পৌলমী রক্ষিত
কাজের সূত্রে যখন রাজ্যের বাইরে থাকতে শুরু করলাম, তখন যে সমস্যায় সবচেয়ে বেশি জর্জরিত হয়েছিলাম তা হল খাবার। ফল স্বরূপ প্রথম বেশ কয়েক মাস নানা কঠিন অসুখে পড়েছিলাম। খুব খিদে পেত এদিকে কিছুই খেতে পারতাম না। আদ্যন্ত ঘটি বাড়ির রান্না খেয়েছি, সে বাড়ি হোক বা মেস। টকের ডাল টক মিষ্টি, মুগের ডালের মিষ্টি খেয়ে অভ্যস্ত আমার স্বাদ কোরক। তাই উত্তর ভারতীয় খাবার দেখে প্রবল বিদ্রোহ করত। এখানে বিশেষ উল্লেখ্য, যে আমি খাবার বলতে রোজকার খাবারের কথা বলছি। বাটার চিকেন, কাবাব, বিরিয়ানির মতো বিশেষ খাবার নয়। দিল্লি প্রবাসী আমি। এখানকার ডাল, রাজমা, ছোলা, চানা, সবজির তরকারি সব খাবারই চিনি বিহীন। তার উপর রয়েছে আমিষ-নিরামিষ টক্কর। তরকারি পছন্দ না হলে রুটি। তা-ও কলা, চানাচুর সহযোগে খাওয়া যায়। কিন্তু ভাত নৈব নৈব চ।
আমার এই তথৈবচ অবস্থা দেখে অফিসের কয়েকজন সহকর্মী উদ্ধারকার্যে নেমেছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন সান্ধিয়া। বিহারে জন্ম হলেও ওঁর বাবার কর্মসূত্রে দীর্ঘদিন গুজরাতে থাকতেন। পরবর্তীকালে জামশেদপুরে। তাই প্রথম থেকেই বিহারি খাবারের পাশাপাশি গুজরাতি এবং বাঙালি খাবার সম্পর্কে ওঁর সম্যক ধারণা ছিল। সান্ধিয়া আমাকে প্রথম গুজরাতি খাবারের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন। ধোকলা এখন সব মিষ্টির দোকানে পাওয়া গেলেও অন্য গুজরাতি রান্নার সঙ্গে আমরা খুব একটা পরিচিত নই। অবিশ্বাস্য বললে কম বলা হবে, বাঙালি টক মিষ্টি ডালের মতোই গুজরাতিরাও ডাল, তরকারি সবেতেই বেশ মিষ্টি দেয়। আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করেছিলাম, দক্ষিণ ভারতীয় রান্নায় যেমন নারকেল সর্বত্র বিরাজমান থাকে, উত্তর ভারতীয় রান্নায় স্বাভাবিক ভাবে তা থাকে না। কিন্তু আমাদের বাঙালিদের ছোলার ডাল বা মোচার ঘণ্ট, নারকেল কুমরিতে যেমন নারকেলের অবস্থান দীর্ঘ না হলেও তার উপস্থিতি অনস্বীকার্য। সেরকম গুজরাতি রান্নাতেও ওই উপর থেকে নারকেল ছড়িয়ে পরিবেশন করার রীতি রয়েছে (ধোকলা, খাণ্ডবি)।
এবার আসি আমার অন্যতম প্রিয় একটি গুজরাতি খাবারের প্রসঙ্গে। শীতকাল সবার ভাল লাগলেও আমার লাগে না। এত শীতে আমার যায় যায় অবস্থা হয়, তার উপর আছে ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, মুলোর অত্যাচার। চারিদিক অন্ধকার, এই অবস্থায় প্রাণে ভরসা যোগায় টাটকা মেথি শাক। মেথি শাক এবং আরও উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয় মেথি থেপলা। এখানে বলে রাখি, জলখাবার হিসাবে গুজরাত, রাজস্থান, দিল্লিতে থেপলা বেশ পরিচিত। দিল্লিতে যে ক’দিন নার্সিংহোমে ভর্তি ছিলাম, সকালে থেপলা দিত। থেপলার প্রধান উপকরণ হল বেসন, সাধারণ পরোটা আর থেপলার প্রধান পার্থক্য এখানেই।
মেথি থেপলার প্রধান উপকরণ অবশ্যই মেথি শাক। বাকি থাকে আটা, অল্প বেসন, দই, জোয়ান, নুন, আখের গুড়, রসুন, কাঁচা লঙ্কা, কিঞ্চিৎ আদা। ইউটিউবে অনেক ভিডিয়ো পেয়ে যাবেন। তাই আর পুরো পদ্ধতি লিখলাম না। অনেকে সাদা তিলও ব্যবহার করেন। তবে অবশ্যই কতগুলো বিষয় মাথায় রাখতে হবে। আটার তুলনায় বেসনের পরিমাণ হবে খুব সামান্য। দই দিয়ে যখন মাখবেন অবশ্যই তা যেন সাধারণ তাপমাত্রায় থাকে। কোনও গরম জল ব্যবহার করবেন না। তাহলে বেসন শক্ত হয়ে যাবে। আর গুড় এবং রসুনটা পুরো মিহি করে দেবেন না। ওই যে গরম ঘিয়ে ভাজা মেথি থেপলার মধ্যে এক টুকরো ছোট রসুন বা গুড় যখন মুখে পড়বে তখন মনে হবে ‘হ্যাঁ স্বর্গ যদি কোথাও থেকে থাকে, তাহলে তা এই থেপলা চাখা জিভেই’। মেথি থেপলা টক দই (আমি একটু চিনি মিশিয়ে নিই) দিয়ে খেতে পারেন। একটা অনুরোধ, এমন কোনও উচ্চকিত তরকারি দিয়ে খাবেন না যা এই স্বর্গীয় খাবারের স্বাদটাই নষ্ট করে দেয়।
এ তো গেল গুজরাতি খাবারের গল্প। এবার আসি রাজস্থানের একটি জনপ্রিয় খাবারে। গাট্টে কা সবজি। গাট্টে আসলে বেসন দিয়ে তৈরি হয়। প্রথমবার দেখে আমি ভেবেছিলাম সসেজের তরকারি। সসেজ ছোট ছোট টুকরো করে কেটে দিলে যেমন দেখতে লাগে গাট্টে ঠিক তেমনই দেখতে। কিন্তু এ তো বেসনের সসেজ! রাজস্থানের রুক্ষ শুষ্ক প্রান্তরে টাটকা সতেজ সবজি পাওয়া বেশ দুষ্কর। সবজি রাখলেও শুকিয়ে যায় দ্রুত। তাই রাজস্থানি খাবারে বেসন, ঘিয়ের আধিক্য চোখে পড়ার মতো। গাট্টে কা সবজি’র প্রধান উপকরণ বেসন, টক দই, জোয়ান। এখানে বেসনটা দই, জোয়ান, নুন, অল্প তেল, হলুদ দিয়ে মাখতে হয়। জল ছাড়া মাখতে হবে। মরু প্রান্তরের সবজি রান্নার প্রধান শর্তই হল জল যত কম ব্যবহার করা যায় ততই ভাল। বেসন আটার মতো করে মেখে কিছুক্ষণ রেখে দিয়ে সরু সরু ল্যাংচার আকৃতি বানাতে হয়। এরপর সেগুলো গরম জলে ফুটিয়ে ছোট টুকরোয় কাটতে হয়। বাকি তরকারিটা অবশ্যই ঘিয়ে বানাবেন। তবেই কিন্তু মরু প্রদেশের স্বাদ আসবে।
সারা শীতকালে যখন দুনিয়া কপি এবং মুলোময় হয়ে ওঠে, তখন অবশ্যই এই পদগুলি রাঁধতে পারেন।
প্রচ্ছদের ছবি— মেথি থেপলা। আকার যথাযথ। সঙ্গে উপাচার, দই।
ছবি— লেখক
(সমাপ্ত)