দীপক দাস
দানাদার কখনও উপমা হতে পারে! না বোধহয়। উপমা হতে গেলে গুণ লাগে। রূপ-রস-গন্ধের গুণ। সংস্কৃত সাহিত্য থেকে একগাদা উদাহরণ দেওয়া যায়। দাড়িম্বদানার মতো দন্ত, পক্ব বিম্বোধরোষ্ঠী, চন্দনের সুবাস ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু দানাদারের এমন কোনও গুণ নেই। মিষ্টিমহলে দানাদার তেমন অভিজাত নয়। মিষ্টি নিয়ে সাহিত্যে কোনও উপমা নেই। থাকলেও আমার জানা নেই। যদি থেকেও থাকে নিশ্চিত, তাতে দানাদারের জায়গা মিলবে না।
বাংলা সিনেমার গানে অবশ্য মিষ্টির উপমা আছে। সেই যে একসময়ের পুজো প্যান্ডেল কাঁপানো গান, চিরঞ্জিৎ-দেবশ্রীর? তাতে চমচমের মতো গাল আছে, সন্দেশের মতো মন আছে। কিন্তু দানাদার নেই। আমার জীবনে দানাদার গুরুত্ব পেয়েছিল উপমিত হয়েই। ইস্কুল জীবনের ঘটনা। উঁচু ক্লাসের দাদারা কিছু একটা নিয়ে গল্প করছিল। সম্ভবত কোনও খারাপ রাস্তায় যাত্রার বর্ণনা। এতই এবড়োখেবড়ো রাস্তা যে যাত্রীরা গাড়িতে একবার এপাশ আরেকবার ওপাশ হচ্ছিল। এক দাদা সেই এপাশ ওপাশের তুলনা দিয়েছিল। বলেছিল, বড় একটা মিষ্টির বাক্সে মাত্র দু’টো দানাদার রেখে বাক্সটা হাতে নিয়ে হাঁটলে মিষ্টি দু’টো যেমন গড়গড় করে এপাশ ওপাশ করবে সেরকমই হচ্ছিল গাড়ির ভিতরে।
এই উপমা শোনার আগে অবশ্যই দানাদার খেয়েছি। স্বাধীনতা দিবসে পতাকা তোলার শেষে খেয়েছি। ইস্কুলে টিফিনে পাউরুটির সঙ্গে মিষ্টি খেতে গেলে দানাদারই সস্তা পড়ত। কিন্তু ওই উপমার পরে দানাদার আমার কাছে গুরুত্ব পেতে থাকে। এই দু’দিন আগে মিষ্টিটা আবার গুরুত্ব পেল। অনেকদিন পরে ঘুরতে বেরনো হয়েছিল। ফেরার পর সেদিনই আবার ছোটভাইয়ের শখ হয়েছিল নতুন পদ্ধতিতে মাংস ভাজা খাওয়াবে। কিন্তু ওর যা ছড়ানো স্বভাব! দই কিনে আনতেই ভুলে গিয়েছিল। দ্রুত আনতে হবে দই, এমন কড়া নির্দেশ দিয়ে আমাকে আর ইন্দ্রকে বাজার পাঠাল রাজা। আমরাও তাড়াহুড়োর কারণে বড়গাছিয়ায় চেনা দোকানে না গিয়ে সামনে যে দোকান পেলাম তাতেই থামলাম। দই কেনার সময়েই চোখে পড়েছিল মিষ্টির একটা ট্রের উপরে। দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করতে বললেন, দানাদার। ‘মিষ্টিমহলের আনাচে কানাচে’ ঘুরে প্রচুর নামী মিষ্টি চেখেছি। কিন্তু দানাদারের মতো অনভিজাত মিষ্টি বহুদিন খাওয়া হয়নি। ইন্দ্রকে বললাম, ‘‘খাবি?’’ ও আর ওর শিষ্য শুভ অর্থাৎ আমাদের গার্ডবাবু খাবার কথা কখনও সরাসরি বলতে পারে না। নানারকম সঙ্কেত ছাড়ে। সেই সঙ্কেত ডি-কোড করতে হয় আমাদের। ইন্দ্রর সঙ্কেত ডি-কোড করে পেলাম, ও দানাদারেচ্ছু।
দইয়ের সঙ্গে দলের সকলের জন্যই কিনলাম দানাদার। এবং খেয়ে সকলেই বলল, অন্যরকম। আমাদের মা পর্যন্ত বলল, ‘‘ভাল।’’ সত্যই ভাল ছিল দানাদার। এবং বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। দানাদারটা খুব নরম। সাধারণত দানাদার একটু শক্ত হয়। ছানার গোল্লার উপরে চিনির রসের খরখরে প্রলেপ। ইস্কুলের দাদারা কেন দানাদারের উপমা দিয়েছিল? এই খরখরে, শক্ত ভাবের জন্যই। অন্য মিষ্টি কাগজের বাক্সে এতটা গড়াত না। রসের কারণে হয় ধীর গতিতে, নীরবে চলত (পান্তুয়া)। না হলে থেপসে বসে যেত (চমচম)। একটু তুলনা টানি। তাহলে সাধারণ দানাদারের সঙ্গে নতুন খাওয়া দানাদারের পেলবতা বোঝা যাবে। ধরে নেওয়া যাক, সাধারণ দানাদার ডালবড়ার মতো শক্ত। আর নতুন দানাদার ডিমের ডেভিলের মতো। ডালবড়া ভাঙতে চিনের বাদামের খোলা ফাটানোর মতো চাপ দিতে হয় না। তবে ডেভিলের থেকে বেশি চাপ লাগে। দানাদারের ভিতরের অংশের মূল উপকরণ ছানা। তার সঙ্গে সুজি, ময়দার মিশেল থাকে।
দানাদার এমন পেলব কেন? তাহলে কি দানাদার রূপ বদল করেছে? আমাদের এলাকায় নতুন দানাদার তৈরি শুরু হয়েছে? খোঁজ নিতে মঙ্গলবার বেরিয়ে পড়া গেল। অন্যদের সময় নেই। শুধু ইন্দ্র রাজি হল। প্রথমে গেলাম বাড়ি থেকে কিলোমিটার ছ’য়েক দূরে মুন্সিরহাটে। ফণী কুণ্ডুর দোকানের নাম আছে। দানাদার নেওয়া গেল। দেখা গেল গতানুগতিক ছাঁদ। উপরে চিনির রস দানা দানা হয়ে বসে রয়েছে। ভিতরে নরম আর নানা আকারের কুঠুরি। সেই কুঠুরি রসে ভরা। তার এলাম মুন্সিরহাট বাসস্ট্যান্ডে। লাভলি সুইটসের দানাদার খেয়ে দেখলাম। একই রকম। এর পর বড়গাছিয়ায়। শ্রীহরি মিষ্টান্ন ভাণ্ডার বেশ পুরনো দোকান। দোকানের মালিককে জেঠু বলি। দানাদার খাওয়া গেল। একই রকম ছাঁদ। তবে খেতে বেশ ভাল। এলাচ দানা দেওয়া। জেঠুর কাছ থেকে একটু দানাদারের গল্প শুনলাম। দানাদারে মূলত মোটা রস ব্যবহার করা হয়। জ্বাল দিয়ে বিশেষ কায়দায় একটু দানা দানা করা হয় রস। আর যে কোনও মিষ্টি তৈরি নির্ভর করে পাকের উপরে।
কিন্তু আজকের মিষ্টি সফরে সবই তো সাবেক দানাদার। তাহলে এই এলাকায় পেলব দানাদার এল কোথায়? আবার হাজির হলাম সেই দোকানে। অন্নপূর্ণা সুইটস। দোকানটা একেবারেই হালফিল হয়েছে। বছর দুই-তিন হবে। কিন্তু দোকানে সেই কাকুটা নেই। যিনি দোকান সামলাচ্ছিলেন তিনি বললেন কারখানায় আছেন। গেলাম কারখানায়। মালিকের নাম রাম দোলুই। তিনি তখন বিশাল কাঠের বারকোশে রসগোল্লার গোল্লা পাকাতে ব্যস্ত। বাড়ি পাতিহালের দু’টো গ্রাম পরে গড়বালিয়ায়। রামবাবু পেলবতার উৎস খোলসা করলেন। জানালেন, তাঁরা চিনির পাতলা রস ব্যবহার করেন। আর গোল্লা পাকানোয় বিশেষ পাক রয়েছে। রয়েছে উপাদানের বিভিন্ন ভাগও। সেই পাক ও ভাগ যাঁরা মিষ্টি করেন তাঁদের বোঝানো যাবে। রামবাবু জানালেন, সাবেক দানাদার তৈরিতে অনেকে নাগাড় রস ব্যবহার করেন। শব্দটা ঠিক বোঝা গেল না। উনি বললেন, নাগাড় রস মানে পুরনো রস। কিন্তু জগৎবল্লভপুর ব্লকে আগে কখনও এই নরম দানাদার দেখা যায়নি। এল কোথা থেকে? রামবাবু জানালেন, তিনি ১১ বছর বয়স থেকে মিষ্টির দোকানে কাজ করছেন। কলকাতায় বেশ কিছু নামী দোকান-সহ অন্তত ৪৫টি দোকানে কাজ করেছেন। সাবেক দানাদার কিরকিরে মিষ্টি। কিন্তু রামবাবুর নরম দানাদার তেমন নয়। এখন কম মিষ্টি মিষ্টির চল হয়েছে। সে কারণেই হয়তো এমন দানাদার তৈরি। রামবাবু জানালেন, নরম দানাদার বেশিদিন রাখা যায় না। কিন্তু মোটা রস ব্যবহার করলে দানাদার অনেকদিন থাকে।
আমারও ধারণা, দানাদার বাংলার আদি মিষ্টিগুলোর মধ্যে অন্যতম। অন্তত ফ্রিজ পূর্ববর্তী যুগের। ছানার মিষ্টি বেশিদিন রাখা যায় না। কিন্তু দানাদার ফ্রিজ ছাড়াও বাড়িতে কয়েকদিন রাখা সম্ভব। শুধু বাড়িতে এনে প্যাকেট থেকে বের করে বাটিতে সাজিয়ে নিতে হবে। তার পর সেই বাটিটা একটা জলভরা থালায় বসিয়ে রাখতে হবে। ঢাকা হিসেবে চুপড়ি জাতীয় কিছু ব্যবহার করা উচিত। যাতে হাওয়া চলাচল করে। সম্ভবত ফ্রিজ পূর্ববর্তী যুগে এবং চিড়ে-গুড়-কদমার পরবর্তী যুগে দানাদার এমন ভাবেই রাখা হত সম্পন্ন বাড়িতে। সবটাই অনুমান। তার পর একসময়ে নানা রকমের মিষ্টির আবির্ভাব হল। দানাদার পিছু হঠতে শুরু করল। যেমন কদমা-বাতাসারা হটেছে। অনভিজাত হয়ে পড়ল দানাদার।
হ্যাঁ, এখনও দানাদার অন্য মিষ্টির তুলনায় দামে সস্তা। তিন-চার টাকা। একটার দাম।
এই সফরের বেশ কিছুদিন পরে গুপ্তিপাড়ায় গিয়েছিলাম। সেখানে বড়বাজার রথতলায় জনপ্রিয় মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে এক রকমের দানাদার পেলাম। আকারে বেশ বড়। উপরে চিনির রসের মোটা পরত। খেতে একটু অন্যরকম। তবে অন্য দানাদারগুলোর মতো লাগল না।
কভারের ছবি: অন্নপূর্ণা সুইটসের নরম দানাদার।
(সমাপ্ত)