দীপক দাস
তালবোনা যাওয়ার রাস্তার দিকে আঙুল দেখিয়ে ভদ্রলোক বলছিলেন, ‘‘ওই যে হলুদ রঙের বাড়িটা দেখছেন, ওটাই তো রেললাইনের উপরে তৈরি।’’ বেরিয়ে পড়ো। কিন্তু রাস্তায় অবশ্যই কথা বলো। আমাদের দলের দুই নীতি। সেই নীতি যে কতটা কার্যকর তার প্রমাণ পেলাম ওই আঙুল দেখানোতেই। আমাদের কাছে অজানা এক ইতিহাসের দরজা খুলে দিয়েছিল সেই আঙুলটি।
এবারের সপ্তমী। অতিমারির চোটে পুজোর চারদিন মাঠে মারা যাচ্ছিল আরকী। বহু বছর পরে এই প্রথমবার আমরা পুজোয় বাড়িতে রয়েছি। কিন্তু একেবারেই কি গৃহকোণে চুপটি করে কাটিবে? সহ্য হবে না। হয়তো ‘দর্দে দিল দর্দে জিগর’ হতে পারে। তাই বেরিয়ে পড়া। কয়েকটি জায়গা খোঁজা হয়েছিল। দীপু প্রস্তাব দিল, ধনিয়াখালি যাওয়ার। ওখানকার শাড়ির ইতিহাস আমরা জানি না। আর এরকম অভিযান আমাদের হয়নি কখনও। তাছাড়া জানা গিয়েছিল, ধনিয়াখালিতে (বা ধনেখালি) খইচুর নামে মোয়া জাতীয় মিষ্টান্নটি একসময় বিখ্যাত ছিল। তাই বেরিয়ে পড়া। সঙ্গে আমাদের নন্দরানি, নন্দিতা দাস। ছোটা ডন বাবলা ওরফে বিভাস বাগ আর আমাদের প্রাক্তন ফুড মিনিস্টার ও ক্যামেরাম্যান ইন্দ্রজিৎ সাউ।
ধনেখালির মোড় ছাড়িয়ে কিছুটা এগিয়েছিলুম। তালবোনা মোড় পর্যন্ত। সেখানেই এক মুদিখানা দোকানে কথাবার্তা চালানো। জানার উদ্দেশ্য ধনেখালিতে তাঁত শিল্প ছাড়া আর কী দেখা যেতে পারে। সেই দোকানদার ভদ্রলোক আর তাঁর দাদা মিলে দশঘরার কথা বললেন। জানালেন, ইতিহাস ওখানেই আছে। আছে এক রেলপথের ইতিহাসও। কী রেল? বিপিআর। পুরো নাম? সঙ্গে সঙ্গে গুগল সার্চ, বেরলো বেঙ্গল প্রভিনশিয়াল রেলওয়ে। দাদা ভদ্রলোক জানালেন, দশঘরার রায়েরা ছিলেন ওই রেলপথের মালিক। রেলপথের বাঙালি মালিক? স্যার রাজেন মুখার্জির নামই এতদিন জানতাম। হাওড়া-আমতা মার্টিন রেলওয়ের অংশীদার ছিলেন। আরেক রেলপথের বাঙালি মালিক? যেতেই হয়। ওই দাদা ভদ্রলোকই দেখিয়েছিলেন, একসময়ে এই এলাকা দিয়েই রেললাইন ছিল। পরের স্টেশন ছিল রুদ্রাণী। এখন সবই হারিয়েছে।
ধনেখালি শাড়ি আর মিষ্টির খোঁজখবর নিয়ে তিনটি বাইক ছুটল দশঘরার দিকে। খোঁজখবর করতে করতে পৌঁছলাম জমিদার বিশ্বাসদের বাড়ি। পেল্লায় ব্যাপারস্যাপার বিশ্বাসদের। ঢোকার মুখে সিংহের মূর্তি বসানো দরজা। ঝিলের পাড়ে বিশাল প্রাসাদ। সামনে দুর্গামন্দির। তার সামনে দোলমঞ্চ, রাসমঞ্চ। দালানের পিছন দিকে একটি রাধাগোপীনাথ জীউর পঞ্চরত্ন মন্দির। পোড়ামাটির কাজ রয়েছে। তাতে রামায়ণের চিত্রাবলী ফুটিয়েছেন কোনও অজানা শিল্পী। মন্দিরটি ১৬৫১ শকাব্দে প্রতিষ্ঠিত খোদিত রয়েছে। প্রতিষ্ঠাতার নাম সদানন্দ বিশ্বাস। পরে মন্দিরটি সংস্কার করেছিলেন পৃথ্বীশচন্দ্র বিশ্বাস। সেটাই সম্ভব। কারণ মন্দিরের গায়ে রামায়ণের ঘটনা ছাড়াও টুপি পরা মূর্তির প্যানেলও রয়েছে। সেই মূর্তি সম্ভবত ইংরেজ বা পর্তুগিজের। বিশ্বাস পরিবারে বহু গুণী মানুষের জন্ম হয়েছিল। এলাকার উন্নয়নে ও শিক্ষা বিস্তারে এই পরিবারের ভূমিকা রয়েছে। এঁদের পুজো অন্তত চারশো বছরের পুরনো।
বিশ্বাসদের বাড়ির কাছেই বসু পরিবারের পুজো হচ্ছিল। আলো আর ফেস্টুন দেখলাম। বসু পরিবারের পুজো ১৬০১ সালে শুরু হয়। কিন্তু পুজো দেখতে যাওয়া হয়নি আমাদের। আসলে পুজো নয়, আমরা তো খুঁজতে চাইছিলাম বিপিআর-এর মালিক রায় পরিবারকে। বিশ্বাসদের ওখানেই এক বালক জানিয়েছিল, পাশের গ্রামেই রেলপথের মালিকদের বাড়ি। সন্ধে হয়ে এসেছে। ফিরতে হবে। সঙ্গে নন্দি আছে।
সেদিন এক রায় পরিবারের বাসস্থানেই পৌঁছেছিলাম। এঁদেরও বিশাল ব্যাপার। প্রাসাদের এলাকায় ঢোকার মুখে বিশাল তোরণ। তোরণের পাশে ক্লক টাওয়ার। লোকে বলে, ঘড়িঘর। অনেকটা পথ পার করে পৌঁছনো গেল দুর্গামণ্ডপে। জমকালো ব্যাপার। বিশাল দুর্গামণ্ডপ। দেওয়ালে দশমহাবিদ্যার ছবি। ছাদে রঙিন কারুকাজ। একটা জলাশয়ের পাশেই মন্দিরটা। পুকুরে একটা বাঁধানো ঘাট রয়েছে। রয়েছে বসার জায়গা।কিন্তু হেলান দেওয়ার জায়গায় একটা পাশবালিশ। সিমেন্টের তৈরি। বোঝা যায় একসময়ে অভিজাত পরিবারটির পুরুষেরা পুকুর পাড়ে আড্ডা জমাতেন। এঁরাই কি তবে রেলপথের মালিক? আবার জিজ্ঞাসাবাদ। রায়েদের ঝিল বাড়ি, নাচবাড়ি বেরলো। পরে বই পড়ে ব্রাডলি বার্ট বাংলো বেরোল। কিন্তু রায় বংশের সঙ্গে রেলপথের যোগ স্থাপন করা গেল না। খোঁজখবরে জানা গেল, এই রায়েদের জাহাজের কারবার ছিল। তাতেই পয়সা। আরও জানা গেল, কয়েকটি সিনেমার শ্যুটিং হয়েছিল এই বাড়িতে। একটা নাকি ‘জোড়াদীঘির চৌধুরী পরিবার’। আর এই বংশের বিপিনকৃষ্ণ রায় দানবীর নামে খ্যাত ছিলেন।
কিন্তু বিপিআর? সেই রায়েরা কোথায়? সাহায্য নিতে হল সুধীরকুমার মিত্রের। বিপিআর-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা অন্নদাপ্রসাদ সিংহরায়। তাঁর বাড়ি সিতিপলাশি গ্রামে। সিংহরায়রা ছিলেন পোঁয়ারছত্রী সিংহরায়। অন্নদাপ্রসাদ রুরকি টমসন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বিই পাশ করেছিলেন। রেলওয়ের কর্মী ছিলেন। ১৮৮৫ সালে তিনি ভোপালে ইন্ডিয়ান মিডল্যান্ড রেলপথ তৈরির প্রধান ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন তিনি। তাঁরই পরিকল্পনা অনুযায়ী ‘ভারতীয় শ্রম ও ভারতীয় মূলধনে’ বিপিআর প্রতিষ্ঠিত হয়। কয়েকটি বইও লিখেছিলেন। ইংরেজিতে লেখা ‘টাইলড ওয়ালিং’ ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল আর্ট’ বেশ নাম করেছিল।
রেলপথটি স্থাপনের একটি কারণ ছিল। একবার বাড়ি ফেরার সময়ে অন্নদাপ্রসাদকে তারকেশ্বরের বিশ্রামাগারে একরাত কাটাতে হয়। সেদিন বৃষ্টি হয়েছিল। কাদায় ভরা রাস্তায় এবং অন্ধকারে দশ মাইল হেঁটে বাড়ি ফেরা সম্ভব হয়নি। মশার কামড় খেতে হয় রাতভর। ঘুম হয়নি। সেদিনই মনে হয়েছিল, তারকেশ্বর থেকে ছোট লাইনের ট্রেন চালানোর কথা। রাতের নষ্ট ঘুম বাঙালিকে এক গর্বের বস্তু দিয়েছিল। তা হল সম্পূর্ণ বাঙালি পরিচালনায় একটি রেলপথ। ভারতবাসীরও সেটা প্রথম উদ্যোগ। বাধা এসেছিল। কিন্তু তা জয় করতে পারেন অন্নদাপ্রসাদ। সঙ্গে পেয়েছিলেন ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘হোপ’এর সম্পাদক অমৃতলাল রায় ও রামচন্দ্র ঘোষকে। ১৮৮৯ সালের ৩ জুন এই রেলওয়ে লাইন চালুর একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। প্রস্তাবক ছিলেন অন্নদাপ্রসাদ। এজেন্ট অমৃতলাল। সেই বিজ্ঞপ্তিতে শেয়ার কেনার জন্য আবেদনও ছিল। বিজ্ঞপ্তিটির একটি অংশ, ‘যাঁহারা প্রস্তাবিত রেলওয়ের অংশ কিনিতে ইচ্ছা করেন, তাঁহারা কলিকাতা ৬৫ নং অখিল মিস্ত্রিঈর লেনে ‘হোপ’ নামক ইংরাজী পত্রের সম্পাদক শ্রীযুক্ত অমৃতলাল রায়ের নিকট আবেদন করিবেন’।
বিপিআর-এর বিজ্ঞপ্তি দেশে আলোড়ন ফেলে দেয়। কয়েকটি ইংরেজি সংবাদপত্র ও ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় অবশ্য বিরূপ খবর লেখা হয়েছিল। তবে বাংলার বহু গণ্যমান্য শেয়ার কিনেছিলেন। ১৮৯১ সালের ১৬ অক্টোবর হুগলি জেলা বোর্ডও বিপিআর-এর সঙ্গে চুক্তি করে। ১০ টাকার ৮০ হাজার শেয়ারের মধ্যে একাত্তর হাজার শেয়ার এক বছরের মধ্যে বিক্রি হয়ে যায়। হুগলির মধ্যে বসুয়ার শ্রীরাম বসু, ভাস্তাড়ার যজ্ঞেশ্বর সিংহ এবং চকদিঘির বিধুভূষণ সিংহরায় যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। লাইন পাততে গিয়ে কানা নদী, কানা দামোদর, ঘিয়া নদী আর কুন্তী নদীর উপরে চারটি সেতু তৈরি করতে হয়েছিল। লাইন পাততে মোট খরচ হয় ন’লক্ষ টাকা।
১৮৯৪ সালের ৭ নভেম্বর চালু হয় রেলপথ। প্রথমে তারকেশ্বর থেকে বসুয়া পর্যন্ত ১২ মাইল পথে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছিল। ১৮৯৫ সালের ৮ মার্চ বসুয়া থেকে মগরা পর্যন্ত আরও প্রায় ১৯ মাইল প্রসারিত হয় রেলওয়ে। এটাই সর্বপ্রথম বাঙালি পরিচালিত রেলওয়ে। প্রথমে রেলের অত্যাবশকীয় জিনিসপত্র নিয়ে যাত্রা শুরু করে ট্রেন। ১৮৯৫ সালে ১ এপ্রিল বাংলার ছোটলাট স্যার চার্লস ইলিয়ট রেলপথের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। প্রথমে তিনটি ইঞ্জিন ৬০টি বগি নিয়ে দিনে ছ’বার যাতায়াত করত। তার পরে এই কোম্পানি মগরা থেকে ত্রিবেণী এবং দশঘরা থেকে জামালপুর পর্যন্ত শাখা ছড়িয়েছিল। সুধীরকুমার মিত্র বিপিআর-কে ‘বাঙ্গালীর একটি গৌরবের বস্তু’ বলেছেন। তারকেশ্বর থেকে ত্রিবেণী পর্যন্ত ৩৩ মাইল পথে মোট ১৭টি স্টেশন ছিল। স্টেশনগুলো হল, তারকেশ্বর, গোপীনগর, দশঘরা, কানানদী, ধনিয়াখালি, রুদ্রাণী, মাজনান, ভাস্তাড়া, মেলিক, গোয়াই-আমড়া, দ্বারবাসিনী, মহানাদ, হালুসাই, সুলতানগাছা, মগরাগঞ্জ, মগরা, ত্রিবেণী। হীরেন্দ্রনাথ রায় এই রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজার ছিলেন বহুদিন। একটানা লোকসান হতে থাকায় ১৯৫৬ সালে রেলপথ বন্ধ হয়ে যায়।
অন্যতম উদ্যোক্তা অমৃতলাল কিন্তু হুগলির বাসিন্দা ছিলেন না। তাঁর জন্ম ২৪ পরগনার গরিফায়। অমৃতলালের বাবা মধুসূদন ছিলেন হুগলি কলেজের কৃতী ছাত্র। অমৃতলালও কৃতী ছাত্র। চিকিৎসাবিদ্যায় উচ্চশিক্ষার জন্য প্রথমে এডিনবরা যান। তার পর সেখান থেকে আমেরিকা। ‘সান’ পত্রিকায় ভারতে খ্রিস্টান মিশনারি সম্পর্কে প্রবন্ধ লিখেছেন। কেশবচন্দ্র সেনের অনুরোধে ভারতে ফেরেন। ১৮৮৭ সালে ‘হোপ’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। অন্নদাপ্রসাদের উদ্যোগে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাই বিপিআর প্রতিষ্ঠায় যোগ দিয়েছিলেন। অমৃতলালের ভাগ্নি হলে বিখ্যাত লেখিকা আশাপূর্ণা দেবী।
সেদিন আমরা বিপিআর মালিকদের বাড়িতে পৌঁছতে পারিনি। তবে দশঘরার মতো ঐতিহাসিক জনপদে ঘুরে বেড়াতে পেরেছিলাম। এতেই আনন্দ। বলা হয়, দশঘরা বারোদুয়ারি রাজার রাজধানী ছিল। দশটি গ্রাম নিয়ে রাজধানী তৈরি হয় বলে এর নাম দশঘরা। গ্রামগুলো হল, শ্রীকৃষ্ণপুর, জাড়গ্রাম, দিঘরা, আগলাপুর, শ্রীরামপুর, ইছাপুর, গোপীনগর, গঙ্গেশনগর, পাড়াম্বো ও নলথোবা। সিতিপলাশির নাম নেই। সুতরাং বিপিআর মালিকদের বাড়ি অন্য কোনওখানে।
ঋণ স্বীকার: সুধীরকুমার মিত্র— হুগলির ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ (১ম ও ২য় খণ্ড)
বিশেষ দ্রষ্টব্য: সুধীরকুমার মিত্রের বইয়ে রেলপথের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন একবার ১ এপ্রিল আরেকবার ২ এপ্রিল আছে। আর অন্নদাপ্রসাদ সিংহরায় পরে অন্নদাপ্রসাদ সিংহ হয়েছেন। এর কারণ কারও জানা থাকলে আলোকপাত করবেন অনুগ্রহ করে।
ছবি— দীপশেখর দাস ও ইন্দ্রজিৎ সাউ
কভারের ছবি- বিশ্বাসদের প্রাসাদ
গজেন্দ্র কুমার মিত্র মহাশয়ের পৌষ ফাগুনের পালা উপন্যাস পড়ছিলাম। তাতে ধনেখালির খইচুরের উল্লেখ পেলাম।
হ্যাঁ, একসময়ে বেশ সুনাম। ছিল। তবে এই লেখাটি ধনেখালির মিষ্টি নিয়ে নয়। এটা রেলপথ বিপিআর নিয়ে। মিষ্টি নিয়ে লেখাটার নাম ‘হারানো সুশি, বঁড়শি আর মিষ্টির ধনিয়াখালি’।