠে। সে দৃশ্য দেখাও সৌভাগ্যের। আমার এখন পর্যন্ত তিনবার নিজামত মহরম দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। বেরা উৎসবও দেখেছি। এই সব বিশেষ দিনগুলোয় নবাবি কেল্লা যেন কোনও জাদুবলে ফিরে যায় নবাবি আমলে।

কেল্লার ভিতরে বহু প্রাসাদ ছিল। ব্রিটিশ লাইব্রেরি ও আমেরিকার সানদিয়াগো আর্ট মিউজিয়ামে কেল্লা নিজামতের কয়েকটি আঁকা ছবি রয়েছে। তাতে কেল্লার কিছু প্রাসাদ দেখা যাচ্ছে। সেই প্রাসাদগুলির মধ্যে সবথেকে সুন্দর প্রাসাদ হিসেবে দেখা যাচ্ছে আগনা মহল। কিন্ত আগনা বলে উর্দু কিংবা পার্সিতে কোনও অর্থ হয় না। অনুমান, প্রাসাদটির নাম সম্ভবত আগনা নয়, অংনা মহল। ইংরেজরা হয়তো আংনাকে উচ্চারণ করেছেন আগনা হিসেবে। লকডাউনের মধ্যেও অদ্ভুত নেশায় পেয়ে বসল। যেভাবেই হোক কেল্লায় যেতেই হবে। আংনা মহলের অবস্থান খুঁজে বের করতেই হবে। বাড়িতে বসে উপগ্রহ চিত্র দেখে অনুমান করা ছাড়া আর কিছুই করা যাচ্ছিল না। এই অনুসন্ধানের বিষয়ে আমার সবথেকে নির্ভরযোগ্য দাদা হল সুব্রতদা। তিনি ভূগোলের শিক্ষক। ইতিহাসের প্রতিও খুব আগ্রহ। দাদা নিজেও মুর্শিদাবাদের হিস্টোরিক্যাল জিওগ্রাফিও নিয়েও গবেষণা করছেন। এসব নিয়ে লেখালেখিও করেন। দাদাকে জানালে তিনিও আগ্রহী হন।

আংনা মহলের টিকে যাওয়া সিঁড়ি।

গত ৯ জুলাই আমরা গিয়েছিলাম সেই আংনা মহলের সন্ধানে। ১৭৯৫ সালের আঁকা সেই ছবির সঙ্গে উপগ্রহ চিত্র ও বাস্তব বুদ্ধির প্রয়োগে অবশেষে উদ্ধার হয় আংনা মহল। না আংনা মহলের কোনও চিহ্ন নেই। তবে মহলে প্রবেশের রাজকীয় সিঁড়ি রয়ে গিয়েছে আজও। এই মহলটি ছিল কেল্লা প্রাচীরের বাইরে একেবারে নদীর জলের সমানে। ভাগীরথীতে জল বাড়লে এই মহলের নীচের অংশ জলে ডুবে থাকত। খুব সম্ভবত নবাবের মনোরঞ্জনের জন্য নির্মিত হয়েছিল এই মহল। অথবা নবাব নৌপথে কোথাও ভ্রমণে গেলে এই মহল থেকেই নৌকায় উঠতেন। এই মহল উদ্ধারের পর আমরা বেরলাম কেল্লার পুরনো প্রাচীরের খোঁজে। পেয়েও গেলাম কয়েকশো বছরের প্রাচীন সেই প্রাচীর। প্রাচীর খুঁজে পাওয়ার পর আমরা কেল্লার ভিতরেই একটা চায়ের দোকানে গলা ভিজিয়ে লকডাউন বিধ্বস্ত জনশূন্য হাজারদুয়ারি প্রাসাদের ছবি তুলে বেরোলাম।

লকডাউনে হাজারদুয়ারি।

এবার আস্তাবলের দিকে। সেখানে পৌঁছে দেখি আকাশ বর্ষার কালো মেঘে ঢেকেছে। তাই দ্রুত কিছু ছবি তুললাম। বাড়ি ফিরতে হবে। সুব্রতদা আমাকে তাঁর বাইকে লালবাগ বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দিল। দ্রুত অটোয় বসলাম। অটো ছাড়তেই শুরু হল মুষলধারায় বৃষ্টি। সঙ্গে মেঘের তীব্র তর্জন-গর্জন।

ছবি— লেখক

কভারের ছবি— শিল্পী সীতারামের আঁকা কেল্লা। রয়েছে আংনা মহলও। ছবি ভাগীরথীর পশ্চিম পার থেকে। ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত।

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *