নন্দিতা দাস
অনেক গলি সাবধানে পার করে অবশেষে একটা জায়গা মিলল। যেখানে লোকজনের অসুবিধে না করেই গাড়িটা রাখা যায়। ভাড়ার গাড়িটা বেশ বড়। আমাদের দলটাও বড়। পরিবার পরিজন নিয়ে এই প্রথমবার ঘুরতে বেরিয়েছে ‘যথা ইচ্ছা তথা যা’র কোর কমিটির তিন সদস্য। ফলে বড়সড় গাড়িই ভাড়া করতে হয়েছে। আর গলি এলাকায় গাড়ি আটকে যাবে কিনা সেই ভয় বারবারই পাচ্ছিলাম আমরা।
আমরা এসেছি গড়বেতায়। আর ঘোরার পথ প্রদর্শক হিসেবে পেয়েছি এক সুন্দর মনের মানুষকে। রূপশঙ্কর ভট্টাচার্য। আমাদের বড়দা, মানে দীপকদার সহকর্মী। তিনিই পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন। এবং যেতে যেতে গড়বেতার নানা ইতিহাস ও মন্দিরের কথা শোনালেন। রূপশঙ্করদা বললেন, এখন যে ভূখণ্ডটি গড়বেতা নামে পরিচিত তা একসময়ে বগড়ি পরগনার অধীন ছিল। আর গড়বেতা ছিল সেই পরগনার রাজধানী। লোকে ধীরে ধীরে বগড়ির নাম ভুলেছেন। রয়ে গিয়েছে গড়বেতা। এক বিশাল অঞ্চল প্রশাসনিক ভাবে গড়বেতা নামে পরিচিত।
এখন আমরা যাচ্ছি সর্বমঙ্গলা মন্দিরে। গড়বেতার অতি প্রাচীন মন্দিরগুলোর একটি। কিংবদন্তী এবং ইতিহাসে ভরা। যেতে যেতেই পথে পড়ল একটা মন্দির। একেবারেই সাধারণ চেহারার। পাড়াগাঁয়ে এরকম বহু মন্দির দেখেছি। কিন্তু রূপশঙ্করদা বললেন, এটা ষষ্ঠী মন্দির। এর একটা বিশেষত্ব রয়েছে। এই মন্দিরে ষষ্ঠীর মূর্তি রয়েছে। যা অন্য কোথাও দেখা যায় না। সত্যি কথা। আমাদের গ্রামেও ষষ্ঠী ঠাকুরের থান আছে। মন্দির তো দূরের কথা একটা বেদী পর্যন্ত থাকে না। গাছতলায় পড়ে থাকেন দেবী। দেবী বলতে এক খণ্ড পাথর।
দল বেঁধে ষষ্ঠী ঠাকুরের ইতিহাস শুনছি। সেই সময়েই একটা বাইক এসে থামল। রূপশঙ্করদা পরিচয় করালেন, হরগোবিন্দ সিং। ইনি আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চাকারী। সর্বমঙ্গলা মন্দির কমিটির সঙ্গেও যুক্ত। আমরা এগোলাম মন্দিরের দিকে। হরগোবিন্দবাবুও বাইক নিয়ে এগিয়ে গেলেন। এদিকে পিছিয়ে পড়েছেন আমার অগ্রজ দীপশেখর। তিনি খেলতে গিয়ে পায়ে চোট পেয়েছেন। ফলে পা টেনে টেনে আসছেন।
সর্বমঙ্গলার মন্দিরের পথে ষষ্ঠী মন্দির থেকে কিছুটা এগোতেই পড়ল পরপর দু’টো স্তম্ভ। রূপশঙ্করদা জানালেন, এগুলোর একটি হল সূর্যকুমার অগস্তির স্মৃতিফলক। অন্যটিতে তাঁর মূর্তি ছিল। মূর্তিটি এখন স্থানীয় এক স্কুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বড়দা বলল, রূপশঙ্করদা আনন্দবাজারে অগস্তিকে নিয়ে সুন্দর প্রতিবেদন লিখেছিলেন। রূপশঙ্করদা পরিচয় করালেন অগস্তির সঙ্গে। জানালেন, অগস্তি অতি পণ্ডিত ব্যক্তি। তিনি গড়বেতার ভূমিপুত্র। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা করেছেন। পড়িয়েছেন সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলে। পরে কলকাতা মেট্রোপলিটন কলেজে। এই কলেজের জন্য তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। অগস্তি ছিলেন বহুভাষাবিদ। প্রায় ১২টি ভাষা জানতেন। ব্রিটিশ আমলে ১৩টি জেলায় জেলাশাসক ছিলেন। এক সময়ে মেদিনীপুরের জেলাশাসকও হন। সূর্যকুমার অগস্তির ভাঙাচোরা বাড়িটা এখনও সর্বমঙ্গলা মন্দিরের সামনে রয়েছে। ঐতিহাসিক ব্যক্তির স্মৃতি পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে।
মন্দিরের সামনে এসে বড়দা মাতৃকুলকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘‘তোমরা পুজো দেবে নাকি?’’ দেখলাম, মায়েরা সব মুখ তাকাতাকি করছে। মা মানে আমার মা, ইন্দ্রদার মা আর বড়দার মা। তিনজনের পিতারাও আবেদনে খুব একটা অরাজি বলে মনে হল না। সুতরাং সামনের দোকান থেকে পুজোর ডালা কিনে তাঁরা মন্দিরে ঢুকে গেলেন। সঙ্গে যেতে হল আমাকেও। দল আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে এই সফর লেখার। ঘুরিয়ে দেখাবেন বলে সঙ্গে গেলেন হরগোবিন্দবাবু। আর গেল দলের চুনোচানাগুলো, মিমি, অনীক, পৌলমী। প্রথম দু’জন ইন্দ্রদার ভাইপো-ভাইঝি। শেষের জন আমার ভাইঝি। ইন্দ্রদা ঘোষিত নাস্তিক। কিন্তু ক্যামেরা নিয়ে দেখলাম সে-ও মন্দিরে ঢুকল। দাদারা বলে, ইন্দ্রদাকে বোঝানো হয়েছে, ইতিহাসের সঙ্গে নাস্তিকতার কোনও দ্বন্দ্ব নেই। ইন্দ্রদা ইদানীং নাকি বুঝছে। প্রসাদও খাবার হিসেবে গ্রহণ করছে।
মন্দিরের ইতিহাস শুনছিলাম আমরা হরগোবিন্দ সিংহের কাছে। মন্দিরের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কিংবদন্তী। যার একটির সঙ্গে উজ্জ্বয়িনীর রাজা বিক্রমাদিত্য এবং তাল-বেতালের যোগ রয়েছে। একবার এক যোগী সাধক এই বগড়ির জঙ্গলে এসেছিলেন। তিনি মন্ত্রবলে সর্বমঙ্গলার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। দেবীর মাহাত্ম্যের কথা পৌঁছয় রাজা বিক্রমাদিত্যের কানে। তিনি গড়বেতায় আসেন। শবসাধনা করে দেবীকে খুশি করেন। দেবী তাঁকে অলৌকিক ক্ষমতা দেন। তাল-বেতাল দেবীর আদেশে তাঁর অনুচর হয়। রাজা অলৌকিক শক্তি দেখাতে তাল-বেতালকে নির্দেশ দেন, মন্দির উত্তরমুখী করে দিতে। তাল-বেতাল তা-ই করে। সেই থেকে দেবীর মন্দির উত্তরমুখী। হরগোবিন্দবাবু কাহিনি শুনিয়ে মন্তব্য করেন, ‘‘এটা নেহাতই কিংবদন্তী। মন্দির উত্তরমুখী হবার আসল কারণ অন্য। যেখানে তন্ত্রসাধনা হয় , পঞ্চমুণ্ডির আসন থাকে সেখানে মন্দির উত্তরমুখী বানানো হয়। যাতে সূর্যের আলো চৌকাঠ না পেরোয়।’’
সর্বমঙ্গলা মন্দিরে পঞ্চমুন্ডির আসন আছে। আগে নাকি নরবলিও হতো। জানালেন হরগোবিন্দবাবু। শেষ নরবলি হয়েছে প্রায় ৮০০ বছর আগে। যদিও নরবলির হাঁড়িকাঠটি এখনও সংরক্ষিত আছে। কাঠ নয়। সেটি ল্যাটেরাইট মাটির। তবে এখন শুধু ছাগও ও মোষ বলি হয়। তবে একসময় মল্লরাজ দুর্জন মল্ল বলি বন্ধ করে দিয়ে বৈষ্ণব মতে পুজো শুরু করেন। মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বর্গিহানার ইতিহাসও। বর্গি আক্রমণে বারে বারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মন্দির। নষ্ট হয়ে গেছে কষ্টি পাথরের আসল মূর্তিটি।
ইতিহাসের পাশাপাশি মন্দিরের আচার আচারণ-রীতিনীতির কথাও বলছিলেন আমাদের হরগোবিন্দবাবু। দেবী এখানে দুর্গারূপে পুজিতা হন। পঞ্চমী তিথিতে মায়ের ‘অঙ্গরাগ’ অর্থাৎ মোম, পারদ, গালা, সিঁদুর ইত্যাদি দিয়ে প্রতিমার মুখ তৈরি করা হয়। নিত্যভোগের পাশাপাশি বিশেষ বিশেষ দিনে বিশেষ ভোগ নিবেদন করা হয়। যেমন মকর সংক্রান্তিতে পিঠে দেওয়া হয়। মূল মন্দিরটির তিনটি অংশ বিভিন্ন সময়ে তৈরি হবার ফলে মন্দিরের গঠনশৈলী একটু বিচিত্র। তিনটি অংশের গঠনরীতি তিন রকম। শেষের অংশটি দেউলসদৃশ। পুরো মন্দিরটি মাকড়া পাথরের তৈরি। যদিও বর্তমানে সংস্কার করার ফলে পুরোটাই সিমেন্টের চাদরে ঢাকা।
আমাদের মন্দির দেখা-তথ্য সংগ্রহ শেষ। কিন্তু মা-জেঠিমারা পুজো দিতে গেছেন। ফিরতে দেরি। ২৬ জানুয়ারি ছুটির দিন। ভক্ত সমাগম যথেষ্ট। ফলে ওদের বেরতো দেরি হবে। আমরা তাই চললাম আশে-পাশে একটু ঘুরে নিতে। তার আগে মন্দিরের ঠিক সামনে রেলিং ঘেরা ল্যাটেরাইট মাটির একটা ফলক নজরে এল। এটা নাকি এখানকার জঙ্গলে অর্ধেক পোঁতা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। হরগোবিন্দবাবু বললেন, ভাল করে দেখলে একটা নারী মূর্তির বিদ্রোহের আদল চোখে পড়ে। তবে এই ফলকের সঠিক পরিচয় জানা যায় না।
আমরা মন্দির ছাড়িয়ে কিছুটা এগিয়ে গেলাম। ওদিকে মন্দিরের দেবোত্তর পুকুরগুলো রয়েছে। একটা পুকুর কচুরিপানায় ভরা। আরেকটা পুকুর বিশাল দিঘি। জলাশয়ের পাশের এক বাসিন্দা জানালেন, জলাশয়ের গভীরে নাকি শালখুঁটি পোঁতা রয়েছে। তাহলে কি ইঁদপুজো হত? ফিরতে শুরু করলাম। অগ্রজ তাল রাখতে পারছিল না আমাদের সঙ্গে। বারে বারে পিছিয়ে পড়ছে। আমরা ঘুরে এসে মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ওঁর আর দেখা নেই। খানিক পরে দেখা গেল কী এক গাছের ডাল নিয়ে ফিরছেন। অবাক হবার মতোন কিছুই না। গাছপালার ডাক্তার, দলের লোকে তো দাদাকে মিস্টার ঘাসপুস বলে। যেখানেই যান এরকম কিছু না কিছু নিয়েই ফেরেন। তবে অবাক হয়েছিলাম গাছের নাম শুনে, বিশল্যকরণী। জানি না কেন আমার হঠাৎ রামায়ণের বিশেষ একটি দৃশ্যের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। হনুমান বিশল্যকরণী নিয়ে ফিরছে। যাই হোক, ইতিমধ্যে মায়েদের পুজো দেওয়া হয়ে গিয়েছে।
সর্বমঙ্গলা মন্দির থেকে বেরিয়ে একটু দূরেই মল্লরাজ দুর্জন মল্লের প্রতিষ্ঠিত রাধাবল্লভ মন্দির দেখে নিয়ে উঠে পড়লাম গাড়িতে।
এবার আমাদের গন্তব্য গনগনি। সে গল্প তো আগেই শুনিয়েছি।
কভারের ছবি— সর্বমঙ্গলা মন্দিরে চুড়ো।
ছবি— দীপু, ইন্দ্র
(সমাপ্ত)
পুকুরের মাঝখানে শাল খুঁটি ইঁদ পূজার জন্য নয়। পুকুর প্রতিষ্ঠা করার সময় মাঝখানে পোঁতা হয়। কোথাও কোথাও ছোট মন্দিরের মতো নির্মাণ করা হয়। আমাদের ওখানে মাঝখানের খুঁটিকে রুই বলে। অনেকে সাঁতার দিয়ে সেটি ছুঁয়ে আসে।— এ কথা জানালেন গড়বেতার বাসিন্দা, লোকসংস্কৃতির এক গবেষক। আমাদের গ্রুপের সুহৃদ। তিনি মেঘনাদের মতো আড়ালে থাকতে ভালবাসেন বলে তাঁর নাম প্রকাশ করা গেল না।