সনৎকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
পাঁচাল গ্রামে ‘চেতনা লোকসংগ্রহশালা’ নামে একটি সংস্থা আছে। আগ্রহী মানুষেরা একদিন ঘুরে আসতে পারেন। আগে বলে নিই, আগ্রহের আছেটা কী? কারণ আপনাদের মনে এ প্রশ্ন আসতেই পারে। মশাই, সময়ের বড্ড আকাল পড়েছে, আগে বলুন আগ্রহের আছেটা কী?
সেই তো! মানুষের আগ্রহের বিষয় বড় বিস্ময়কর। কারও আগ্রহ ঘাসের আগায় শিশিরবিন্দু, তো কারও কারও আগ্রহ আদিগন্ত সমুদ্র, কারও সবুজ বনানী তো কারও ঊষর মরুভূমি।
বলছি, বলছি। দুর্গাপুর-বাঁকুড়া মেন রোডে যামিনী রায়ের বেলিয়াতোড়। মেচা সন্দেশের গন্ধও আছে। সেখান থেকে বাঁদিকে সোজা রাস্তা যাচ্ছে সোনামুখী-পাত্রসায়র হয়ে বর্ধমান। সে-রাস্তায় তিন কিলোমিটার গেলে ছান্দার মোড়— হ্যা, ওই যেখানে উৎপলবাবুর ‘অভিব্যক্তি’ স্বমহিমায় অভিব্যক্ত। সেখান থেকে ডানদিকে প্রাক্তন বিডিআর রেললাইন পেরিয়ে, জঙ্গল-আদিবাসী গ্রাম পেরিয়ে দশ কিলোমিটার গেলে ডানদিকে একটা কাঁকুরে ডাঙা জমি দেখা যাবে। একটু নজর করলে দেখা যেতে পারে ‘চেতনা লোকসংগ্রহশালা’র লাল টিনের চাল। পিচ রাস্তা ছেড়ে ডানদিকে নেমে পড়ুন কাঁকুরে ডিহির বুকে। তারপর লাল টিনের চাল লক্ষ্য করে পাঁচশো মিটার।
বিঘেখানেক জায়গা গাছপালা দিয়ে ঘেরা। তার একপ্রান্তে একটা লম্বাটে মাঠকোঠা। সামনে এবং দু’পাশে লম্বা টানা বারান্দা। আশি ফুট লম্বা ও বাইশ ফুট চওড়া। মূল সংস্থার নাম ‘বিজ্ঞান ও সমাজ’। অনিয়মিত ‘চেতনা’ পত্রিকা সংস্থার মুখপত্র। সংস্থার মাসিক স্বাস্থ্য-ক্লিনিকের নাম ‘চেতনা স্বাস্থ্যকেন্দ্র’। এখানেই চারটি ঘরের একটিতে গড়ে উঠেছে ‘পাঁচাল চেতনা লোকসংগ্রহশালা’— পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম সম্ভাবনাময় সংগ্রহশালা।
এবার বলি, সংগ্রহশালার দ্রষ্টব্যের কথা। আস্ত ঢেঁকি আছে একটা। চরকা দু’রকম— পেটি চরকা আর বরদলৈ চরকা। চোখ জুড়নো হাতের কাজের নিদর্শন দু’টো কাঁতা আছে— একটা রাঢ় বাংলার আদিবাসী কাঁথা আর একটা একশো পেরনো বাংলাদেশি কাঁথা।— মনে হবে পেতে শুই, মুড়ি দিয়ে খানিক ঘুমোই।
তালা আছে ছোট থেকে বড়, লোহা এবং পেতলের তৈরি, যাদের আমরা গত শতাব্দীর শেষদিকে ত্যাগ করেছি। যাদের চাবির গোছা ঝুলত দিদিমা-ঠাকুমাদের আঁচলে। ধান-চাল-মুড়ি মাপার পাই-সের-কুনকে— পেতলের-বেতের-কাঠের, সেসব তো আছেই।
আছে প্রথমদিকের ভালব রেডিয়ো— এইচএমভি, মারফি। রেকর্ডপ্লেয়ার— এইচএমভি ফিয়েস্টা ক্যালিপসো। আছে হালদা রেমিংটন টাইপরাইটার, পোর্টবল টাইপরাইটার। পকেট ঘড়ি আছে দু’টো। আর আছে বিভিন্ন মডেলের টেবিল ঘড়ি, দেওয়াল ঘড়ি, জাহাজে ব্যবহৃত তামার খোপে এইট ডেজ ঘড়ি এবং কালো রঙের ডায়াল ল্যান্ডফোন। গত শতাব্দীর প্রথম দিকরা থেকে শুরু করে এই সেদিনের বেশকিছু ক্যামেরাও।
তালপাতার পুথি আছে। তুলোট কাগজের পুথি (মূলত কুলজি পুথি/পূজামন্ত্র/ব্যাকরণ)। আছে লোকসংস্কৃতির দুষ্প্রাপ্য উপাদান ‘যমপট’। এ ছাড়া পাটের টুপি, পাতার টুপি, বাঁশের টুপি।
বেশকিছু মুদ্রাও আছে। নবাবি-ইংরেজ আমল থেকে শুরু করে হাল আমল তক। আদ্যিকালের যে-লাইট, পেট্রোম্যাক্স, হ্যারিকেন, বিষ্ণুপুরী লন্ঠন, কুপি/ডিবরি।
পেতলের নানারকম তৈজস, যা সাধারণত পুজো-আচ্চায় ব্যবহার করা হত। গয়না রাখার বাক্স, মুদ্রা রাখার বাক্স, জাঁতি, কাজললতা, ঝিনুক, পান সাজার বাক্স। ইকনমিক কুকারও আছে। কাঠের চাকা আছে দু’টো— গরুর গাড়ির চাকা, যা এখন প্রায় অবলুপ্ত।
এ ছাড়া মাছধরার উপকরণ পাশি, ঘুনি ইত্যাদি। ঘুনি এখনও ব্যবহার করা হয়। গ্রামবাংলায় পাশি বানানোর শিল্পী মানুষগুলি বোধহয় আর নেই। আদিবাসী শিকারির তির-ধনুক আছে।
আমিনের জমি মাপার শেকল, ব্রিটিশ আমলের বাটখারা নিখুঁত মাপের জন্য ছ’ইঞ্চি মাপের পেতলের ফোল্ডিং দাঁড়িপাল্লা, উমাচরণ কর্মকারের জুয়েলারি দাঁড়িপাল্লা এবং চিঠিপত্র ওজনের জন্য ভিন্ন ডিজাইনের দাঁড়িপাল্লা। নারকেল মালার হুঁকো, কাঠের হুঁকো, পেতলের হুঁকো আছে।
সংগ্রহশালার সামনের প্রাঙ্গনে যে গাছগুলো আছে তা-ও চোখের সামনে থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে মানব সভ্যতার ‘উন্নয়ন’এর গুঁতোয়। তাদের গায়েও একবার হাত বুলিয়ে আসতে পারেন। পরিচয় করিয়ে দিই— কদম, বয়েরকুড়ি, পিয়াশাল, তেরচোখা, জিলিপিফল, মোল, শিমূল, হরিতকি, বহেড়া ইত্যাদি।
দেখা হয়ে যেতে পারে থুতুপোকা বা কাঠিপোকার সঙ্গেও, ওরা গাছেই থাকে। তবে গেলেই দেখা পাবেন— এ কথা হলফ করে বলতে পারি না, কেন না ওরা গেছোদাদা। আজ চেতনায় তো কাল…।
কী মনে হচ্ছে— আগ্রহের আছে কিছু? এসেই দেখুন না, সবই ফাঁকি কি না!
পুনশ্চ: পাঁচাল চেতনা লোকসংগ্রহশালার অতিথিশালায় একরাত কাটিয়ে যেতে পারেন ইচ্ছে হলে। ব্যবস্থা সাধারণ, তবে অসুবিধে হবে না। শুধু একটু জানিয়ে আসতে হবে। এখান থেকে ঘুরে নিতে পারেন ২৫ কিলোমিটার বৃত্তের মধ্যে সোনামুখীর প্রাচীন মন্দিরগুলি। বিষ্ণুপুর। অযোধ্যা, বহুলাড়া, ডিহর, কাঁকিল্যা। বিষ্ণুপুর থেকে আর একটু এগোলেই গনগনি গিরিখাত। ‘বাংলার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন’।
যোগাযোগ- দেবাশিস মুখার্জি ৯৭৩২০৮৭১৯৬
গুগল ম্যাপ- চেতনা লোকসংগ্রহশালা পাঁচাল।
কভারের ছবি— সংগ্রহশালা ও সুন্দর।
ছবি- লেখক
(সমাপ্ত)