দীপশেখর দাস
‘অফ বিট ভ্রমণ’ শব্দগুলো এখনও তেমন পুরনো হয়নি। আমাদের গ্রুপে তো তারই জয়জয়কার। ভ্রমণস্থলের কেন্দ্রবিন্দু ছেড়ে অপেক্ষাকৃত নির্জন, কোলাহলমুক্ত এলাকায় পৌঁছে যেতেই এখন উদগ্রীব সবাই। সময়টা একটু পিছিয়ে নিয়ে যাই। ডিসেম্বর মাস। আনলক পর্ব চলছে। করোনার ভয় তখনও এই বঙ্গ থেকে যায়নি। নেহাত কাজের প্রয়োজনেই যেতে হয়েছিল দার্জিলিং। দার্জিলিং শহর তখন ভিড়ে ঠাসা। মাস্ক? শতাংশের হিসাবে হয়ত ৩০ জনের মুখে। শহর আমাদের মন ভোলায় না। ইট-সিমেন্ট-বালির জঙ্গল নয়, সবুজ-শ্যামল সাজানো বনভূমিই আমাদের মন জুড়ে।
শহরের সামান্য যা কিছু কাজ ছিল চটজলদি সেরে পৌঁছে গেলুম সোনাদা। সেখান থেকে একটা টাটা সুমো নিয়ে চটকপুর। আমাদের গন্তব্যস্থল। সোনাদা থেকে চটকপুর যত সহজে বললুম যাত্রাটা অত সহজে শেষ হয়নি মোটেই। দার্জিলিং থেকে গাড়ি ভাড়া করেছিলুম চটকপুর পর্যন্ত। ছোট গাড়ি, চার আসনের। সোনাদা ছেড়ে খানিক উপরে যেখানে পিচ ঢালা রাস্তা শেষ হয়েছে সেখানে নামিয়ে দিল সে। এই পথে এর থেকে বেশি উপরে যাওয়ার ক্ষমতা নাকি তার গাড়ির নেই। যদিও আসার সময় রাস্তাতেই এই হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছিল আমাদের। আমরা অতটাও গুরুত্ব দিইনি। ভেবেছিলুম ওখানে পৌঁছে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিয়ে যাব চটকপুর। কিন্তু ভবিতব্য আমরা বুঝিনি।
আমাদের যেখানে নামাল সেখানে আগে থেকেই একটা টাটা সুমো দাঁড়িয়েছিল। ড্রাইভারই গাড়ি ঠিক করে রেখেছিল। নামতে না নামতেই আমাদের ব্যাগপত্তর চালান হল এ গাড়ি থেকে ও গাড়িতে। আমরা ভেবেছিলুম বোঝালে বুঝবে। এ আমাদের গ্রুপের এক আদি সদস্যের প্রিয় লব্জ। তাতে কাজ হয়নি কোনওদিন। এখানেও, এই চটকপুরের পথেও আমাদেরই যে বুঝে নিতে হবে সেটা ধরতে পারিনি। তার পরের আধ ঘণ্টা টাটা সুমোয় নৌকাদুলুনি দুলে চটকপুরে পা দিলুম। রাস্তার অবস্থা দেখে বুঝলুম কেন আমাদের ফোর সিটার এ পথে চাকা দিতে চায়নি।
এখানে কিছু কথা জানিয়ে রাখা দরকার। দার্জিলিং বা নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে সোনাদা পর্যন্ত শেয়ার গাড়ি পাওয়া যায়। পাওয়া যায় বাসও। আর সোনাদা আসা যায় টয় ট্রেনে। কিন্তু সোনাদা থেকে চটকপুর এই সামান্য সাত কিলোমিটারের জন্য গাড়ি ভাড়া করতেই হয়। শুধু তাই নয়। সোনাদা থেকে পাথুরে এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় পাড়ি দিতে যেমন তেমন গাড়ি নিলে চলে না। দরকার হয় একটু বড় গাড়ির। বিশেষ করে যেসব গাড়ির গ্রাউন্ড ক্লিয়ারিং (যেসব গাড়ির তলদেশ মাটি থেকে অনেকটা উঁচুতে থাকে) বেশি। প্রবেশদ্বারে পরিচয়পত্র দেখিয়ে মাথাপিছু ১২০ টাকা দরে টিকিট এবং ৪০০ টাকা দিয়ে গাড়ি প্রবেশ করানোর টিকিট কাটতে হয়।
চটকপুরে সবই হোমস্টে। হোটেল নেই। আগেভাগে বুকিং করে আসাই শ্রেয়। হঠাৎ করে এলে জায়গা মেলা দুষ্কর। হয়তো দেখলেন জায়গা মিলল, কিন্তু খাবার পাওয়া গেল না। এখানের সব থেকে কাছের বাজার সোনাদাই। তাই বুকিং অনুযায়ী এঁরা সব বন্দোবস্ত করেন। এমনিতে ঘুরতে বেরোলে ঘর বুকিং নিয়ে মাথা ব্যথা করি না আমরা। আমার গুরুদেবেরও এসবে বারণ আছে। কিন্তু কাজের সূত্রে কোথাও গেলে সব আঁটঘাট বেঁধেই বেরোই। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম করিনি। চটকপুরে পৌঁছে ঠাঁই নিলুম সোতাং হোম স্টে।
পাহাড়ের কোলে হোমস্টে। একসঙ্গে ছ’জন থাকা যাবে এমন ব্যবস্থা। বারান্দায় বেরোলেই অসাধারণ প্রকৃতি। সেসময় পাহাড় কুয়াশায় মুখ ঢেকেছিল। মোটেই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হতে পারছিলুম না। তবুও যতটুকু পেয়েছিলুম তা এক কথায় নয়নাভিরাম। লম্বা লম্বা কনিফারেরা ঝাঁক বেঁধে জঙ্গল তৈরি করেছে। জঙ্গলের ভিতরটা নিকষ অন্ধকার। জঙ্গলের মাথার উপর দিয়ে পাতলা কুয়াশার আস্তরণ হাওয়ার স্রোতে গা ভাসিয়েছে। সাদা-কালো-সবুজ মিশে এক অদ্ভুত পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
পরদিন সকালটা একটু উজ্জ্বল হল। যদিও সূর্যের মুখ দেখা গেল না। আকাশে তখনও কুয়াশার ভিড়। কনিফারেরা ঠায় দাঁড়িয়ে। শুধু জঙ্গলের ভিতরের অন্ধকার মুঝে ধূসর হয়েছে। আমরা প্রস্তুত হয়ে নিয়ে, খেয়ে রওনা দিলুম জঙ্গলের উদ্দেশ্যে। বেশ ঘন জঙ্গল। জঙ্গলে পুরনো গাছেদের ভিড়। এক একটা গাছ দু’তিন মানুষের সমান স্বাস্থ্যবান। আর দশ তলা সমান উঁচু। জঙ্গল কোথাও কোথাও এতটাই ঘন যে আকাশ দেখা যায় না। জঙ্গলের মধ্যে একটাই চওড়া পথ। সে পথের শেষ একটা ছোট জলাশয়ে গিয়ে। জলাশয় স্থানীয়দের কাছে পবিত্র। জলাশয়ের পাড়ে কয়েকটি দেবদেবীর প্রতিকৃতি। ফুল পয়সা ইতিউতি ছড়িয়ে রাখা সেখানে। আমাদের আগে একটা জনাছয়েকের বাঙালি পরিবার সেখানে পৌঁছেছিলেন। তাঁরাও বনের ফুল তুলে, কতকগুলো টাকার অঞ্জলি দিয়ে সেখানে পুজো দিলেন দেখলুম। আমাদের পুজো দেওয়ায় মন ছিল না। আমরা তখন প্রকৃতি পুজোতেই ব্যস্ত।
জঙ্গল চষে সন্ধ্যের সময় ঘরে ফিরলুম। কুয়াশার চাদর এখনও সরেনি। হাত-পা ধুতে না ধুতেই গরম চা পেলুম। সঙ্গে ভেজ পকোড়া। সারাদিনের ক্লান্তি আর সূর্য না দেখার মন খারাপ একটু হলেও প্রশমিত হল। রাতে প্রিয়ত্নাদি (হোম স্টের মালিক) রুটির ব্যবস্থা করেছিলেন। সঙ্গে দেশি মুরগি কষা। ফেরার সময় অনেকগুলোকে উঠোনে ঘুরে বেরাতে দেখেছিলুম। তাদেরই একটা যে আমাদের উদরপূর্তি ঘটাচ্ছে সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ রইল না। দিদির হাতের রান্না বেশ ভাল। নিমেষে থালা ফাঁকা করে ফেলে হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় পিঠ দিলুম।
‘কোঁওওওওকরররর কোঁওওওও’। চিল চিৎকারে সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল। ঘরের জানালা খুলে চোখ সরাতে পারলুম না। কাঞ্চনজঙ্ঘা! সমস্ত রাগ অভিমান ভুলে আমাদের প্রতি সদয় হয়েছেন তিনি। সকালের সোনালি কিরণে ঝকমকিয়ে আমাদের চোখে মনে একরাশ প্রশান্তি ছড়িয়ে দিচ্ছে সে। তার উজ্জ্বলতা, তার ব্যাপ্তিতে আচ্ছন্ন পড়লুম। অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইলুম তার দিকে। ভাবলেশহীন হয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ দেখছিলুম। সম্বিৎ ফিরল দিদির ডাকে। চা নিয়ে এসেছেন।
সূর্যের কিরণপাশে কুয়াশার জাল কেটেছে। সাদা আস্তরণ ঘেরা চটকপুরের আজ সম্পূর্ণ অন্য রূপে আবির্ভুত হয়েছে। কনিফারের জঙ্গলের সবুজ মাথা রোদ পড়ে হলদেটে হয়েছে। জঙ্গল ছাড়িয়ে তুলোর মত সাদা পুঞ্জ মেঘ ঘন হয়ে ছড়িয়ে আছে পাহাড় অবদি। আর পুঞ্জ মেঘের প্রান্তে কাঞ্চনজঙ্ঘা। নৈসর্গিক দৃশ্য বুঝি একেই বলে!
আমাদের ফিরতে হত। ফেরার আগের দিন সূর্য আমাদের দেখা দিয়েছিল। কাঞ্চনজঙ্ঘাও। সেদিনই চটকপুর গ্রামটা ঘুরে দেখেছিলুম। সাজানো গোছানো গ্রাম। ছোট ছোট খান পঞ্চাশেক ঘর। সব ঘরেই হোম স্টের ব্যবস্থা। আর গ্রামকে ঘিরে অনন্যরূপ প্রকৃতি। কোনওদিকে তাকালে আর চোখ ফেরাতে ইচ্ছা করে না। আর আছে প্রচুর পাখি। সুন্দর তাদের ডাক। হোম স্টে থেকে, গ্রামে ঘোরার সময়ে তাদের দেখেছি। গান শুনেছি। গ্রামের নামের সঙ্গে চটক শব্দটা আছে বটে। কিন্তু চটকদারির কিছু নেই চটকপুরের। সব খাঁটি। প্রকৃতি এখানে বড়ই সুন্দরী।
শুধু মন খারাপ হয় একটা বিষয়েই। পর্যটকরা আজও সচেতন নন। জঙ্গলের ইতিউতি, ভিউ পয়েন্ট, এমনকি গ্রামের মধ্যেও ছড়িয়ে যান প্লাস্টিক বর্জ্য, সিগারেটের প্যাকেট। ভেঙে রেখে যান পানীয়ের বোতল। সুন্দরী চটকপুরের শরীরের এ কলঙ্ক যে বড়ই বেমানান। আমরা কি একটু সচেতন হতে পারি না! একটু চেষ্টাও কি করতে পারি না?
সুবিধের জন্য: সোতাং হোম স্টে-তে থাকার জন্য যোগাযোগ করতে পারেন প্রিয়ত্না রাই– ৯৪৭৬৩৮১৩০৩/৯৬৭৯২৪৫৯০৪ নম্বরে।
ছবি— লেখক
(সমাপ্ত)