দীপক দাস

জালালসি— মল্লিকদের সেলুন কার
সে বহুদিন আগের কথা। তখনও আমাদের ‘যথা ইচ্ছা তথা যা’ গ্রুপ হয়নি। ওয়েবসাইটি তো আরও দূরের কথা। কিন্তু মাঝে মাঝে বাইক নিয়ে বেরোতাম আমরা। একবার বেরিয়েছিলাম আমি আর ইন্দ্র। মাজু পেরিয়ে রাস্তার পাশে একটা বাড়ি দেখে একটু থমকেছিলাম। বাড়ি না বলে প্রাসাদ বলাই ভাল। সেই বাড়ির গঠনরীতিতে চোখ আটকেছিল। অনেকটা চৈনিক রীতিতে তৈরি বাড়ি বলে মনে হয়েছিল। বা বৌদ্ধ মঠের মতো গঠন। পুরো বাড়ির নয়। বাড়িটার চুড়োয়। কেমন যেন প্যাগোডার ছাপ আছে বলে মনে হয়েছিল। পরে জেনেছিলাম, ওই বাড়িটি মল্লিকবাড়ি নামে পরিচিত।

জালালসি স্টেশনের কথা উঠলে মল্লিকবাড়ির প্রসঙ্গ আসবেই। এখনকার ইএমইউ আমলে নয়, সেই মার্টিন রেল চলার সময় থেকেই ট্রেনের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে বাড়িটি। সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি। জালালসির বর্তমান অবস্থা নিয়ে একটু চর্চা করা যাক। জালালসি নামের ইতিহাস খুঁজে পায়নি। কোথায় যেন পড়েছিলাম, জালাল শাহ থেকে জালালসি নামটির উৎপত্তি। কোথায় আজ আর মনে নেই। জালাল শাহের প্রসঙ্গ উঠলে স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন উঠবে, ইনি কে ছিলেন? সেই উত্তরও আমার অজানা। শুধু বলতে পারি, মার্টিন রেলের ইতিহাসেও জালালসি ছিল। ১৯৭১ সালে মার্টিন রেল বন্ধ হওয়ার সঙ্গেই রেলের মানচিত্র থেকে মুছে যায় জালালসি।

২০০৪ সালে মহেন্দ্রলাল নগর থেকে আমতা পর্যন্ত প্রসারিত হলে আবার জালালসি ফিরে আসে রেলের মানচিত্রে। আমার তেমন সম্পর্ক নেই স্টেশনটির সঙ্গে। কয়েকবার আমতা যাওয়ার সময়ে শুধু এর উপর দিয়ে গিয়েছি। লকডাউন পর্ব চলার সময়ে দীপুকে নিয়ে বেরিয়েছিলাম ছবি তুলতে। পরে ছোটা ডন অর্থাৎ বাবলা আর দলের অনিয়মিত সদস্য আমার ভাই দেবাশিস যোগ দেয়। যখন পৌঁছেছিলাম তখন প্রায় সন্ধে। আলো জ্বলা স্টেশনের রূপ অন্যরকম। তবে ঝুজকো আলোয় দেখা আর আগের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে বলতে পারি, জনপদের এক ধারে স্টেশন। লাইনের দু’পাশেই জলা জায়গা ছিল একসময়। এখন আমতার দিকে গেলে ডানপাশে সেই জলার দিগন্ত চোখে পড়ে। এটা হল্ট স্টেশন। কমিশন এজেন্ট ভিত্তিক চলে। লোকজন কী রকম ওঠে ঠিক জানি না। মানে একদিনের সফরে বেশি তথ্য জোগাড় করতে পারিনি।
তবে জালালসির রেল আর মল্লিকবাড়ির যোগাযোগের একটি ইতিহাস খুঁজে পেয়েছি। ঘরে বসেই। মল্লিকরা ছিলেন ব্যবসায়ী। লালবাজারের কাছে তাঁদের উলের দোকান ছিল। ১৯৬৫-৬৬ সালের কথা। মল্লিকবাড়ির এল মল্লিক তখন ব্যবসার প্রধান ছিলেন। কলকাতাতেই থাকতেন। তিনি যখন দেশের বাড়ি ফিরতেন তখন মার্টিন ট্রেনের সঙ্গে তাঁর সেলুন কার জুড়ে দেওয়া হত। সেই সেলুনকারটি জালালসি স্টেশনের কাছে কেটে রাখা হত। আমতা ফিরতি ট্রেন আবার সেই কার ঠেলে সরিয়ে নিয়ে যেত। জালালসিতে মার্টিন রেলের ক্রসিং ছিল। তবে এখন যেখানে হল্ট স্টেশনটি অবস্থিত সেখানে নয়। মার্টিন রেলের জালালসি স্টেশনটি ছিল তালপুকুরের কাছে।

মার্টিন রেল এক ব্যবসায়ীর পরিবারের জন্য কেন সেলুন কার দিত? বাঁকড়ার জাপানি গেটে মার্টিন রেলের ওয়ার্কশপ ছিল। ওয়ার্কশপটি গড়ে উঠেছিল মল্লিকদের জমিতে। সেই জমি মার্টিন রেলের মালিক বীরেন মুখার্জিকে লিজ দিয়েছিলেন এল মল্লিক। শোনা কথা, তার জন্য অর্থ নেননি। এই তথ্য পেয়েছি আমার বাবার কাছ থেকে। মার্টিন রেলের অনেক গল্প বাবার কাছ থেকে শোনা। এই গল্পটিও। আমার ঠাকুর্দা ছিলেন মার্টিন রেলের গ্যাংম্যান। রেল বন্ধ হওয়ার পরে ঠাকুর্দা মধ্যপ্রদেশে রেলের কাজ পান। বাবা ঠাকুর্দাকে প্রায়ই খাবার দিতে যেত। যেখানে ঠাকুর্দার ডিউটি থাকত। ফলে অনেক ঘটনার সাক্ষী। আবার অনেক ঘটনা শোনা।
দক্ষিণ-পূর্ব রেলও মল্লিকবাড়িকে গুরুত্ব দিয়েছে। পাকা সড়ক থেকে জালালসি স্টেশনের দিকে যাওয়ার মুখেই রয়েছে মল্লিকবাড়ি লেখা বোর্ড।
হরিশদাদপুর— মামলার স্টেশন

দু’টো জায়গার নামে একটা স্টেশন। হরিশপুর এবং দাদপুর। মার্টিন রেলের সময় থেকেই হরিশদাদপুর নামে স্টেশন ছিল। কেন স্টেশনটি দু’টো গ্রামের নামে? তথ্যের জন্য বেশ কয়েকজনের দ্বারস্থ হয়েছিলাম। কিন্তু মেলেনি। হাওড়া-আমতা রুটে আমাদের নিত্যযাত্রী পিনাকী দত্ত। মহেন্দ্রলাল নগর থেকে ওঠেন। বাড়ি ধসায়। পিনাকীদা ওঁর জেঠু সুজনকুমার দত্তের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন, ওই এলাকায় হরিশপুর আর দাদপুর নামে দু’টো গ্রাম রয়েছে। দুই গ্রামের বাসিন্দারাই দাবি করেছিলেন, তাঁদের গ্রামের নামে স্টেশন হতে হবে। দাবি নিয়ে মামলা হয়। শেষ পর্যন্ত আদালতের নির্দেশে স্টেশনের নাম হয় হরিশদাদপুর। গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা বলেই মনে হয়েছে। রেলের ইতিহাসে এরকম দুই গ্রামের দাবিতে স্টেশনের বিরাট নামের উদাহরণ প্রচুর। হাওড়া-খড়্গপুর শাখাতেই রয়েছে নারায়ণ-পাকুড়িয়া-মুরাইল। সে আবার তিন গ্রামের নামে।

দীপুর বাবা শিবনাথ জেঠু জানালেন, আমতা ১ নম্বর ব্লকে পড়ে হরিশদাদপুর। এখানে হরিশপুর আর দাদপুর দু’টো আলাদা গ্রাম রয়েছে। সন্ধেবেলায় চারজনে পৌঁছে গিয়েছিলাম স্টেশনে। দীপু, আমি, বাবলা আর রাজা। আলো জ্বালা স্টেশনে তখন আড্ডা জমেছে বেশ। একটি বাচ্চাকে নিয়ে হাজির হয়েছিলেন বাবা। বাচ্চাটির হাতে তেলেভাজার ঠোঙা আর জিভে অনেক জিজ্ঞাসা। আমরা কেন ছবি তুলছি? কী হবে ইত্যাদি প্রশ্ন। হরিশদাদপুরের অপুকে প্ল্যাটফর্মে ওঠার সিঁড়িতে দাঁড় করিয়ে ছবি তোলানো হল। অপুর জিজ্ঞাসা শেষ। এই স্টেশনটিও জালালসির মতো। জলার পাশে। হরিশদাদপুরের পরের স্টেশনই আমতা। মার্টিন রেল চলার সময়ে জালালসি আর হরিশদাদপুরের মাঝে আরেকটা স্টেশন ছিল। পানপুর। দক্ষিণ-পূর্ব রেল পানপুর স্টেশনটি আর করেনি।

আমতা— ইতিহাসের স্টেশন
সত্যি কথা বলতে কী, আমতা স্টেশনের কোনও ইতিহাস হয় না। শুধু নামটাই যথেষ্ট। কারণ আমতা নিজেই একটা ইতিহাস। এক সমৃদ্ধ ইতিহাসের অধিকারী এই আমতা। শুধুমাত্র মধ্যযুগের সাহিত্য ও নথিপত্রে যা উল্লেখ পাওয়া যায় তা-ই যথেষ্ট। এই জনপদের ইতিহাস আরও পুরনো। স্টেশনের ইতিহাস লিখতে বসে তার অবতারণার সুযোগ নেই। তবুও মুখবন্ধে এটুকু দরকার ছিল। আমতায় সেই ১৮৯৭ সাল থেকে ট্রেন চলছে। ১৯৭১ সালে বন্ধ হয় মার্টিন রেল। তার পর আবার চালু ২০০৪ সালে। দক্ষিণ-পূর্ব রেলের হাওড়া-আমতার শাখার শেষ স্টেশন আমতা। দু’টো প্ল্যাটফর্ম। প্রস্তাব অনুযায়ী, আমতা থেকে বাগনান পর্যন্ত রেলপথ সম্প্রসারণ হওয়ার কথা। তা হলে নতুন ইতিহাস তৈরি হবে।

আমতা ঘুরতে এলে হতাশ হতে হবে না। দামোদর নদের অববাহিকায় অবস্থিত জনপদটির প্রকৃতি অসাধারণ। এখানেই রয়েছে কয়েক শতাব্দী প্রাচীন মেলাইচণ্ডীর মন্দির। এখনকার আমতার অন্যতম পরিচয় এই মন্দির। ‘বর্তমান’ পত্রিকায় ফ্রিল্যান্স করার সময়ে মেলাইচণ্ডীর ইতিহাস সংগ্রহ করেছিলাম। সে ইতিহাস জানিয়েছিলেন মেলাইচণ্ডী দেবোত্তর এস্টেটের সম্পাদক বিশ্বনাথবাবুর কাজ থেকে। কিন্তু তাঁর পদবি ভুলে গিয়েছি। পুরনো কাগজটি পেয়েছি। ২০০৪ সালের ৫ নভেম্বর প্রকাশিত। কিন্তু বিশ্বনাথবাবুর পদবির কাছেই পোকায় কাটা। গড়বালিয়া রাখালচন্দ্র মান্না ইনস্টিটিউটের শিক্ষক তপন হুদাতি জানাচ্ছেন, বিশ্বনাথবাবুর পদবি সরখেল। বিশ্বনাথবাবুর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সওদাগরেরা দামোদর নদের তীরে কোনও জায়গায় মেলাইচণ্ডীকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তখন দামোদর দিয়ে বাণিজ্য হত। আমতায় বন্দর নামে একটি জায়গা এর প্রাচীনত্বই প্রমাণ করে। পরে জটাধারী চক্রবর্তী নামে এক পুরোহিত স্বপ্নাদেশ পেয়ে জয়ন্তী গ্রাম থেকে চণ্ডীকে আমতায় নিয়ে আসেন। প্রথমে ময়রা পাড়ায় নিজের বাড়ির কাছে চণ্ডীকে স্থাপন করেন। বহু পরে কলকাতার হাটখোলার লবণ ব্যবসায়ী কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত স্বপ্নাদেশ পেয়ে মেলাইচণ্ডীর মন্দির তৈরি করে দেন। কেউ বলেন, সতীর মালাইচাকি এখানে পড়েছিল। কারও মত, ‘মেলার চণ্ডী’ থেকে এমন নামের উৎপত্তি। কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তীর কাব্যে মেলাইচণ্ডীর উল্লেখ রয়েছে।

ঘুরতে এসে আমতা বাজারে চেখে নিতে পারেন এখানকার বিখ্যাত পান্তুয়া (মিষ্টিমহলের-আনাচে-কানাচ)। স্বাদে যে কোনও বিখ্যাত পান্তুয়ার সঙ্গে টেক্কা দেবে। তবে পান্তুয়া খেতে হলে আসতে হবে সকালের দিকে। দুপুর বারোটার আগেই শেষ হয়ে যায় সব। আর খাবেন অবশ্যই চরিতদের দোকান থেকে। ওঁরাই সুনামটা ধরে রেখেছেন।

আর হ্যাঁ, এই এলাকায় রয়েছে ছোট কলিকাতা (হাওড়ার কলকাতা) নামে এক জনপদ। বিনয় ঘোষ তাঁর ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ বইয়ে ছোট কলিকাতাকে রাজধানী কলকাতার সমসাময়িকই বলেছেন।
কভারের ছবি— জালালসি স্টেশন।
(চলবে)
অসাধারণ।
ধন্যবাদ রবিদা।