দীপক দাস
ফোনে সাবধান করে দিল দীপু। মিষ্টি খাওয়ার সময়ে একদম কথা বলা যাবে না। গলায় আটকে যেতে পারে। এমন কথা শুনে থমকাতেই হয়। এ কেমন মিষ্টি! রসগোল্লা, পান্তুয়া খাওয়ার সময়ে কথা বলতে নেই। এ কথা জানি। কিন্তু এ মিষ্টি সম্পর্কে যেটুকু জেনেছি তাতে তো রসের কোনও ব্যাপার নেই। তাহলে!
মনে একগাদা বিস্ময় নিয়েই বাইক ছুটেছিল খানাকুলের দিকে। তবে বিস্ময় যত না ছিল তার থেকে বেশি ছিল খুঁজে বার করার আনন্দ। খোঁজটা মিলেছিল হঠাৎই। মাঝে মাঝেই প্রণব রায়ের ‘বাংলার খাবার’ বইটা নেড়েচেড়ে দেখি। কাজের সুবিধের জন্য। আবার কখনও মনোরসনার তৃপ্তিতেও। করোনা অতিমারিতে বাইরের খাবার চেখে দেখতে তো ভুলেই গিয়েছি। বইয়ে পড়ে পুরনো দিনের মিষ্টিমহলে কাল্পনিক ঘোরাঘুরিতে মনোরসনা তৃপ্ত করি। ‘বাংলার খাবার’এই মিলেছিল কারকাণ্ডা নামে মিষ্টান্নটির সন্ধান। মোয়ার বিভাগে পড়ে কারকাণ্ডা। খানাকুলে আমরা দু’বার গিয়েছি। রাধানগরে রাজা রামমোহন রায়ের জন্মভিটে স্পর্শ করে নিজেদের ধন্য করতে। কিন্তু তখন তো এমন মিষ্টির কথা শুনিনি।
কার কাছে সন্ধান মিলতে পারে? মিষ্টিমহলে ঘোরাঘুরির অভিজ্ঞতা বলে, পুরনো মিষ্টির অভিযানে গেলে আগে থেকে খোঁজখবর করে যাওয়া উচিত। কিন্তু কার থেকে খোঁজ নেব? দু’দিন ভাবতে মাথায় এল মৌসুমীর কথা। মৌসুমী আদক। আমাদের মিস্টার ঘাসপুস দীপুবাবুর বন্ধু। আমাদের গ্রুপের সদস্য। মনে পড়ল, দীপু একবার বলেছিল, মৌসুমীর বাড়ি খানাকুলে। দীপুকে খোঁজ নিতে বললাম। ওর আজকাল ফুটনোট দেওয়া স্বভাব হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিল, ‘খুঁজে পাবে? বোধহয় নয়’। রেগে উঠেছিলুম। হাতের কাছে পেলে থাবড়ে দিতুম। রাগ চেপে বললুম, ‘আগে বলে দেখ।
যদিও প্রথমে নেতিবাচক উত্তরই এল। মৌসুমী জানাল, এ রকম কোনও মিষ্টির খোঁজ ও এলাকায় পাচ্ছে না। আমি উত্তর দিলুম, আরেকটু অপেক্ষা করা যাক। দীপুর আবার ফুটনোট, পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। বেশ হতাশ হয়ে পড়েছিলুম। এ কী রে বাবা! আরেকটা মিষ্টি বাংলা থেকে উধাও হয়ে গেল? মাজুর খইচুরের একেবারে অপভ্রংশ কিছু একটা পেয়েছিলুম। এখন তা-ও শেষ। পরে জানতে পারি, হুগলির ধনেখালিতেও খইচুর হত। বেশ নাম ছিল। এবার পুজোর সময়ে গিয়ে জানতে পারি, ধনেখালির খইচুরও অনেকদিন অগস্ত্য যাত্রা করেছে। সেই পথই কি ধরল কারকাণ্ডা? রামমোহন রায়ের এলাকার মিষ্টি হারিয়ে গেল। মন খারাপের মধ্যেই দীপুর মেসেজ এল, পাওয়া গেছে, পাওয়া গেছে। মৌসুমীর বাবার বন্ধু সন্ধান জানেন কারকাণ্ডার। তাঁর নাম মদন ঘাটা। মদনবাবু জানিয়েছেন, খানাকুল বাজারে একটা দোকানে কারকাণ্ডা হয়। অর্ডার দিলে তবেই বানিয়ে দেবেন। আর ৫০০ টাকা কিলো মিষ্টির।
দাম যাই হোক, কারকাণ্ডা অভিযান হবেই। মৌসুমী দোকানদারের ফোন নম্বর জোগাড় করে দিল। দোকানদারের নাম তরুণ মান্না। দীপু মিষ্টির অর্ডার দিল। চার কিলো। তরুণবাবুর ছেলেকে অনলাইনে এক হাজার টাকা পাঠাল দীপু। তার পর এক মঙ্গলবার আবার খানাকুল যাওয়ার মানসিক প্রস্তুতি শুরু। এবার বাবলা যাবে না। ওর দোকানে মালপত্র আসবে। যাত্রার শুরুর আগের দিন দীপু জানাল যেতে পারবে না। ওর গবেষণার গাইড মারা গিয়েছেন। ফলে ইন্দ্র, রাজা আর আমি।
কারকাণ্ডা অভিযানে নতুন পথে বাইক ছুটল। আগেরবার বারতিনেক নদী পেরোতে হয়েছিল। বাঁশের সাঁকো দিয়ে। একটা তো মুণ্ডেশ্বরীর বুকে। বিশাল দৈর্ঘ্যের বাঁশের সাঁকো। এবার একবারই নদী পেরোতে হল। ওই মুণ্ডেশ্বরী। সেই বিশাল বাঁশের সাঁকোর কিছু দূরেই পাকা সেতু হয়েছে। সে-ও বিশাল। এলাকার প্রকৃতি অসাধারণ। সে সব দেখতে দেখতেই রাধানগর পেরিয়ে খানাকুল বাজারে। ফোন করলাম তরুণবাবুকে। ফোন ধরলেন তাঁর স্ত্রী। জানালেন, তরুণবাবু আমাদের কাছে যাচ্ছেন। কিছুক্ষণ খোঁজের পরে তাঁর দেখা মিলল। দেখলাম, এক পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তি বিশাল একটি প্লাস্টিকের বালতিতে কিছু কয়েতবেল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আর আমাদের বারবার জিজ্ঞাসা করছেন, ‘‘কাকে খুঁজছেন আমাকে বলুন।’’ বললাম। উনি বললেন, ‘‘আমিই তরুণ মান্না।’’ তার পর হাজির হওয়া তাঁর দোকানে। সেদিন দোকান বন্ধ ছিল। খোলানো হল। কাঁসার বিশাল রেকাবিতে সাজানো হল কারকাণ্ডা। হ্যাঁ, ওই প্লাস্টিকের বালতির কয়েতবেলগুলোই কারকাণ্ডা।
ছবি তোলার পরে ইতিহাসের খোঁজ। কারকাণ্ডা কে আবিষ্কার করেছেন তা জানা যায় না। তবে প্রচলিত কাহিনি, এলাকার জমিদার রাজা রামমোহন রায়ের বাড়িতে পাঠানো হত কারকাণ্ডা। খানাকুলের এই ময়রা পাড়ার অনেকেই কারকাণ্ডা তৈরি করতে পারতেন। কিন্তু উপেন্দ্রনাথ রানা, জলধর রানা, নন্দলাল রানা, গোপীনাথ রানাদের দোকান আর নেই। বেঁচে আছে শুধু তরুণবাবুদের দোকান। এঁদের দোকান একশো বছরের বেশি পুরনো। দাদু অতুলচন্দ্র মান্না, বাবা শ্যামদাস মান্নার পরে তরুণবাবু হাল ধরেছেন। দোকানে সাহায্য করেন তাঁর ভাই অরুণও। আগে দোকানে রসের মিষ্টিও হত। এখন চিনির সন্দেশ, মুড়কি, চিড়ে এসব বিক্রি করেন। তবে কারকাণ্ডা বরাবরই তৈরি করেন। তরুণবাবু জানালেন, রাধানগর বাজারে দু’একটা মিষ্টির দোকানে কারকাণ্ডা তৈরি করে।
কারকাণ্ডা আসলে কী? মোয়াজাতীয় মিষ্টি। তরুণবাবু পুরো পাক প্রণালী জানালেন। এক কিলোগ্রাম কারকাণ্ডা তৈরি করতে খই লাগবে ৩৫০ গ্রাম। চিনি ৬০০ গ্রাম। ঘি ১০০ গ্রাম। ভাল ছোট এলাচ ২০টি, দারুচিনি পাঁচ গ্রাম, গোল মরিচ ২০ গ্রাম। গোলমরিচ বেশি হলে ঝাল হয়ে যাবে। খই জাঁতায় গুঁড়ো করে নিতে হয়। তার পর চিনি গালিয়ে রস করে সন্দেশ করতে হয়। মশলাগুলো হামানদিস্তা দিয়ে পিষে গুঁড়ো করে নিতে হবে। তার পর চিনির লেচির সঙ্গে মেশাতে হবে ঘি-মশলা। পুরোটা মাখিয়ে খইয়ের সঙ্গে দিতে হবে। এবার দু’হাতের তালুতে যতটা ধরে ততটা মাখা নিয়ে গোল করে পাকাতে হবে। এক কিলোতে ২০টির মতো কারকাণ্ডা তৈরি হয়।
শীতকালে কারকাণ্ডা এক মাস পর্যন্ত থাকে। বর্ষায় তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। বনেদি বাড়িগুলো আগে কারকাণ্ডা বরাত দিত। আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে পাঠানো হত, উৎসবে কাজে লাগত। সাধারণ পরিবারগুলোও বিয়ের তত্ত্বে বা অন্য কোনও অনুষ্ঠানে কারকাণ্ডা রাখতেন। এখন খানাকুলের লোকেই কারকাণ্ডা ভুলেছেন। মাঝে মাঝে কেউ কেউ বিয়ের তত্ত্বের জন্য তরুণবাবুকে বরাত দেন। আমরা যখন দোকানে ছিলাম তখন স্থানীয় বাসিন্দা মৃন্ময় ঘোষ উপস্থিত ছিলেন। তিনিও কারকাণ্ডা আত্মীয়ের বাড়ি পাঠানোর কথা বলছিলেন। কিন্তু এমন একটি মশলাদার, অভিজাত মিষ্টান্ন হারিয়ে যেতে বসেছে কেন? একটা কারণ অবশ্যই সময়ের ব্যাপার। অনেক সময় লাগে তৈরি করতে। তরুণবাবু বলছিলেন, কারকাণ্ডা তৈরিতে ঘি আর খইয়ের মান ঠিকঠাক হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। আগে কনকচূড় ধানের খইয়ে কারকাণ্ডা হত। খইচুর হত। মুকুন্দ নামে আরেকটি মিষ্টিও হত। কিন্তু সুগন্ধী কনকচূড় ধান এখন চাষই হয় না। যেটুকু হয় তা চলে যায় জয়নগরে মোয়া তৈরির জন্য। ফলে এখন কারকাণ্ডায় খইয়ের সেই সুগন্ধ থাকে না। তা ছাড়া গরম খই জাঁতায় পেষাই করলে কারকাণ্ডা ভাল হয়। সেই জন্য আগে ময়রারা বাড়িতে খই ভাজাতেন। গরমাগরম চূর্ণ করে নিতেন। বাড়িতে খই ভাজার চল বহুদিন উঠে গিয়েছে। গাওয়া ঘি ভাল মেলে না। ফলে কারকাণ্ডার মান পড়েছে। কারিগরও এখন পাওয়া যায় না তেমন।
কেমন খেতে কারকাণ্ডা? একটা কথা বলে রাখা ভাল, যাঁরা খাবারে বেশি মশলার গন্ধ সহ্য করতে পারেন না তাঁদের খুব একটা ভাল লাগবে না। কারকাণ্ডা মিষ্টির জগতে এক অন্যরকম সৃষ্টি। মিষ্টি শুনলে যে ধারণা জন্মায় বা মোয়া বললে যে স্বাদের স্মৃতি মনে ভাসে তার সঙ্গে মিলবে না কারকাণ্ডা। খেতে সময় লাগে। আর খাওয়ার সময়ে কথা বলা উচিত নয়। খই খুব মিহি করে গুঁড়োনো হয়। শ্বাসনালীতে ঢুকে যেতে পারে। তরুণবাবু জানালেন, দুধে ফেলে খাওয়া যায়। দোকানে আমরা তিনজন চেখে দেখলাম। মশলার গন্ধে ম-ম করছিল দোকান।
কারকাণ্ডা প্লাস্টিকের তিনখানি বয়ামে ভরে ফেরার প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল আমাদের। মনে হচ্ছিল দ্রুততার এই যুগে কারকাণ্ডার আয়ু বেশিদিন নয়। তরুণবাবুরাই হয়তো কারকাণ্ডার কারিগরদের শেষ প্রজন্ম। ও হ্যাঁ, কেন মিষ্টিটার এমন নাম বলা হয়নি। তরুণবাবু এক জনশ্রুতির কথা বললেন। যিনি প্রথম কারকাণ্ডা তৈরি করেছিলেন তিনি তাঁর আবিষ্কার জমিদারের রসনার তৃপ্তিতে ভেট দিয়েছিলেন। সুগন্ধী, বিশাল গোল্লার সেই মিষ্টান্ন দেখে জমিদার নাকি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘কার কাণ্ড?’’ সেই থেকেই মিষ্টির নাম কারকাণ্ডা।
ছবি- ইন্দ্রজিৎ সাউ ও দেবাশিস দাস
(সমাপ্ত)
বাহ!!!
রান্নার পদ্ধতিটা শুনে বোঝা যাচ্ছে রান্নার প্রতি কতটা যত্নশীল আর ভালোবাসা থাকলে এই পদ তৈরী সম্ভব।
আমরা তো সাধারন খই খাই, উনি ভেবেছিলেন যে এইভাবে খই দিয়ে একটা সুস্বাদু মিষ্টিও বানানো যায়।
খই একসময়ে বাঙালির মিষ্টি তৈরির অন্যতম উপকরণ ছিল। কালের নিয়মেই সে তার জায়গা হারিয়েছে।
লেখা পড়ে খুব ভালো লাগলো। খানাকুল বাজারে খুব শীঘ্রই যেতে হচ্ছে করকান্ডা খেতে
ঘুরে আসুন। তবে খানাকুল বাজারে সবসময় করে না কারকাণ্ডা। অর্ডার দিতে হয়।
কারকাণ্ডা…. দেখব যদি সুযোগ হয়। খুব ভাল স্বাদ হয়েছে খই, ঘি আর ইতিহাসে….
ভাল লাগল দাদা। আমাদের ভাল লেগেছে মিষ্টিটা খুঁজে পেয়ে।
কারকাণ্ডার সঙ্গে একটা মিষ্টির নাকি মিল রয়েছে। আমার এক আত্মীয়া সেটি খেয়ে জানিয়েছেন, এটি তাঁদের এলাকায় লাবণ নামে পরিচিত। অনেকে বাড়িতেও তৈরি করেন। তবে সেই লাবণ আমাদের এখনও চেখে দেখার সুযোগ হয়নি।
লেখাটি সুমিষ্ট ও মশলাদার, কারকাণ্ডার মতোই।
কমেন্টটাও। একজন লেখকের কাছে।
এই মিস্টির নামটা জানতাম না ।। খুব ভালো লাগলো ।। পুরোটা মনে দিয়ে পড়লাম ।।
অনেক ধন্যবাদ। আমাদের খোঁজা এবং অভিযান সার্থক হল।