যথা ইচ্ছা তথা যা
বেরনো হয় না নিয়ম করে। ভয়টা এখনও পুরোপুরি কাটেনি। তার উপরে সকলকে একসঙ্গে পাওয়া মুশকিল। দূরের গন্তব্যে যাওয়ার মতো যানবাহন খুব একটা সহজলভ্য নয়। এদিকে ঘরেও থাকা যায় না। বাইরের ডাক নিশির ডাকের মতো অমোঘ। কিছু একটা তো উপায় বার করা জরুরি। হেঁটে হেঁটে আশপাশটা দেখা। একটু কান পাতলেই বোঝা যাবে, প্রকৃতি আছে তার মতোই। সুরেলা, ছন্দোময়। প্রকৃতিকে যারা সুর আর ছন্দে বাঁধে তাদের দেখা মিললেও মন কিছুটা শান্ত হয়। আজ তাদের কয়েকজনকে হাজির করলাম আমরা।
১। তাইগা ফ্লাইক্যাচার
ডাকটা একটু অন্যরকমই মনে হচ্ছিল। কী রকম একটা কিররর…কিররর করে ডাক। কিন্তু চোখে পড়েনি পাখিটা। বাগানে জল দেওয়া থাকে। একদিন দুপুরে দেখতে পেলাম ছোট পাখিটা। ধূসর চেহারার। বাগানে মাটির সরায় জল দেওয়া থাকে। একটুখানি জল খেয়ে নেচে নেচে সরায় নেমে চান করে নিল। তার পর ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল। পাখিটার ছবি তোলা দরকার। এরকম পাখি দেখিনি। দু’দিন পরে আবার দেখা। সেই জল খাওয়ার জায়গায়। মোবাইল বাগিয়ে ছবি তোলা গেল।
ছবি গেল বিশ্বরূপদার হোয়াটসঅ্যাপে। ঝাড়গ্রামের বিশ্বরূপ মণ্ডল। ক্যামেরা পুরো জুম করে তোলা। ফাটা ফাটা ছবি। শনাক্ত করায় বেশ কষ্ট। সেই কষ্ট স্বীকার করে বিশ্বরূপদা জানালেন, বোধহয় তাইগা ফ্লাইক্যাচার। রাশিয়া বা সাইবেরিয়া থেকে প্রতি বছর শীতকালে আসে। শুনেই খুশি হলাম। আমাদের বাগানে বিদেশি পাখি! ভাল ছবি তো তুলতেই হবে। ইন্দ্রর পুরনো ক্যামেরাটা ধার করা হল। অনেক চেষ্টায় উঠল কিছুটা পরিষ্কার ছবি। ক্যামেরার হাত যে তেমন পাকা নয়। (দীপক দাসের অভিজ্ঞতা)।
২। নীলকণ্ঠ
ছোটবেলা থেকেই দেখি পাখিটাকে। নবারুণ মাঠে খেলতে গেলে বিকেলের দিকে দেখা যেত একটা পাখি। ধান জমিতে নামত। তার পর অনেকদিন দেখিনি। খবরের কাগজে বা কোথায় যেন পড়েছিলাম, নীলকণ্ঠ পাখির সংখ্যা কমছে। এই পাখিটার কাব্য-সাহিত্যে উপস্থিতি প্রবল। দুর্গাপুজোয় প্রতি বছর নীলকণ্ঠ পাখির কথা মনে করতেই হয়। ধর্মীয় আচারের জন্য। সেদিন আমাদের ফিস্ট ছিল। বড়গাছিয়ায় বাজার থেকে ফেরার পথে দীপকদা দেখতে পেয়েছিল পাখিটা। সেই নবারুণ মাঠের কাছেই। আমাদের গ্রামের হাইটেনশন লাইনের পোস্টে বসেছিল।
কী একটা আনতে ভুলে গিয়েছিলাম বলে আরেকবার বড়গাছিয়ায় যাওয়ার দরকার ছিল। দীপকদা বলল, ‘‘ক্যামেরাটা নেব নাকি রে?’’ হ্যাঁ বলেছিলাম। লোকটা একসময়ে পড়িয়েছিল তো। মুখের উপরে না বলতে পারি না। তার উপর বয়স হয়েছে। মন খারাপ করতে পারে। ভাগ্যিস হ্যাঁ বলেছিলাম। ইন্দ্রদার ক্যামেরাও কাজে এসেছিল। নীলকণ্ঠ পাখিটা যেখানে দেখেছিলাম সেখানেই বসেছিল। (দীপশেখর দাসের অভিজ্ঞতা)।
৩। শামুক
একদিন আমি আর রাজা (দেবাশিস দাস) কোথা থেকে যেন ফিরছিলাম। রাত হয়ে গিয়েছিল। মাঠের ধারে মনসাতলা থেকে কে যেন নাম ধরে ডেকেছিল। জায়গাটা সন্ধ্যের পরে রসিকদের আড্ডা হয়ে ওঠে। তাই রাজাকে বাইক থামাতে বারণ করেছিলাম। রাজাদের বাড়ি থেকে সাইকেল নিয়ে মণ্ডলার দিকে যাচ্ছি, রাস্তায় দীপকদার সঙ্গে দেখা। আমাকে বলল, ‘‘তোকে ডাকলুম, সাড়া দিলিনি!’’ আমি বলেছিলুম, ‘‘ওটা তুমি ছিলে! ভাবলুম, কোনও মাতাল…ওই জায়গায় রাতে আর কে থাকবে?’’
স্থল শামুকের ছবি তুলছিল দীপকদা। ওকে বললুম, ‘‘আরে আমাদের ওখানে সন্ধেবেলা প্রচুর বেরোয়। তোমাকে তুলে দেব।’’ দিয়েছিলুম তুলে। স্থল শামুক এখনও আমাদের গ্রামে দেখা যায়। বেশ ভাল মতোই। যদিও প্রতিদিনই রাতের অন্ধকারে সাইকেল, বাইকে দু’একটা গুঁড়িয়ে যায়। তবুও আছে। তবে কমে গিয়েছে আপেল শামুক। ধানের জমিতে আগে প্রচুর পাওয়া যেত। বর্ষায় জল পড়লেই বেরোত মাটি থেকে। শুকনোর সময়ে মাঠের আলের গোড়ায় থাকত। যাঁরা শামুক বিক্রি করেন তাঁরা কাস্তে দিয়ে আলের গোড়া উসকে শামুক বের করে নিয়ে যেত। ঝুড়ি ঝুড়ি। জমিতে কীটনাশক দেওয়ার জন্যই নাকি শামুক কমছে। (বিভাস বাগের অভিজ্ঞতা)
৪। লক্ষ্মী পেঁচা
হাওড়া জেলার শেষ প্রান্ত জয়পুরে ঘুরতে যাওয়া হয়েছিল দলবেঁধে। গ্রামের মন্দির আর কিছু স্বল্প পরিচিত দেব-দেবীর খোঁজে। সেখানেই লক্ষ্মী-জনার্দন মন্দিরের গায়ে একটা বাতির ঢাকনায় বসেছিল পেঁচাটা। ছোটা ডন বাবলা দেখতে পেয়েছিল। বিশাল পেঁচা। দ্রুত ছবি তোলা হল। এত বড় পেঁচা ‘যথা ইচ্ছা তথা যা’ দলের সদস্যরা বহুদিন দেখেনি।
৫। কাঁকড়া
পাতিহাল গ্রামের বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতা আছে। যাঁদের বয়স পঁচিশের উপরে তাঁরা মনে করতে পারবেন, ছোটবেলায় বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাঁকড়া বিক্রি করতে আসতেন কয়েকজন মহিলা। এক গ্লাস কাঁকড়া এক টাকা। বাদার মাঠে প্রচুর মিলত। সেগুলো অবশ্য চিতি কাঁকড়া। এখন আর কেউ চিতি কাঁকড়া বিক্রি করতে আসেন না। এখন নাকি পাওয়াই যায় না। পাওয়া যায় না সাধারণ কাঁকড়াও। যে কাঁকড়াগুলো পুকুরে বা মাঠে মিলত। ছোটবেলায় একটা শামুকের টোপ দিয়ে কাঁকড়া ধরেনি বা ধরা দেখেনি এমন বাসিন্দা পাতিহালে পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু এখন সে সব পূর্বজন্মের কথা বলে মনে হবে।
৬। কোকিল
ছোটবেলায় জানাছিল, কোকিল কালো। তিলে ছাপা, লাল চোখের যে পাখিটাকে আমগাছে বা ডুমুর গাছের ঝোপে দেখা যেত সেটা কোনও শিকারি পাখি। সে ভুল ভেঙেছে অনেক পরে। পাখিদের মধ্যে স্ত্রী-পুরুষের রঙের আর আকারের ভেদ রয়েছে। আমরা জেনেছি অনেক পরে।
একদিন আমগাছের মগডালে পিকবর এসে বসেছিলেন। সেই মোবাইল ক্যামেরা। কিন্তু এত দূর যে সিল্যুয়েট ছবি উঠল। তাতে আন্দাজ করা যাবে কোকিল। কিন্তু চ্যালেঞ্জ করলে প্রমাণ করা যাবে না। বাঁচিয়ে দিল ইন্দ্রবাবুর ক্যামেরা। স্ত্রী-পুরুষ দু’জনেই পোজ দিলেন। পরপর দু’দিন।
৭। অজানা পাখি
কিছুদিন আগে গ্রাম দেখার ইচ্ছে হয়েছিল। অনেকদিকে অনেক দিন যাওয়া হয় না। তাই বাবলাকে ডাকা। হাঁটতে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম দু’জনে। বড়গাছিয়া ফিডার রোড হয়ে সরস্বতী মাঠের পাশ দিয়ে পাকা রাস্তা ধরে মিত্রগড়। তার পর গয়লা পাড়া, নতুন পুকুর পাড় ধরে বাড়ি। ভালই লাগছিল। সেই গ্রাম দেখার দিনে ফিডার রোডে দেখেছিলাম পাখিটা। একটা গামার গাছে শুঁয়োপোকা খাচ্ছিল। মোবাইলে ছবি তোলা হল বটে। কিন্তু খুবই বাজে ছবি। সেই কারণেই পাখি প্রেমিক সৌম্য চট্টোপাধ্যায় পাখিটি পাপিয়া (কমন হক কাক্কু) বলেও একটু সময় নিলেন। প্রজাপতি বিশারদ সৌরভ দুয়ারী মহাশয়ও জানিয়েছেন, এই পাখিটি পাপিয়া। (দীপক দাস আর বিভাস বাগের অভিজ্ঞতা)।
৮। টুনটুনি
কতই দেখা যায়। ঝোপঝাড় থেকে একটানা ডাক খুব মিষ্টি লাগে। অতি চঞ্চল পাখি। মোবাইলে ধরা সম্ভব নয়। ছোট কলেবরের জন্য। ক্যামেরা বন্দি করতে হল। আর একই ফ্রেমে দু’টি টুনটুনি মিলেছিল।
৯। মৌটুসি
হলুদ টুনটুনি কোনওদিন দেখেনি আমাদের দলের সদস্যরা। কিন্তু ক’দিন থেকেই গাছে গাছে বেশ জোরাল ডাক শোনা যাচ্ছিল। দীপু ক্যামেরা এনেছিল। কিন্তু সেদিন দেখা মেলেনি। সহজ কারণেই। ও রাস্তা কাটলে অনেক কাজেই বাধা আসে আমরা সেটা জানি। ফলে…। তবে অনেক চেষ্টার পরে একজনকে ক্যামেরায় ধরা গিয়েছে। ইন্দ্রর বুড়ো ক্যামেরা অবসর জীবনেও ভেলকি দেখাচ্ছে। কিন্তু পাখিটার সঠিক নাম জানতাম না। তাই বিশ্বরূপদার শরণ নেওয়া। দাদা জানালেন, মৌটুসি। ইংরেজি নাম ‘পার্পল রাম্পড সানবার্ড’।
কভারের ছবি— স্ত্রী কোকিল
(চলবে)