দীপশেখর দাস
ডিসেম্বরেও যে হিমালয়ের আকাশে মেঘ থাকতে পারে তা না দেখলে আমি বিশ্বাস করতুম না। আনলক পর্বে অনেকেই পাহাড়ে আসছেন। মেঘমুক্ত নীল আকাশের ছবিতে ফেসবুক উপচে পড়ছে। আর আমি পাহাড়ে আসতেই আকাশের মুখ ভার। ‘যথা ইচ্ছা তথা যা’ দলের ছেলে-বুড়োরা আমায় কালো বিড়াল বলে। কিন্তু সেটা অন্যের যাত্রায় জল ঢালার কারণে। কিন্তু, এ যে একান্তই আমার নিজের যাত্রা। তবে এ যাত্রায় মেঘ কেন! নিজের ছায়ারই দোষে নয়তো!
না! আমি অবুঝ বাঙালি নই। আনলক শুরু হতেই করোনার তোয়াক্কা না করে নিজের এবং পরিবারের বিপদ বাড়িয়ে ঘুরতে যাওয়ার দলে আমি নই। আমাকে বেরোতে হয়েছে নিতান্তই প্রয়োজনে। অফিসের নির্দেশে। তাই, আর সবার মতো আমি আর আমার সহকর্মী শুভজিৎদাও পাহাড়যাত্রী।
যাত্রার শুরুটা যদিও সহজ হল না। প্রথম ফ্যাসাদ হল ট্রেনের টিকিট পাওয়া। এখনও ট্রেন পরিষেবা স্বাভাবিক হয়নি। খুব কম ট্রেনই চলছে। উপরন্তু পাহাড়বিলাসী বাঙালির ভ্রমণ পিপাসা। ফলে ট্রেনে টিকিট বাড়ন্ত। কোনওরকমে আরএসি টিকিট পেলুম দার্জিলিং মেলে। টিকিট নিশ্চিত হল সংরক্ষণ তালিকা তৈরি হবার সময়। রওনা দিলুম নভেম্বরের শেষ রাত্রে। গন্তব্য পশ্চিম সিকিম। সকালে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে গাড়ি নিলুম গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে। অফিসের গ্যাংটক শাখায় দুরাত কাটিয়ে পাড়ি দিলুম গন্তব্যের দিকে। গ্যাংটক থেকে গাড়ি ভাড়া করে প্রথমে এলুম জোরথাং। সেখান থেকে আবার গাড়ি নিয়ে এলুম হিলেতে। গ্যাংটক থেকে জোরথাং বাসেও আসা যায়। সিকিমের সরকারি বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস পাওয়া যায়। কিন্তু, জোরথাং থেকে এখানে আসতে গাড়ি নিতেই হবে। করোনা পরিস্থিতির কারণে ভিড় এড়াতে আমরা গাড়িতেই এলুম। নিউ জলপাইগুড়ি থেকেও জোরথাংয়ের গাড়ি পাওয়া যায়। গ্যাংটক ছোঁয়ার দরকার না থাকলে সরাসরিই আসা যায় এখানে।
আমাদের ক’দিনের আস্তানা এই হিলেই। হিলে থেকে চার পাঁচ কিলোমিটার দূরেই আছে রডোডেনড্রনের অভয়ারণ্য। তার কথা আজ থাক। আজ হিলের গল্প বলি।
গ্যাংটক থেকে বেরিয়েছিলুম প্রখর রোদ্দুর মাথায় নিয়ে। সিকিমের দক্ষিণ জেলা ছেড়ে পশ্চিমে গাড়ির চাকা পড়তেই আকাশ ভারী হতে থাকল। দুপুর শেষে যখন হিলে পৌঁছলুম তখন রোদ সম্পূর্ণ উধাও। গাড়ি থেকে নামতেই ঠান্ডা হাওয়ায় কাঁপুনি ধরল। জ্যাকেটটা ভাল করে জড়িয়ে নিয়ে গাড়ি ভাড়া মিটিয়ে আস্তানায় সেঁধোলুম। আমাদের আস্তানা হিলের মাশরুম হাট।
এই মাশরুম হাটের খোঁজ পেয়েছিলুম সিকিম অফিসের সহকর্মী শুভদীপের কাছে। ফোন করে বুকিং নিয়েছিলুম আগেভাগেই। আস্তানার নামটা কৌতূহল জাগিয়ে ছিল। তবে কি মাশরুম পাওয়া যায় এখানে! কৌতূহল মিটল দর্শনে। একই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা চারটি ঘর। ঘরগুলোর আকার ব্যাঙের ছাতার মতো। আর ওই আকার থেকেই এমন নামকরণ।
হিলে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৬০০ মিটার উঁচুতে। সবুজে মোড়া ছোট এক শান্ত, সুন্দর গ্রাম। হিলের সামনের পাহাড়গুলো তুলনায় খাটো। তাই হাটের সামনে দাঁড়িয়ে বহুদূর পর্যন্ত চোখ মেলা যায়। সামনে অনেকগুলো পাহাড়চূড়া। সবগুলোই সবুজে ঢাকা। পাহাড়ের গায়ে গায়ে হালকা মেঘের চাদর। দূরে পাহাড়তলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট গ্রাম। অনন্য সাধারণ দৃশ্য। মোট কথা হিলে প্রথম দর্শনেই মন কাড়ার মতো।
সন্ধ্যের সময় কুয়াশা নামল। আমরাও হাটের দরজা বন্ধ করলুম। মাশরুম হাট আসলে একটা হোম স্টে। প্রেম দোরজি শেরপা ও তাঁর স্ত্রী এই হোম স্টে চালান। অতিথিদের থাকা খাওয়ার দেখভাল তাঁরাই করেন। তাঁদের আতিথেয়তাও মন ভাল করা। দুপুরে গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই গরম চা হাতে পেয়েছিলুম। জামা কাপড় ছেড়ে হাত পা ধুয়ে বেরোতে না বেরোতেই দ্বিপ্রাহরিক আহারের ডাক এল। গরম ভাত, ডাল, দু’তিন রকম তরকারি, ডিম ভাজা, পাঁপড় ভাজায় রসনা ও উদর তৃপ্তি হল। সন্ধ্যায় চা আর ভেজ পকোড়া। আর রাতে দুপুরের মতোই দুই তরকারি-সহ ভাত। সঙ্গে মুরগির ঝাল ঝাল কারি। ওহ কী স্বাদ! লিখতে বসে আবার মনে এল। যে ক’দিন ছিলুম এমন খাবারই মিলল। বিশদে আর গেলুম না। প্রতিদিনই পাতে আমিষ পড়ত। দুপুর রাত সবসময়ই। তবে মাছ মেলে না এখানে।
সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙল। শরীর যাত্রার ধকলে ধ্বস্ত থাকলেও। ভাঙারই কথা। পাখিদের কলকাকলিতে তখন চারিদিক মুখরিত। গাছের আড়াল আবডাল থেকে তারা বাজিয়ে চলেছে তাদের ঐক্যতান। ওদের গানে আরও এক সুবিধা হল। দেখলুম, রাতের কুয়াশা তখন মুখ লুকিয়েছে। পাহাড় জুড়ে ভাসা মেঘের আস্তরণ। তা ফুঁড়ে সুয্যিমামা উঁকি দেওয়ার চেষ্টায়। পাহাড়ি শীতের সকালে এক আলোআঁধারি পরিবেশ। সেই অল্প আলোতেই সামনের পাহাড় ছেড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার উঁকি। মন ভাল হয়ে গেল। যদিও এই মন ভাল করা পরিবেশটা বেশিক্ষণ টিকল না। সেই কুয়াশা আর মেঘের দল পাহাড়গুলোর সামনে ভিড় করে এল। ক্রমশ তারা দল ভারী করে জমাটবদ্ধ হল। একটা অবরোধের দেওয়াল গড়ে নিল যেন। আমাদের দৃষ্টিপথ সীমিত হল। সামনের সব পাহাড়গুলো আবছায়ায় পরিণত হল।
হিলে আমাদের ছয় রাতের ঠিকানা ছিল। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতুম নতুন কোনও দৃশ্যের সন্ধানে। কিন্তু, রোজই নিরাশ হতুম। মেঘ আর কুয়াশাদের দাবিদাওয়া বোধহয় কেউ মানল না। ওদের অবরোধও উঠল না। প্রেমজি বললেন, এসময়টা এমনই হয়। উপরের দিকে বরফ পড়ে। তারই রেশ এসে পড়ে এখানে। আকাশ মুখ ভার করে থাকে। বৃষ্টিও হয় কখনও সখনও। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে সব পরিষ্কার হয়। বরফও নাকি পড়ে এখানে।
আকাশ মুখ ভার করলেও আমরা তো আর বসে থাকতে পারি না। আমাদের করণীয় সব সারলুম। একদিন গ্রাম ঘুরতে গেলুম। গুটিকয়েক ঘর। সবাইই প্রায় চাষবাসে যুক্ত। সিকিম সরকারের হর্টিকালচার বিভাগের অনেকখানি জমি আছে এখানে। পাহাড়ের ধাপ কেটে বানানো এইসব জমিতেই জৈব পদ্ধতিতে ফসল ফলান হিলের বাসিন্দারা। ফুলকপি-বাঁধাকপি থেকে আলু-মূলো সবই ফলে এখানে। এই সব সবজিই পাতে পড়ে অন্যান্য সিকিমবাসীর। সিকিম এলে আমরাও তার ভাগ পাই কিছু কিছু।
একদিন এখানের কাজ শেষ হল। যাবার পালা এল। প্রেমজির স্ত্রী সকালে আলুর পরোটা বানিয়ে দিলেন। খাওয়াদাওয়া করে তৈরি হলুম। ৮টায় গাড়ি বলা ছিল। সময়মতো বাইচুং গাড়ি নিয়ে উপস্থিত হল। বাড়ি ফেরার আগে আরও একটা জায়গা ছোঁয়ার ছিল। আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেলফিতে প্রেমজিদের বিদায় জানালুম। বাইচুং গাড়ি ছাড়ল। হিলে তখনও কুয়াশা মোরা। এখানে যে ক’দিন রইলুম রোদ্দুর দেখিনি। শুধু একদিন সকালটা একটু ভাল ছিল। ভোরে একটু সময় আকাশ পরিষ্কার হয়েছিল। ওই একদিনই সূর্যোদয় দেখতে পেয়েছিলুম। তাই কিছুটা আক্ষেপ নিয়েই আমরা ফিরছিলুম।
আক্ষেপ কাটল কিছুটা পথ পেরিয়েই। বাইচুংয়ের সজোর ব্রেকে। পাহাড়ি রাস্তায় অনেক বাঁক। এমনই এক বাঁক পেরিয়েই বাইচুং ব্রেক কষল। কিছুটা দূরেই রাস্তার মাঝে তখন দুটো তাগড়াই চিতাবাঘের বাচ্চা প্রাতঃভ্রমণে। যদিও গাড়ির আওয়াজে চমকে উঠে মর্নিং ওয়াক ছেড়ে পাহাড়ের ঢালে লম্বা ঝাঁপ দিল। তবুও একটা মুহূর্ত আমরা পেয়েছিলুম তাদের। কুয়াশার চাদরে প্রকৃতি ঢেকেছিল। তাই ক্যামেরাটা হাত থেকে দূরে রেখেছিলুম। আক্ষেপ নিয়ে বেড়িয়েছিলুম। আফশোসটা সঙ্গে নিলুম।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: হিলের মাশরুম হাটে থাকতে যোগাযোগ করুন প্রেম দর্জি শেরপার সঙ্গে ৭৫৪৮৯৩২০৬৯/৭০২৯৬৯৬০৮১ মোবাইল নম্বরে।
ছবি- লেখক ও শুভজিৎ লাহিড়ী
(সমাপ্ত)