তনয় শীল

মহালয়ার ভোরে, ‘বাজলো তোমার আলোর বেণু’ শুনে ঘরে আর মন টিকল না। সকাল ১০ টায় আমি, তিন বন্ধু রাজু বাইল, শিবম বাইল ও সৌভিক বাইল পূর্ব বর্ধমানের ‘ধাত্রীগ্রাম’ থেকে দুটি বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম শরতের খোঁজে। পকেটে নিলাম স্যানিটাইজার, হাতে গ্লাভস, মুখ ঢাকলাম মাস্ক দিয়ে। এই সময়ের সতর্কতা আরকী। গুগলম্যাপ অনুসরণ করে ৩৬ কিমি বাইক চালিয়ে দুপুর ১২টা নাগাদ পৌঁছলাম গন্তব্যে।

শরতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে ঘুরে আসতে পারেন ‘পাল্লা রোডের’ দামোদরের চরে। হাওড়া-বর্ধমান কর্ড লাইনের একটি ছোটো স্টেশন ‘পাল্লারোড’। স্টেশন থেকে কিছুটা দূরেই কাশবনে সুসজ্জিত দামোদরের চর। এমনিতেই করোনা আবহ ও লকডাউনের জেরে দীর্ঘদিন গৃহবন্দি। আনলক শুরু হলেও করোনা ভয় এখনও না কাটায় বেড়াতে যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি। ক্যালেন্ডার বলছে কিছুদিন বাদেই দুর্গাপুজো। কিন্তু পুজোর আমেজটা এ বছর করোনা গ্রাস করে নিয়েছে। প্রকৃতিতেও যেন শরতের ছোঁয়া নেই। শরৎও যেন গৃহবন্দি, প্রকৃতির সঙ্গে মিশতে পারছে না। মা দুর্গাও হয়তো তাই এ বছর দেরিতে আসছেন। মহালয়ার ১ মাস পর। কিন্তু জাতটা যেখানে বাঙালি। মায়ের আসার পথ চেয়ে সবাই বসে আছে। মা দুর্গা এসে নিশ্চয়ই করোনাসুরকে বধ করে আমাদের করোনামুক্ত পৃথিবী ফেরত দেবে।

এখানে প্রকৃতি শরতের সাজে সেজে উঠেছে। দামোদর নদ, যা ‘বাংলার দুঃখ’ নামে পরিচিত। কারণ বর্ধমান, হুগলি, হাওড়া ও মেদিনীপুর জেলার অনেকাংশ এই নদের বিধ্বংসী বন্যায় প্লাবিত হয়। কিন্তু শরতে সেই নদের চরের সৌন্দর্য অপরূপ। লাল বালির নদ দামোদর। গঙ্গায় যেমন সাদা বালি থাকে, দামোদরে আছে লাল বালি। দামোদরের স্রোত, লাল বালির চর, সাদা কাশের বন, নীল আকাশ, পেঁজা তুলো মেঘ, লাল পানিমরিচ ফুল, আাশেপাশের জলাশয়গুলিতে প্রস্ফুটিত লাল, নীল ও সাদা শাপলা, প্রকৃতির এক অন্য মেজাজ। পাশেই ভেসে আসছিল ঢাকের শব্দ। মহালয়া উপলক্ষে স্থানীয় কোনও পুজো ছিল বোধহয়। ইউটিউবে চালিয়ে দিলাম বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়া গান সমগ্র। আহা! মহালয়ার দিনে এর থেকে ভাল ভ্রমণীয় স্থান আর কোথাও পাবেন না। এই তো খোঁজ পেয়েছি সেই হারিয়ে যাওয়া শরতের। যার খোঁজে বাড়ি থেকে বেড়িয়েছিলাম।

লোকজনের যাওয়া আসা ভালই আছে। নৌকা চেপে নদী পারাপার করছেন। জেলেরা মাছ ধরছেন। স্থানীয়রা নদীতে স্নান করছেন। নদীতে বাঁধা আছে ছোটো, বড়, মাঝারি বিভিন্ন আকৃতির নৌকা। আশেপাশে অনেক শশ্মানঘাটও রয়েছে। বনভোজনের জন্যও এক উত্তম স্থান। শীতকালে অনেকেই এখানে বনভোজনের জন্য আসেন।
নৌকা চেপে ঘুরলাম নদীর এপার থেকে ওপার। ওপার থেকে এপার পরপর কাশবন। দুপুর ২টো নাগাদ দামোদরেই স্নান সারলাম। দুপুরে খাওয়ার জন্য সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম বাড়িতে রান্না করা বিরিয়ানি, চিকেন চাপ এবং টক দইয়ের সরবত। তাই দিয়েই মধ্যাহ্নভোজ সারলাম। করোনা আবহে বাইরের খাবার খাওয়া থেকে যতটা দূরে থাকা যায়। এখানে আশেপাশে খাবারের দোকান একদমই নেই। তাই সঙ্গে করে খাবার নিয়ে যাওয়াই ভাল।

ধীরে ধীরে বিকেল গড়াল। পড়ন্ত সূর্যের কমলা রঙে চারিদিক রঙিন। ঘড়ির কাঁটা জানাল এবার বাড়ি ফেরার সময়। বাইকে স্টার্ট পড়লো।
প্রকৃতি তখন গাইছে ঘরে ফেরার গান।

ছবি— লেখক।
(সমাপ্ত)