নন্দিতা দাস
গত ডিসেম্বরের কোনও এক মনমরা সন্ধ্যে। মঙ্গলবারের সাপ্তাহিক বৈঠক থেকে ফিরে অগ্রজ জানালেন ঘুরতে যাওয়া হবে। সবাই মিলে। গন্তব্য গনগনি। রীতিমতো উচ্ছ্বসিত হবার মতোই খবর বটে। সেই নবম/দশম শ্রেণিতে আবহবিকার ও ভূমিক্ষয় পড়তে গিয়ে গনগনির সঙ্গে পরিচয়। সেই পরিচয় আরও একটু গভীর হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে মেদিনীপুরে থাকাকালীন। মেদিনীপুর স্টেশন থেকে বেরিয়ে যে পথে যেতাম সেখানে প্রথমেই চোখে পড়বে রাণি শিরোমণির আবক্ষ মূর্তি। মনে কৌতূহল জাগে কে ইনি?
ফেলুদার সিধুজ্যাঠা ছিলেন। আমার মুশকিল আসান সেজোজেঠু আছেন। এসে জানাতেই কৌতূহল নিরসন। হাতে পেয়ে গেলাম মেদিনীপুরের ইতিহাস ও উপজাতি বিদ্রোহের তথ্যসমৃদ্ধ বই। পড়লাম অচল সিংহের কথা, চুয়াড় বিদ্রোহের কথা। ইতিহাসের প্রতি আকর্ষণ চিরকালীন। মেদিনীপুরের পরতে পরতে ইতিহাস। কাজেই ইতিহাস ছুঁতে চাওয়ার ইচ্ছে মনের ভিতর তীব্র হতে থাকে। পরিকল্পনা ছিল ফাইনাল সেমেস্টারের পরীক্ষা দিয়ে গনগনি, পাথরা, কর্ণগড় ইত্যাদি জায়গাগুলো ঘুরে নেব। কিন্তু ইতিমধ্যে করোনা অতিমারির আগমন ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অপ্রত্যাশিত সমাপ্তিতে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। কাজেই এই আকস্মিক স্বপ্নপূরণে আমি যারপরণাই আহ্লাদিত। শুরু হল দিন গোনা।
অবশেষে ২৬ জানুয়ারির সকাল। ভোর-ভোর উঠে স্নান করে তৈরি হয়ে নিয়েছি। গাড়িও এসে গিয়েছে। এবার রওনা দেব সকলে। দল এবার বেশ ভারী। এটা ঠিক ‘যথা ইচ্ছা তথা যা’ দলের ভ্রমণ নয়। এটা অনেকটা দলের সদস্যদের পারিবারিক সফর। আমার মা-বাপি, দাদা, ভাইঝি। ইন্দ্রদার বাবা-মা, ভাইপো-ভাইঝি। বড়দার বাবা-মা সব মিলিয়ে মোট ১৩ জন। কিন্তু ব্যাপারটা তখনও যেন ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। আসলে বোধহয় এমনই হয়, বহুদিনের বহু কাঙ্ক্ষিত কিছুর হঠাৎ করেই নাগাল পেয়ে গেলে বোধহয় এমনই বিহ্বল লাগে। সবকিছুই স্বপ্ন-স্বপ্ন মনে হয়। কিন্তু না। এটা স্বপ্ন নয়।
সকালের নরম রোদ গায়ে মেখে শুরু হলো আমদের পথ চলা। জগৎবল্লভপুর ছাড়িয়ে একটু এগোতেই রাস্তার দু’পাশে কেবল আলুখেত আর হিমঘর। হালকা হাসি-মজা, এর-তার পিছনে লাগা, মাঝে মাঝে গাড়ি থামিয়ে হাত-পা ছাড়িয়ে নেওয়া করতে করতে এসে পৌঁছলাম কামারপুকুর। ইন্দ্রদা গুগল ম্যাপ খুলে রেখেছিল। এবং যথারীতি ঘুরপাক খাইয়েছিল। কামারপুকুর থেকে বদনগঞ্জের রাস্তায় ঢুকতে দু’পাশের প্রকৃতি একটু বদলে গেল। এখন দু’পাশে লাল মাটি, আর হালকা জঙ্গল। মাঝে মাঝে জনবসতি। তবে আলাদা করে যা চোখে পড়ে তা হলো মাটির দোতলা বাড়ি আর আদার চাষ। যাচ্ছি তো যাচ্ছি। চাষের জমি পার করে একটা দু’টো পাড়া চোখে পড়ছে। আমার দাদা আর ইন্দ্রদা ছবি তুলছিল। না, প্রথমে ইন্দ্রদা ছবি তোলেনি। অথচ দলের মধ্যে ওর ক্যামেরাই সবচেয়ে দামি। জানলার ধারে বসেছিল বড়দা। মানে দীপকদা। কী মন গেল বড়দা ইন্দ্রদাকে জানলার ধারটা ছেড়ে দিতে চাইল। কিন্তু ইন্দ্রদা রাজি নয়। জানলার ধারে কে না বসতে চায়! ব্যাপারটা কী? ইন্দ্রদা বলল, ‘‘জানলার ধারে বসলে এক্ষুণি বলবে, ছবি তোল। তার পর কোনও ছবি মিস হলে পরে খিটখিট করবে। যত বয়স বাড়ছে তত তো খিটখিটে হচ্ছ।’’ সবাই হেসে উঠল।
কত যে জনপদ পার করলাম ইয়ত্তা নেই। নামও মনে নেই। সুন্দর এক গ্রাম্য জীবন। এর মাঝে একটা ফোন এল। বড়দার সহকর্মী রূপশঙ্করদা। ওঁর ওখানেই বাড়ি। জানতে চাইলেন আমরা কোন পথ দিয়ে আসছি। বুঝিয়ে বলতে জানিয়েছিলেন, আমরা চমকাইতলা, ছোট আঙারিয়া দিয়ে ধাদিকা হয়ে ঢুকছি। বড়দা বলল, চমকাইতলা আর ছোট আঙারিয়া লেখা কিছু একটা তুললেই হবে। এই জায়গা দু’টো নাকি একসময়ে উত্তাল হয়েছিল। তার পর অনেক সুন্দর পেরিয়ে গিয়ে পৌঁছলাম শিলাবতী সেতুতে। প্রায় চার ঘণ্টার পথ পেরিয়ে। শিলাবতী নদী এই অঞ্চলের প্রাণস্বরূপা। ঢুকে পড়লাম গড়বেতায়। ধাদিকায় পৌঁছে রূপশঙ্করদাকে ফোন করার কথা ছিল। বড়দা ভুলে গিয়েছে।
গড়বেতায় গিয়ে ফোনাফুনি হল। বাইক নিয়ে হাজির হলেন রূপশঙ্করদা। হাসিখুশি মানুষ। ঘুরে নিলাম সর্বমঙ্গলা মন্দির। সে গল্প পরে হবে। আমরা আজ গনগনির গল্প করব। তার আগে কিছু খেয়ে নেওয়া দরকার। সে ব্যবস্থা রূপশঙ্করবাবু এক জায়গায় করেই রেখেছিলেন। সেখানে খেয়ে নিলাম। কাছেই চুয়াড় বিদ্রোহের নেতা অচল সিংহের নামে স্টেডিয়াম। ইতিহাস বলছে, অচল সিংহ ছিলেন লায়েক বিদ্রোহের নেতা। ইংরেজরা চুয়াড় বিদ্রোহ নাম দিয়েছিল। স্টেডিয়ামের পাশে বিনোদ ধাড়া মঞ্চ। বিনোদ ধাড়া ছিলেন মঞ্চ অভিনেতা। তাঁর আরেকটি পরিচয়, তিনি বিখ্যাত যাত্রাশিল্পী গুরুদাস ধাড়ার বাবা। সে সব দেখে এসে রওনা দিলাম গনগনি।
লালমাটি, দু’পাশে কাজুর বন-গাড়ির মধ্য বসে টের পাচ্ছি হৃদপিণ্ডের গতিবেগ বাড়ছে উত্তেজনায়। কিন্তু যেখানে এসে নামলাম গাড়ি থেকে সব উৎসাহ মুহুর্তে ফুস। এতদিন গনগনি বললেই জঙ্গল আর প্রকৃতির নির্জনতার মাঝে শিলাই বা শিলাবতী নদীর শান্ত প্রবাহের যে ছবি মনে মনে ভেবে এসেছি –তার কোথায় কী! এ তো রীতিমতো পিকনিক স্পট। লোকে লোকারণ্য। একপাশে তারস্বরে মাইকে গান বাজছে। তার মধ্যে যেটা সবথেকে বেশি বিরক্তি জাগায় তা হল চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা আবর্জনা। যদিও আবর্জনা ফেলার নির্দিষ্ট পাত্র রয়েছে, কিন্তু সেগুলোর সদব্যবহার করার সদিচ্ছে বেশিরভাগ মানুষেরই নেই।
মন খারাপ চেপে রেখে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম নদীর পাড়ে। নদীতে অগুন্তি মানুষের ভিড়। সকলেই ভ্রমণার্থী। স্থানীয় কয়েকজন মাছ ধরছেন টায়ারের ভেলায় করে। জায়গাটা সত্যিই অপূর্ব। যদি ভিড়-ভাট্টা, হইহট্টগোলকে উপেক্ষা করে মনে মনে একাত্ম হওয়া যায়, তাহলে মন্দ লাগবে না। শিলাইয়ের ক্ষীণস্রোত, চারপাশের লালমাটির ক্ষয়, পাড়ের উপরের জঙ্গল-এসবের আকর্ষণ এড়িয়ে যাওয়া সহজ নয়। শিলাইয়ের পাড়ে দাঁড়িয়ে আমরা ছবি তুলছি, হঠাৎ দেখি একটা দল ফিরছে অন্যদিক থেকে। দলের একজনের হাতে প্রায় আড়াই কিলো ওজনের একটি রুই মাছ। বললেন একজনের জালে পড়েছিল। কিনেছেন ৫০০ টাকায়। টাটকা মাছ।
আরও বেশ খানিকক্ষণ নদীর পাড়ে থেকে ছবি-টবি তুলে আমরা চলে এলাম উপরে। আমাদের মা-জেঠিমারা হাঁটতে পারছেন না। এদিকে ‘দেখি ওদিক থেকে একটু ভাল ছবি পাই কিনা’ বলে দাদা আর ইন্দ্রদা সেই যে গেছে আর ফেরে না। বড়দাও ছিল ওদের সঙ্গে। এদিকে রূপশঙ্করবাবু বড়দাকে খুঁজছেন। ওদের ফোন করলেই বলে এই তো এসে গেছি। কিন্তু আসে আর না। অপেক্ষা করতে করতে বাচ্চা-বুড়ো সবাই হতাশ। অনেকক্ষণ পর ফিরে বলে কী ‘তোরা গেলি না তো? ওদিকে দারুণ একটা জায়গা ছিল!’ এদিকে ওরাই আমাদের বলেছিল চলে আসতে। কীরকম দুঃখ হয় বলুন তো! তার পর ইন্দ্রদা একটা জায়গা নিয়ে গেল আমাকে আর ওর দুই ভাইপো-ভাইঝিকে। যেখানে সবাই ছবি তোলে। সেই যে ভূমিক্ষয়ের গায়ে একটা খোদলের মতো। ওখানেই নাকি ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ সিনেমার শ্যুটিং হয়েছিল।
গনগনি এখন প্রকৃতির কারণে বিখ্যাত হলেও এটি কিন্তু ঐতিহাসিক স্থান। বিনয় ঘোষ জানাচ্ছেন, গড়বেতা এলাকাটি আগে বগড়ি পরগনার অধীন ছিল। গনগনিকে অনেকে মাঠ বলে থাকেন। গনগনির মাঠ। আগে নাকি এই মাঠ শালবনে ভরা ছিল। শালবন কেটে মাঠ ও বসতি হয়েছে। আর মাঠটির বর্তমান ভূমিরূপ তৈরি হয়েছে বর্ষার জলধারার অবিরাম ক্ষয়ে।
কেন গনগনি নাম? বিনয় ঘোষের মতে, প্রবল গ্রীষ্মে এই মাঠ থেকে আগুনের হলকা ওঠার মতো দেখায়। যেরকম দেখা যায় নিজেদের এলাকাতেও। আগুনের মতো গনগনে বলেই এমন নাম। এই গনগনির মাঠেই লায়েক বিদ্রোহ বা পাইক বিদ্রোহ হয়েছিল।
এদিকে সূর্য অনেকখানি পশ্চিমে ঢলেছে। আমাদের এখনও দু’টো জায়গা যাওয়া বাকি। কাজেই মনমরা হয়ে চেপে পড়লুম গাড়িতে। শিলাই, কাজু বন, সব পিছনে ফেলে রেখে আমরা এবার চললাম পরিমল কানন। এটা একটা পার্ক। পিকনিক স্পটও বটে। আমরা যখন পৌঁছলাম তখন ঘড়িতে ৫টা বাজতে মাত্র ১৫ মিনিট বাকি। ৫টার পর ঢোকা যাবে না। তাড়াহুড়ো করে টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম।
ছুটির দিন হওয়ায় পার্কে তখনও বেশ ভিড়। পার্কের আকর্ষণ বিভিন্ন পাখি আর রঙিন মাছ। টয়ট্রেনও আছে। কিন্তু চাপার উপায় নেই। খারাপ হয়ে পড়ে আছে। টয়ট্রেনের স্টেশনের ধারে একচোট ছবি তোলা হল। পার্কের ভিতরে ইন্দ্রদার বোটিং করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু অন্যরা রাজি না হওয়ায় শখ পূরণ হল না।
পার্কে সব কিছু দেখে বেরোতে বেরোতে অন্ধকার হয়ে গেল। এর পর যাওয়ার কথা আরাবাড়ির জঙ্গলে। এই জঙ্গল ঐতিহাসিক ভাবে বিখ্যাত। এখানেই এক বাঙালি বন আধিকারিক প্রথম জঙ্গল রক্ষায় জঙ্গল ও সংলগ্ন এলাকার গ্রামবাসীদের যুক্ত করেছিলেন। যাঁর মডেল এখন জঙ্গল রক্ষায় সারা পৃথিবীতে মানা হয়। ওই আধিকারিকের নাম অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কাজের জন্য পশ্চিমবঙ্গ বন সুরক্ষা কমিটি পল গেটি পুরস্কার পায়। এই পুরস্কারকে পরিবেশ বিষয়ে নোবেল পুরস্কার বলা হয়।
আরাবাড়ি আমাদের যাওয়া হয়নি। অনেক দেরি হয়ে গেছে। রাস্তায় অসম্ভব যানজট। ফিরতে হবে এতটা রাস্তা। কাজেই এবারের মতো মিশন আরাবাড়ি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে বাড়ির পথ ধরাই স্থির হল। অবশ্য আড়াবাড়ি না যেতে পারার আফশোস কিছুটা মিটিয়েছে গনগনি থেকে পরিমল কানন যাওয়ার রাস্তা। এই রাস্তার দু’পাশে ঘন জঙ্গল। রাস্তার পাশে সতর্কীকরণ চোখে পড়ে-‘হাতি পারাপারের রাস্তা। গাড়ি আস্তে চালান’।
আবার সেই একই পথে ফেরা। রাতের বেলায় চাঁদের আলোয় জঙ্গলকে যেন আরও মোহময়ী লাগছিল। মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। এবারের বেড়ানোটা অন্যরকম। প্রতিবার দাদারা নিজেরাই ঘুরে আসে। মাঝে মাঝে সময়-সুযোগ বুঝে আমার মতন দু’একজন অর্বাচীনকেও দলে নেয়। কিন্তু বাড়ির বড়রা বা বাচ্চাগুলো খুব একটা বেরোতে পারে না। মাঝের অতিমারির সময়টা তো আরও বেশি ঘরবন্দি হয়ে পড়েছিল সবাই। ফলে এবারের বেড়ানোয় ওঁদের ভাললাগাটা বেড়ানোর আনন্দে কয়েকগুণ বেশি খুশি যোগ করেছে।
ছবি— দীপু আর ইন্দ্র
(সমাপ্ত)