দীপক দাস
মুন্সিরহাট— আদায় করা স্টেশন
প্রাকৃতিক দৃশ্যে সুন্দর মুন্সিরহাট স্টেশনটি। প্ল্যাটফর্মে ওঠার সিঁড়ির উপরে ছাউনি। সিঁড়ির দু’পাশে গাছ আছে বেশ কিছু। স্টেশনে উঠলে এক বিশাল এলাকায় জুড়ে সবুজের সমারোহ। একটু দূরে গাছপালা ঘেরা একটা আশ্রমও রয়েছে। স্টেশনটির সঙ্গে খুব বেশি পরিচয় নেই। কারণ স্টেশনের উপর দিয়ে গিয়েছি বহুবার। কিন্তু নেমেছি মাত্র একবারই। তা-ও রাতে। আমার ছাত্র-বন্ধু চিরঞ্জিতের বিয়েতে। দীপু আর শুভ বাইকে করে আমাকে নিতে এসেছিল। মানে এখন যারা ঘাসপুস আর গার্ডবাবু নামে পরিচিত। ফলে যা দেখা ওই চলন্ত ট্রেন থেকে।
লকডাউনে একদিন বেরিয়েছিলাম আমি আর দীপু। ইস্টিশন পর্ব লেখার জন্য ছবি সংগ্রহে। অনেকদিন ট্রেন বন্ধ। যাত্রীদের আনাগোনা নেই। প্ল্যাটফর্মের ফাঁকফোকর দিয়ে গাছপালা গজিয়েছে। টিকিট কাউন্টারের সামনের চত্বরে দু’টো বেড়াল ছানা মিউমিউ করছে। কারা বোধহয় ছেড়ে দিয়ে গিয়েছে। এই স্টেশনটি কমিশন এজেন্টের মাধ্যমে চলে। এজেন্ট উজ্জ্বল পরিচিত। কলেজের সিনিয়র ছিল। ওকে দেখতে পেলাম না। একজন বললেন, বেড়াল ছানাগুলোকে উজ্জ্বলের বাবা খেতে দেন। প্ল্যাটফর্মে বেশ কয়েকজন আড্ডা দিচ্ছিলেন। এলাকায় পার্ক নেই। বৈকালিক আড্ডায় স্টেশন পার্কের দায়িত্ব নিজের বুকে নিয়েছে।
মুন্সিরহাট নামের প্রকৃত জায়গাটি বেশ জনবহুল। কিন্তু স্টেশন চত্বরের আশপাশের জায়গাটির পরিবেশ বেশ ভাল। স্টেশনের উল্টোদিকে গ্রামের নাম রামেশ্বরপুর। গাছগাছালি ভরা মনোরম জায়গা। ডক্টর মহেন্দ্রলাল সরকার সরণী ধরে এগোলে গাছের ছায়ায় ঘেরা গ্রামগুলো বড় ভাল লাগে। স্টেশনের কাছে মুন্সিরহাট-মাজু সড়কের দু’পাশেও প্রচুর গাছপালা।
এলাকাটি কিন্তু ঐতিহাসিক। মুন্সিরহাট নামটার বয়স যদিও খুব বেশি নয়। তা-ও ১২০ বছরের বৃদ্ধ সে। ইতিহাস বলছে, এক মুন্সি হাট বসিয়েছিলেন এই জায়গায়। সেই থেকেই জায়গার নাম। সেই মুন্সির নাম পানাউল্লাহ বা মহম্মদ পানা। তিনি ছিলেন কলকাতা হাইকোর্টের আধিকারিক (আনন্দবাজার পত্রিকা- নুরুল আবসারের প্রতিবেদন)। সম্ভবত তিনি হাইকোর্টের মুন্সি ছিলেন। এলাকায় জমিজিরেতও ছিল। হাট এলাকা ছাড়িয়ে তাঁর নামে অলংকৃত হয় অনেকখানি এলাকা। এলাকার গ্রাম পঞ্চায়েতের নাম শঙ্করহাটি। কিন্তু মুন্সিরহাটই বেশি পরিচিত। মুন্সিরহাট যে এলাকায় অবস্থিত তার আশেপাশে বহু ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে। যেমন মুন্সিরহাট থেকে একুট দূরেই শাহ গরিবুল্লাহের মাজার অবস্থিত। ইনি ছিলেন মধ্যযুগের কিসসা সাহিত্যের জনক। রবি ও বৃহস্পতিবার এখনও হাট বসে।
মার্টিন রেলের মানচিত্রে মুন্সিরহাট জায়গা করে নিয়েছিল। স্টেশন ছিল। এখন যেখানে জগৎবল্লভপুর বিডিও-র দফতর সেখানেই ছিল মার্টিন রেলের স্টেশন। ‘নতুন পাতা’ সিনেমায় আছে মার্টিন রেলের মুন্সিরহাট স্টেশনের নাম। কিন্তু ব্রডগেজ রেললাইনের মানচিত্রে প্রাথমিক ভাবে মুন্সিরহাটের নাম ছিল না। স্টেশন হওয়ার কথা ছিল মহেন্দ্রলাল নগরে। হাওড়া-আমতা রেললাইন বড়গাছিয়া থেকে মহেন্দ্রলালনগর পর্যন্ত সম্প্রসারিত হচ্ছিল। এলাকাবাসী মুন্সিরহাট এলাকায় একটি স্টেশন তৈরির জন্য বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। সেই সময়ে রেলমন্ত্রী ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি দাবিপূরণ করেন। তড়িঘড়ি প্ল্যাটফর্ম তৈরির কাজ শুরু হয়। বল্লভবাটি মৌজার বাসিন্দা পিনাকি দত্ত জানালেন, প্রথমে কোলাঘাটের ছাই ফেলে একটা উঁচু মতো জায়গা তৈরি করে প্ল্যাটফর্মের কাজ চালানো হত। অনেকে বলেন, প্রথম তিনদিন নাকি মুন্সিরহাট পর্যন্ত ট্রেন চলেছিল। তার পর মহেন্দ্রলালনগর পর্যন্ত যাতায়াত শুরু হয়। পিনাকি এই তথ্য মানতে চাননি। তিনি জানালেন, চালুর দিন থেকেই ট্রেন মহেন্দ্রলালনগর পর্যন্ত যাতায়াত করত।
প্রথমে পরিকল্পনা ছিল না বলেই মুন্সিরহাট স্টেশন থেকে পরবর্তী মহেন্দ্রলালনগর স্টেশনের দূরত্ব মাত্র এক কিলোমিটার।
মহেন্দ্রলাল নগর— কিংবদন্তী চিকিৎসকের স্মরণে
চিকিৎসক মহেন্দ্রলাল সরকার জগৎবল্লভপুর ব্লকের বাসিন্দা ছিলেন। তাঁর বাড়ি ছিল পাইকপাড়া গ্রামে। স্টেশন থেকে কয়েক কিলোমিটারের মধ্যেই তাঁর বাড়ি। হোমিওপ্যাথির এই চিকিৎসক রামকৃষ্ণদেবের চিকিৎসা করে কিংবদন্তীর পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন। কিন্তু তাঁর অনন্য কীর্তি ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোশিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স’ প্রতিষ্টা। এই প্রতিষ্ঠান থেকেই তাঁর গ্রামের বাড়ি সংরক্ষণ করা হয়েছে। একটি মূর্তিও বসেছে বাড়ির পাশে।
স্বাভাবিক ভাবেই মহান চিকিৎসকের নামেই স্টেশনের নামকরণ করা হয়েছে। তবে পিনাকি দত্ত বলছেন, ট্রেন চালুর আগে বল্লভবাটি মৌজার বাসিন্দারা স্টেশনের নাম বল্লভবাটি রাখার দাবি তুলেছিলেন। সে জন্য নাকি কয়েকজন কালি দিয়ে নামটি ফলকে লিখেও দিয়েছিলেন। তবে সেই দাবি মানা হয়নি।
২০০০ সালের ২২ জুলাই হাওড়া-বড়গাছিয়া ব্রডগেজ লাইন মহেন্দ্রলাল নগর পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। উদ্বোধন করেন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। স্টেশনটি প্রথমে রেলকর্মীদের দিয়েই চালানো হত। এখন কমিশন এজেন্ট ভিত্তিক চলে। এই স্টেশনটির চারপাশের এলাকা একেবারেই ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়। প্ল্যাটফর্মের কোনও ছাউনির নীচে দু’দণ্ড বসলেই মন ভাল হয়ে যায়।
মাজু— হারানো মিষ্টির স্টেশন
কিছু কিছু গ্রাম নামেই টানে। তখন নামে আসে-যায়। নগর-পুর-হাট-গঞ্জ-তলা দিয়ে প্রচুর গ্রামের নাম আছে বাংলায়। দুই বাংলায়। এর বাইরে কিছু পেলে খোঁজ নিতে ইচ্ছে করে। যেমন মাজু। এই নামের উৎস জানতে বহুদিন ধরেই চেষ্টা করছি। সেই ২০০৩-০৪ সাল থেকে। বড়গাছিয়ায় লন্ড্রির ব্যবসা ছিল সুশান্ত দাসের। মাজুর বাসিন্দা ছিলেন। কিছু বছর আগে মারা গিয়েছেন। তিনি জানিয়েছিলেন, আগে এই এলাকায় মাদুর কাঠির চাষ হত। মাদুর থেকে মাজু হয়েছে। কেউ বলেন, তাঁত বোনা হত এলাকায়। তাই মাকু থেকে মাজু।
অনেকদিন আগের কথা। সেই ভেবেই তথ্য যাচাইয়ে বন্ধু জয়ন্ত সিনহা মহাপাত্রের দ্বারস্থ হয়েছিলাম। জয়ন্ত এবং তার স্ত্রী মিথুন আমার সহপাঠী। মিথুনের মাজুতে বাড়ি। জয়ন্ত কয়েকটি মত পাঠিয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে একটি মাদুর থেকেই মাজু। নারায়ণ ঘোষালের তাই মত। আবার আশিসকুমার গায়েনের মত, মাজুলি নামের গাছ থেকে এর উৎপত্তি। এ বিষয়ে সঠিক বলতে পারব না। বাংলাদেশ গাছপালায় সমৃদ্ধ। কিন্তু মাজুলি নামে কোনও গাছের কথা শোনা হয়নি। একসময় হয়তো ছিল। তবে মাজুলি নামের একটি দ্বীপ আছে। অসমিয়া ভাষায় যার অর্থ মা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার।
নামের উৎপত্তি যাই হোক না কেন মাজু কিন্তু ইংরেজ আমল থেকেই রেলের মানচিত্রে। মার্টিন রেলের দু’টি স্টেশন ছিল মাজুতে। একটির নাম মাজু। আরেকটি দক্ষিণ মাজু। এখন একটাই স্টেশন। মাজু নামে। তবে ব্রডগেজ লাইনের সেই স্টেশন গ্রামের এক প্রান্তে চলে গিয়েছে। মার্টিন রেলের মাজু স্টেশনটি ছিল এখনকার বাজার এলাকায়।
আরেকটি কারণেও মাজু আবার কাছে আকর্ষণীয়। এই স্টেশনকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল একটা নতুন মিষ্টি, খইচুর। স্কুলের পড়ার সময়ে শিক্ষক গৌরবাবু নামটা জানিয়েছিলেন। লেখালেখি শুরুর সময়ে খোঁজ নিয়েছিলাম। পেয়েছিলাম এক খইচুর কারিগরকে। তিনি শৈল রানা। তখন বয়স হয়েছে তাঁর। তিনিই বলেছিলেন কনকচূড় ধানের খই দিয়ে খইচুর তৈরির পদ্ধতি। তাঁর ছেলে শ্রীকান্তবাবুও বাবার থেকে খইচুর করা শিখেছিলেন। কিন্তু নিজেরাই বলেছিলেন, সেই খইচুর আর আগের মতো নেই। একসময় অনেক দোকানেই খইচুর হত। হকারেরা দোকান থেকে নিয়ে ট্রেনে ফেরি করতেন। মার্টিন রেল বন্ধ হতে খইচুরের দিন যায়। এখন শ্রীকান্তবাবু আর খইচুর তৈরি করেন কিনা খোঁজ নেওয়া হয়নি। বছর তিনেক আগেও দেখেছি, করতেন।
ব্রডগেজ লাইনের মাজু স্টেশন রেলের কর্মীরা চালান। কমার্শিয়াল বিভাগে কর্মী নিয়োগ করা হয়েছে। স্টেশনটির প্ল্যাটফর্ম উঁচু-নিচু। তাড়াহুড়োয় ওঠানামা করতে গেলে উল্টে পড়ার ভয়। কিন্তু চারপাশটা বেশ সুন্দর। প্ল্যাটফর্মের উল্টোদিকে বিশাল জলাভূমি। কান্দুয়ার জলা। লোকে বলে কেঁদোর জলা। এই জলায় এখনও কিছু বাঘরোল বেঁচে রয়েছে। তবে সংখ্যা অনেক কমেছে। লকডাউনে গিয়েছিলাম। তখন অস্তগামী সূর্য লাল রং ধরেছে। সেই লালের আভা পড়েছে জলার জলে। তিনজন জলায় মাছ ধরছে দেখলাম। ফাঁদি জাল পাতা ছিল। মাছ ঝেড়ে নিয়ে আবার জাল পেতে দিল তারা। একটা বাচ্চা মতো ছেলে কাছাকাছি ছিল। তাকে হাঁক দিলুম, ‘কী মাছ পেলে ভাই?’ মাথা তুলে তাকাল ছোড়া। কিন্তু কোনও উত্তর দিল না। হয়তো ক্যামেরা দেখে ঘাবড়ে গিয়েছে।
লকডাউনে একাকী স্টেশনকে তখন সঙ্গ দিচ্ছে কিছু আড্ডাধারী। আর খানদুই যুগল।
কভারের ছবি— মাজু স্টেশন। প্ল্যাটফর্মের সিঁড়ির কাছ থেকে তোলা।
ছবি— দীপশেখর ওরফে দীপু
(চলবে)