খাদ্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

কলাইয়ের ডালের রুটি আর নবাবগঞ্জের বেগুন

দীপক দাস

লড়াইটা রুজির ছিল না। ছিল রুটির। বলা ভাল, রুজি বজায় রাখতে রুটি খোঁজার লড়াই। ভুখা পেটে সাধন, কর্ম, ভজন কিছুই হয় না। রাত জেগে খবরের কাগজে কাজ করা তো আরও মুশকিল! দানাপানির জোগাড় করাটা মাঝে মাঝেই চাপের হয়ে যায় যে! মানে যেত।

তখন মালদায়। ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’এ চাকরি করি। মালদা বাসের গল্প। অথচ আমের বদলে রুটি? রসকদম্ব বা কানসাটের মতো দু’টো বিখ্যাত মিষ্টির বদলে বেগুন? অবাক হওয়ারই কথা। বৈশাখী দুপুরে পুরনো মালদার আমবাগানে বসে আম খাওয়ার গল্প হয়েছে আগে। মিষ্টি দু’টোর কথাও এসেছে কতবার। আজ রুটি-বেগুন। এর পরেও প্রশ্ন উঠতে পারে, রুটির গল্প শুনলে মালদার কেন শুনব? ফ্রান্সের শুনব। রুটির স্বর্গরাজ্য তো সেটাই। নানা স্বাদের আর ছাঁদের রুটি। ফরাসিরা রুটি পাগল জাতি। কোনওরকম আপস সহ্য করতে চান না রুটির সঙ্গে। বহু বছর আগে সাহিত্যিক শংকর ‘আনন্দবাজার’এর রবিবাসরীয়র পাতায় লিখতেন তাঁর প্যারিস সফরের কাহিনি। নানা রুটিতে বর্ণনায় রবিবারটা বেশ রুচিকর হয়ে উঠত।

রুটি নিয়ে এত সাক্ষাৎ জ্ঞানগম্যি হয়নি কোনও কালেই। মালদায় যাওয়ার আগে পর্যন্ত কয়েকটা রুটির কথাই জানতাম। বেকারির সবচেয়ে কম দামের লম্বাটে ছোট রুটি। স্কুলে পড়ার সময়ে টিফিনে খেতাম। এক টাকা দাম ছিল। বাড়িতে চায়ে ডুবিয়েও খেয়েছি। মাছ ধরার টোপ হিসেবেও ব্যবহার করেছি। যে রুটি এখন কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ডিম-টোস্ট তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। আর ছিল হাফ পাউন্ড। সে আলেকালে আসত বাড়িতে। যেদিন আসত সেদিন কী রকম একটা বড়লোক বড়লোক ভাব হত নিজের মধ্যে। রুটির সঙ্গে কলা আর ডিম হলে তো বাহুমূলে ফোঁড়া। মানে সলমন খান যেরকম হাঁটেন আরকী। হাত দু’টো বগল থেকে একটু দূরে রেখে। পরে আসত স্লাইস। যেটাকে পিস কাটা বলতাম। দামের বোধহয় একটু তফাৎ ছিল। পিস কাটার দাম বেশি। আর ছিল বাড়ির হাতে বেলা রুটি।

তৈরি হচ্ছে রুটি। লেখার সময় ২০০৮। ছবির সময় ২০২০।

রুজির টানে এসে নতুন রুটির সন্ধান মিলল। আগ্রহ তো হবেই। তবে এখন নতুন খাবার নিয়ে যে আগ্রহ তখন ততটা ছিল না। কলাইয়ের ডালের রুটি খেয়েছিলাম নিতান্তই পেটের টানে। মালদায় যে জায়গাটায় থাকতাম সেখানে খাবারদাবার একটু কম পাওয়া যেত। তবে সারা বছর সন্ধের পরে মাংসের ছাঁটের গরগরে ঝালের সঙ্গে আটার রুটি মিলত। খেয়েওছি বহুবার। একটা হোটেলেও থাকত রুটি। কিন্তু বেশিদিন টানা গেল না। এক তো, ওই ছাঁট আর রুটি বেশিদিন খেলে রুজির লড়াই বন্ধ হয়ে যাবে। ও জিনিস পেটে নিয়ে দিনের পর দিন রাত জাগা যাবে না। তার উপর, ওই এলাকার ব্যারাম হল, প্রতিটা দোকানেই মদ বিক্রি করা। শস্তা মদ। বড্ড গন্ধ। গা গুলিয়ে ওঠে। ফলে ভাল কিছু দোকানের সন্ধানে ছিলাম। আমাদের সহকর্মী রঞ্জন মাঝে মাঝে মঙ্গলবাড়ি মোড় থেকে রুটি-তরকা এনে দিত। মাংসের ঝোল দিয়ে তৈরি তরকা। বেশ লাগত। পেট আর মন ভরত মাঝে মাঝে।

কিন্তু কাজের মাঝে রোজ তো আর রঞ্জনকে পাঠানো যায় না। গরমকাল কোনও রকমে কাটল। কোনওদিন রুটি, ঘুগনি, কোনওদিন রুটির সঙ্গে টুটুলদার লঙ্কার চাট দিয়ে পিত্তি রক্ষা হত। বৌদি কাঁচা লঙ্কা আদা-রসুন দিয়ে বেটে দারুণ চাট তৈরি করে দিত। দারুণ খেতে। রসিক ছিল টুটুলদা। লোকটা হঠাৎই চলে গেল একদিন। তখন অবশ্য আমি হাওড়ায় ফিরে এসেছিলাম। ওই টুটুলদাই একদিন কলাইয়ের ডালের রুটির কথা বলে। তখন শীতকাল।

নবাবগঞ্জের বেগুন।

মালদার বিভিন্ন রাস্তার ধারে শীতকালে কলাইয়ের ডালের রুটি বিক্রি হয়। গরমাগরম। সাধারণত মেয়েরাই রুটির পসরা নিয়ে বসেন। একটা উনুন। একটা মাটির চাটু। কিছু বাসনকোসন। আর কলাইয়ের ডালের তাল। সেই তাল থেকে লেচি কেটে চটপট বেলে রুটি তৈরি করে দেন। বেশ মোটা মোটা রুটি। একটু ফাটা ফাটা ধরনের। কড়মড়েও হয়। একদিন কিনতে গেলাম। সঙ্গে কে ছিল আর মনে নেই। সহকর্মী এবং সহ-মেসশাবক সুমন্ত কি? ও ব্যাটাই হবে। আমাদের অফিসের কাছেই রাস্তার পাশে বসেছিল। যে রাস্তাটা বামনগোলার দিকে চলে গিয়েছে। কম বয়সি একটি মেয়ে রুটি বিক্রি করছিল। সঙ্গে তার কোলের শিশু। এক কন্যা। দেখলেই বোঝা যায়, লড়াই আছে জীবনে। কিন্তু মেয়েটি রসিক। আমাদের সঙ্গেই এক ভদ্রলোক রুটি কিনছিলেন। রুটি করতে সময় লাগে। সেই ভদ্রলোক জানতে চেয়েছিলেন, ‘‘হয়েছে?’’ মেয়েটি উত্তর দিয়েছিল, ‘‘হলেই কাঁদবে।’’ সেই সময়ে এই লব্জটা সাংঘাতিক হিট। আমাদের অফিসেও চলত। টাইপ করতে দেওয়া আছে কপি। হয়তো জানতে চাইলাম, সাজাহান, অপূর্ব, গৌতমদা বা মোক্তারের কাছে, ‘‘হয়েছে?’’। ওরা উত্তর দিত, ‘‘হলেই কাঁদবে।’’ অফিসে একটা হাসির হুল্লোড় উঠত। কিন্তু ভদ্রলোক ছিলেন একটু সিরিয়াস টাইপের। তিনি বকেই দিলেন, ‘‘তুমি এ কথা বলছ?’’ মানে বলতে চাইছিলেন, মেয়ে হয়ে এ কথা কেন! কেন বলা যাবে না সেটা তখন আর জিজ্ঞাসা করা হয়নি। ধমক খেয়ে মেয়েটি চুপ করে গিয়েছিল। আর আমাদেরও দেরি হয়ে যাচ্ছিল বলে চলে এসেছিলাম।

রুটি এমনই জবরদস্ত।

সেদিন রুটির সঙ্গে দিয়েছিল ধনেপাতার চাটনি, লঙ্কা আর পেঁয়াজ। রুটির চেহারা দেখে ‘চুপ চুপ কে’ সিনেমার রাজপাল যাদবের চাপাতি খাওয়ার কথা মনে পড়ে গেল। সেই রকমই ‘মজবুত অঔর টিকাও’ মনে হচ্ছিল। আমাদের তৎকালীন বস রতনদা বলেছিলেন, ‘‘ভেঙে ভেঙে ধনেপাতার চাটনি মাখিয়ে খাও। শক্ত তো। তালু ছড়ে যেতে পারে।’’ সেই রকম ভাবেই খেয়েছিলাম। বেশ লেগেছিল। স্বাদু রুটি। তবে পরপর দু’টো রুটি খেলে তালু একটু চাপে পড়ে যেতে পারে।

কোনও কোনও জায়গায় কলাইয়ের ডালের রুটির সঙ্গে বেগুন পোড়া মাখাও দেয়। সে বেগুন নবাবগঞ্জের হলে তো কথাই নেই। মালদায় শীতকালে মেলে বিশেষ এই বেগুন। ইয়াব্বড় বড়। ছোটখাট লাউয়ের আকারে। তখন মোবাইলের রমরমা ছিল না। আমাদের ক্যামেরাওয়ালা মোবাইল ছিল একমাত্র অমৃতেন্দুর। কিন্তু পটাপট ছবির অভ্যাসও তখন চালু হয়নি। ফলে ছবি নেই। বেগুনের নামের সঙ্গে নবাবগঞ্জ জুড়ে গেলেও মালদা জুড়েই এর চাষ হয়। যদিও মালদার সীমান্তে বাংলাদেশে চাঁপাই নবাবগঞ্জ নামে একটি জায়গা রয়েছে। সহকর্মী সোমা জানাল, নবাবরা চাষিদের মালদায় এই বেগুনের চাষ করাত। নবাবি আমল থেকেই এই বেগুন নবাবগঞ্জের প্রচলিত বলে এলাকায় প্রচলিত।

আকারটা একবার দেখুন।

বাড়ির জন্য এনেছিলাম একবার মালদার বিশেষ বেগুন। মা বলেছিল, একটা বেগুন ভাজতে অনেক তেল লাগে। নবাবগঞ্জের বেগুন নিয়ে অন্য এক কাহিনি শুনিয়েছিল টুটুলদা। কলকাতার এক বিখ্যাত সাহিত্যিক, কলকাতার কেন বাংলা সাহিত্যের আন্তর্জাতিক আইকন ছিলেন তিনি, নবাবগঞ্জের বেগুন বিশেষ পছন্দ করতেন। মালদায় এলে তাঁর জন্য তৈরি হত বেগুন পোড়া। না, কলাইয়ের ডালের রুটির সঙ্গে নবাবি বেগুনের স্বাদ নিতেন না সেই সাহিত্যিক। নিতেন…।

ছবি— বিপ্লব দত্ত ওরফে বাপি।

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *