দীপক দাস
সে বেহুলা ছিল পালাগানের। হতে পারে পুতুল নাচেরও। তখন দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণি। জীবনানন্দের বেহুলা গাঙুড়ের জলে ভেলা ভাসিয়েছিলেন কিনা তখনও জানা হয়ে ওঠেনি। তবে চাঁদ সদাগরের মিষ্টি পুত্রবধূর সর্বনাশের কাহিনি প্রথম জেনেছিলাম পুতুল নাচ থেকে। আমাদের গ্রামের দু’টো গ্রাম পরে বড়গাছিয়া হাসপাতাল মাঠে একবার পুতুল নাচের আসর বসেছিল। ছোট পিসি আমাকে আর পাড়ার কাকে কাকে যেন নিয়ে পুতুল নাচ দেখতে গিয়েছিল। হাতের নাচে, আলোর কায়দায় মুগ্ধ হচ্ছিলাম বটে। কিন্তু বাড়ি ফিরতে হয়েছিল বেহুলার স্বামী হারানোর হাহাকারের কষ্ট বুকে নিয়েই।
তার পর তো বইয়ে পড়লাম মনসামঙ্গল কাব্যের গদ্য রূপ। সিনেমাও বোধহয় দেখেছি একটা। তারও অনেক পরে এলেন জীবনানন্দ দাশ। আমার নাগালে। বেহুলা গাঙুড়ের জলে ভেলা ভাসাল। আরেক বেহুলা একসময়ে নজরে পড়ল। সে এক স্টেশন। ব্যান্ডেল-কাটোয়া শাখার। আমার মামার বাড়ি ওই লাইনেই। তাই আসতে-যেতে অনেকবার দেখা হয়েছে। ট্রেন থেকে স্টেশন দেখতে পেয়ে একবার বাবা-মাকে জিজ্ঞাসাও করা হয়েছে, ‘‘বেহুলা-লখিন্দরের কি এখানেই বাড়ি ছিল?’’ এই জিজ্ঞাসা সম্ভবত পড়তে শেখা আর পুতুল নাচের পরবর্তী সময়ে। না হলে স্টেশনটা তেমন তাৎপর্যপূর্ণ মনে হত না।
তার পর বড় হয়েছি। মামার বাড়ি যাওয়া কমেছে। স্টেশনটি ধীরে ধীরে হারিয়ে গিয়েছিল। বেহুলা আবার তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠল আমাদের গ্রুপের নদীর নামে স্টেশনের খোঁজখবরে। গ্রুপের সদস্য এবং পাহাড় প্রিয় লেখক শ্রীধর বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিল, বেহুলা নামে একটা নদী আছে। সুতরাং ‘চলো বেহুলা’। করোনা অতিমারিতে বেরনো প্রায় হয়নি। এদিকে গ্রুপের সদস্যরা নানা কাজে ব্যস্ত। ফলে ঠেকলাম আমি আর ইন্দ্র। বেরিয়ে পড়লাম এক মঙ্গলবার। বহুদিন পরে মঙ্গলে ঊষা, বুধে পা দিল। এই সফরের সঙ্গে জুড়ে নিয়েছিলাম আরও দু’টো সফর। স্টেশনে নেমে বেহুলাকে দেখা সম্ভব ছিল না। ব্যান্ডেল-কাটোয়া লোকালে বসে ঠিক হল, ইন্দ্র ওর ক্যামেরা নিয়ে ট্রেনের একদিকের গেটে দাঁড়াবে। আমি মোবাইল আর পরকলা পরিহিত চোখ নিয়ে উল্টোদিকের গেটে।
ট্রেন ছাড়ল। ট্রেনেই আলাপ করে নিয়েছিলাম সংগ্রাম গোস্বামীর সঙ্গে। বাচ্চা ছেলে। সোমড়াবাজারে বাড়ি। সংগ্রাম জানাল, বেহুলা নদীটা পড়বে স্টেশনে ঢোকার আগে। ট্রেন থেকে দেখতে পেলাম বেহুলাকে। অতি ক্ষীণকায়া সে। তবুও তার শ্যামল পাড়ে একটা নৌকা বাধা আছে। বেহুলাকে যেন একটু মানমর্যাদা দিয়েছে সেই নৌকা। যে নদীর বুকে নৌকা চলে না, তার আবার মান কীসের! ট্রেনের গতি কমলো। ধীরে ধীরে স্টেশনে ঢুকল ট্রেন। চোখ জুড়নো স্টেশন। আপ-ডাউন দু’দিকের প্ল্যাটফর্মের খুব কাছেই প্রচুর গাছপালা। ইন্দ্র তো ডাউন প্ল্যাটফর্মের গা ঘেঁষে দু’টো শিমূল গাছও পেল। রাঙা হয়ে আছে ভরা বসন্তে। আর আপের দিকে আমি পেলাম ছাতিম গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি দেওয়া বেহুলাকে। বেহুলা লেখা নাম-বোর্ড। আর প্ল্যাটফর্মের রেলিংয়ের কিছুটা দূরেই একটা বিশাল বটগাছ। যাকে সংস্কৃতে বলে ন্যগ্রোধ পরিমণ্ডল। তেমনই বিশাল আর ছায়াময়। বেশ লাগল। খুব সুন্দর।
ব্যান্ডেল থেকে কাটোয়া লোকালে গেলে একটা প্রাণের স্পন্দন মেলে। নানা রকম হকার। আর জানলা দিয়ে বাইরে তাকালে অপরূপ বাংলা। আদিগন্ত চাষের জমি। হরেক রকম চাষ। কোথাও আলু তুলে বস্তায় রাখা হয়েছে। কোথাও তিল বা সরষে ডাঁই করে রাখা। ধানের সবুজ জমির সঙ্গে আছে কিছু চিনতে না পারা ফুলের চাষও। আর আছে প্রচুর আমবাগান। এখন বসন্ত ফলে গাছে গাছে ঝেঁকে মুকুল। এখন একরকম রূপ। আরেকটু পরে গেলে আমে ভরা গাছ। আম রক্ষায় বাগানে মাচা বেঁধে পাহারার ব্যবস্থা। শীতকালে গেলে বাগানের ফাঁকফোকর দিয়ে নিস্তেজ সূর্যের আলো-আঁধারি।
এই এলাকায় বেহুলাই কি এক সময়ে প্রাণ প্রবাহ ছিল? সঠিক উত্তর পাইনি। মানে এত খোঁজ নেওয়ার সময় ছিল না। সোমড়াবাজারের এক দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি বললেন, বাঁকিপুরের কাছে বেহুলা গঙ্গার সঙ্গে মিশেছে। কোনও এক জায়গায় কুন্তী নদীর সঙ্গেও মিশেছে। আবার সমুদ্রগড় ও ধাত্রীগ্রামের মাঝে নান্দাই নামে কোনও নদীর সঙ্গেও বেহুলা যোগ দিয়েছে। তিনি যা বললেন, তাতে মনে হল, গঙ্গার কোনও শাখা নদী। উপনদীও হতে পারে।
যাচাই করা হয়নি কিন্তু। আগেই বলে রাখছি।
ছবি— ইন্দ্র ও লেখক
(সমাপ্ত)
বঁাকিপুরে মিশেছে সত্য। আর নান্দাই এর খরে নদীর একটি শাখা নিরলগাছির উপর দিয়ে এসে বাঘনাপাড়া স্টেশনের পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কয়েক মাইল দূরে আদি বেহুলার সাথে মিশেছে।
আমাদের গ্রুপের সদস্য অরূপ ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, বেহুলাকে গঙ্গার উপনদী বলা যেতে পারে। আসলে আপনি নদীর যে বিস্তার দেখেছেন, তা গঙ্গার প্রায় সঙ্গম স্থলে। প্রকৃত পক্ষে খুবই সংকীর্ণ। নদী না বলে সোঁতা বলা চলে। দামোদর এ বাঁধ দিয়ে দুই দিকে যে সেচ খাল তার উত্তরের খালটির সাথে এর সংযোগ আছে। অফ্ সিজনে জল ছাড়লে বেহুলা তে জল আসে( বোরো ধান রোয়ার সময়)। বেহুলা নদীটির প্রচুর বাঁক। আমার এলাকার (কালনা) বহুগ্রাম হয়ে এক সময় উত্তরাভিমুখী হয়ে হুগলীর প্রান্ত দেশে ছোঁয়া দিয়েছে। তারপর বর্ধমান ও হুগলির সীমান্তভেদের দায়িত্ব সামলে পাকাপাকিভাবে হুগলিতেই বিচরণ করতে করতে গুপ্তিপাড়ার পাশ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে গঙ্গালাভ করেছে।
অরূপবাবু এই মন্তব্য ফেসবুকে আমাদের গ্রুপে করেছেন। সেখান থেকে সংগ্রহ করে তথ্য এক জায়গায় আনলাম।