অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

কংসাবতীর স্নেহের গোলাপ গ্রামে

দীপক দাস

এই যে আমাদের ‘মঙ্গলে ঊষা বুধে পা’ দশা, এটা হল কী করে? বাকি সদস্যদের কথা বলতে পারি না। নিজের দশা-সই হওয়ার কথা ভেবেছি। ভাবতে ভাবতে মনে হয়েছে, এ অনেক দিনের মনোগত অভ্যাসের ফল। নানা অনুপ্রেরণার ফসল। প্রথম অনুপ্রেরণা, স্কুল জীবনে। আমাদের ক্রীড়া শিক্ষক সুনীল চক্রবর্তী। যাঁকে আমরা খেলার স্যার বলি। সময় সুযোগ পেলেই তিনি আমাদের সঙ্গে গল্প জুড়তেন। আর তাঁর মোপেডে চড়ে বিভিন্ন সফরের গল্প বলতেন।

উচ্চ মাধ্যমিকের ইংরেজি বইয়ে আমাদের একটা পাঠ্য ছিল। ‘এ ডে আউটিং’। একদিনের ঘোরাফেরার বর্ণনা। আরেকটু বড় হতে একটা পত্রিকা হাতে এল, ‘রঙ্গব্যঙ্গ রসিকেষু’। পত্রিকায় একটা ধারাবাহিক বেরোত, ‘ডজন দরে শস্তা’। লেখক বোধহয় গিলব্রেথ। তাঁদের পরিবারের কাহিনি। পরিবারটি সপ্তাহান্তের ছুটিতে বেরিয়ে পড়তেন। নানা ঘটনার সম্মুখীন হতেন। আর পড়া ছিল বিভিন্ন লেখকের ইংল্যান্ডের কান্ট্রি সাইড সফরের কথা।

মরসুম নয়। তা-ও সৌন্দর্য ত্যাগ করে যায়নি জমিগুলোকে।

এসবই মিলেমিশে অবচেতনকে দশাগ্রস্ত করতে শুরু করেছিল। তার পর এক সময়ে সপ্তাহান্তে ছুটির সুযোগ এল। তার আগে সপ্তাহের প্রত্যেকদিনই ছুটি থাকত। একদিন ছুটি পেতেই অবচেতনের ইচ্ছেটা হুপ করে লাফিয়ে সামনে চলে এল। আমরা দল বেঁধে বেরতে শুরু করলাম।

সপ্তাহান্তিক সফরের রেওয়াজ অবশ্য প্রায় উঠে যাওয়ার দশা এখন। একে তো করোনার কাঁটা। তার উপরে সঙ্গীসাথীরা বড় হয়েছে। তাদের জগৎ বেড়েছে। সপ্তাহের শেষে সফরের থেকে তারা বিশ্রাম নেওয়া বেশি পছন্দ করে। সফর তো প্রায় বন্ধ। তার উপরে মঙ্গলবারের আড্ডাটাও থমকে গিয়েছে। সময় নেই।

দেবুর সঙ্গে কাঁসাই পাড়ে।

কিন্তু এভাবে তো চলতে পারে না। অবচেতন সাংঘাতিক জিনিস। সে প্রায় ‘কেমিক্যাল লোচা’ কেস। তাড়িয়ে ফেরে। তাই এক মঙ্গলবার বেরিয়ে পড়া গেল। একাই চলে গেলাম পাঁশকুড়ার দিকে। কয়েকটি বিষয়ে খবর পেয়েছিলাম। সেগুলো সরেজমিন দেখতে। সফরটা অন্যরকম হয়ে গেল দিগন্তের জন্য। আমার সহকর্মী। ওর পাঁশকুড়ায় বাড়ি। গাড়ি নিয়ে হাজির। সঙ্গে ওর ছেলে। মিষ্টি দেবব্রত। কিছুক্ষণের মধ্যে দেবব্রত দেবু হয়ে গেল। ও একটা বই লিখেছে। একটা সত্যি কথা স্বীকার করে নিই। ঘুরতে গিয়ে পরিচিতদের সঙ্গে যোগাযোগ করি না আমরা। তাতে ঘোরাঘুরির সময় কম পড়ে যায়। ফলে বেশ কিছু জায়গায় ঘুরে চলে আসার পরে সেখানকার পরিচিতদের খবর দিয়েছি। তাতে রাগারাগি, গোসা হয়েছে বটে, নিয়ম ভঙ্গ করিনি আমরা।

কিন্তু এবারের সফরটায় দিগন্তের সাহায্যের দরকার ছিল। এমনই অজানা কিছু বিষয় খোঁজার ছিল। সেই জায়গাগুলো স্থানীয় লোকজন ছাড়া বলতে পারবে না। তাই দিগন্তের হাতে ধরা পড়ে গেলাম। অবশ্য তাতে ক্ষতি কিছু হয়নি। গাড়িতে উঠতেই ও বলেছিল, ‘‘চলুন দাদা, আপনাকে গোলাপ গ্রাম দেখিয়ে নিয়ে যাই।’’ চাকরির সূত্রেই জানি, পাঁশকুড়া, কোলাঘাট ব্লক ফুল চাষে বিখ্যাত। গত কয়েক বছরে সোশ্যাল মিডিয়া সেনসেশন হওয়া ক্ষীরাই এই এলাকাতেই পড়ে। ক্ষীরাই দেখা হয়ে গিয়েছে। এবার গোলাপ গ্রামটা দেখা যেতে পারে।

সেই শিবমন্দির।

পাঁশকুড়া স্টেশন থেকে পাঁশকুড়া বাজার পর্যন্ত বর্ণনা দেওয়ার কিছু নেই। আর পাঁচটা বাংলার গ্রামের মতোই। প্রকৃতির রূপ বদলাতে শুরু করে জানাবাড় গ্রাম থেকে। নদী বাঁধ দিয়ে রাস্তা। পাকা সড়ক। সড়কের দু’পাশে অসংখ্যা গাছপালা। গ্রামের বসতগুলো দূরে দূরে। আর বাঁধের দু’পাশে চাষের জমি। জানাবাড়ে চন্দ্রমল্লিকার চাষ হয় খুব ভাল। জমির পর জমি মরসুমের সময়ে সাদা হয়ে থাকে। এখানকার চাষিরা চন্দ্রমল্লিকার জোগান আর বাজার দীর্ঘায়িত করার জন্য দারুণ একটা কৌশল নেন। জমির পাশে খুঁটি পুঁতে এলইডি বাল্ব জ্বেলে দেন। কুয়াশা মোড়া শীতের রাতে সে এক অপার্থিব সুন্দর দৃশ্য। না দেখলে তার বর্ণনা অসম্ভব। দিগন্ত এই রকম একটা অসাধারণ ছবি তুলেছিল। তা ছাপাও হয়েছিল খবরের কাগজে।

দূরে গোলাপ খেত।

চাষিরা কেন এরকম করেন? এগুলো আসলে চন্দ্রমল্লিকা গাছকে একধরনের প্রতারণা করা। বিদ্যুতের সাদা আলোয় রাতে দিনের মতো পরিবেশ তৈরি হয়। তাতে ফুল ফুটতে দেরি হয়। ফুলচাষিরা দীর্ঘদিন ধরে তা বিক্রি করতে পারেন। এখন মরসুম নয় চন্দ্রমল্লিকার। কিন্তু কিছু কিছু জমিতে এখনও সাদা সৌন্দর্যের রেশ বজায় রয়েছে। অন্য ফুলও রয়েছে।

চন্দ্রমল্লিকার জমি পার করে কিছুটা গিয়ে দিগন্ত রাস্তার বাঁ দিকে কাঁচা রাস্তায় গাড়ি ঢোকাল। একটা শিবমন্দির দেখতে পেলাম। মন্দিরের স্থাপত্য মোটা দাগের। বাংলার মন্দির স্থাপত্য অসাধারণ। এখনও বিভিন্ন গ্রামে প্রাচীন শিবমন্দিরগুলো অসাধারণ সব স্থাপত্যের নিদর্শন বয়ে চলেছে। মন্দিরগুলোর টেরাকোটার কাজও দেখার মতো হয়। দিগন্ত মন্দির পার করে আমাদের নিয়ে দাঁড় করাল একটা উঁচু পাড়ে। নীচ দিয়ে একটা জলধারা বয়ে চলেছে। দিগন্ত বলল, এটা কাঁসাই নদী। মানে কংসাবতী। কিন্তু একেবারেই করুণ দশা। ‘যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে…’ হয়ে গিয়েছে। একটা বিষয় ভাল লাগল। কাঁসাইয়ের বুকে কিছু পাখি দেখতে পেলাম। সরাল, ডাকপাখি। পাড়ের গাছপালা থেকেও কিছু পাখির ডাক ভেসে আসছে। খোঁজার চেষ্টা করছিলাম। হঠাৎই দেবু বলে উঠল, ‘‘ওটা কী পাখি? সাপের মতো গলা?’’ প্রথমে দেখতে পাইনি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে পাখিটা ভুস করে ভেসে উঠল। ও তো পানকৌড়ি। তবে গলাটা যেন চেনা পাখিগুলোর থেকে সামান্য বেশি লম্বা। সেই জন্যই দেবু সাপের মতো বলেছে।

প্রায় শুকনো কাঁসাই ধারা।

আবার গাড়ি চলতে শুরু করল। দিগন্ত পর পর গ্রামের নামগুলো বলছিল। নস্করদিঘি, বাজু, পঞ্চমদুর্গা, গোপীনাথপুর, মোহনপুর, রাজশহর, কৃষ্ণগঞ্জ। নামগুলো আমার মনে ছিল না। লেখার সময়ে আবার চেয়ে পাঠালাম। দিগন্ত জানাল, গোপীনাথপুর থেকে কৃষ্ণগঞ্জ পর্যন্ত নদীর চরের জমিতে গোলাপ চাষ হয়। এগুলো সবই গোলাপ গ্রাম। দেখছিলাম। এখন মরসুম নয়। তবে গোলাপ গাছ বেশ বড় হয়েছে। অল্পস্বল্প কুঁড়ি। কাঁসাইয়ের পাড়ে এক গোলাপ খেতে নামলাম আমরা তিনজনেই। দেবুর ইচ্ছা, একটা কুঁড়ি তুলে মায়ের জন্য নিয়ে যায়। বাপ-জেঠা মিলে প্রবল ভাবে বারণ করা হল।

স্টিয়ারিংওলা ইঞ্জিন ভ্যান। দূরে হাঁটছে বাপ-ছেলে।

গোলাপ খেত থেকে নেমে গেলাম কাঁসাইয়ের বুকে। একদম জল নেই নদীতে। শুকনো খটখটে। বালুরাশি নিয়ে মৃতপ্রায় নদী তার প্রবাহরেখা বরাবর বেঁচে আছে। অল্প অল্প জল আছে কোথাও কোথাও। অথচ এই নদীই এলাকার প্রাণপ্রবাহ। যখন প্রবল স্রোতা ছিল তখনও। এখনও। এই যে পরপর গ্রামগুলোয় গোলাপ চাষ হয়, চন্দ্রমল্লিকা ফোটে, সে কার জন্য? প্রতি বর্ষায় কংসাবতী তার অববাহিকায় প্রাণরস সঞ্চয় করে দেয়। ফিক্সড ডিপোজিটের মতো। তা দিয়েই সারা বছর সুন্দর হয়ে থাকে তার সন্তানেরা। কংসাবতীর জন্য এখানকার গ্রামের মানুষ অল্প পরিশ্রমে চাষআবাদ করতে পারে। ভাত-কাপড়ের অভাব হয় না খুব একটা। অন্য কাজও মেলে এখানে। নদী আছে মানে ইটভাটাও আছে। ইঞ্জিন ভ্যানগুলো ইট বইছে দেখলাম। এখানকার ভ্যানগুলো আবার স্টিয়ারিংওলা। মানে বেশ শক্তপোক্ত। এরকম ভ্যান দেখেছিলাম বহু বছর আগে ভালকি মাচানে। কিছুদিন আগে ব্যান্ডেল-কাটোয়া শাখায় সোমড়াবাজার দেখতে গিয়ে।

ছবির মতো ‘বাংলার মুখ’এর সাক্ষ্য দেওয়া গ্রামগুলোয় অল্পস্বল্প ক্ষত আছে। নদীর বুক থেকে যথেচ্ছ বালি তোলা হয়। আর বালির লাভ নিয়ে বাধে বিবাদ। আমরা সাধারণ মানুষ। সে সব উপেক্ষা করে প্রকৃতির কাছে নিজের সমর্পণ করতেই পারি। তা-ই করলাম। কংসাবতীর পাড় ধরে যতটা দেখতে পাওয়া যায় চোখে ভরে নিতে থাকলাম। চুলের কাঁটার মতো বাঁক নেওয়া নদী। অল্প ভূগোল পড়ার জ্ঞানে যে জায়গাটা দেখলে মনে হয়, একদিন নদী যদি বাঁক অস্বীকার করে সোজা ধেয়ে আসে। তাহলে একটা অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ তৈরি হবে। কাছের গ্রামগুলোর যে সর্বনাশ হবে, সে কথা মনে আসে না সৃষ্টির আনন্দে ভরা মনে।

নদী চলেছে বাঁকে বাঁকে।

গাড়ি চলল দিগন্তের বাড়ির দিকে। সেখানে অপেক্ষা করছে স্নেহময় এক পরিবার। ওর মা-বাবা, স্ত্রী আর আরেকটা পুচকু স্বস্তিকা। দেবুর দিদি। ও হ্যাঁ, বুনির কথাও বলতে হবে। দিগন্তর পোষ্য। দিগন্তরা নিরামিষ খায়। বুনি নাকি কুমড়ো আর দই খেতে ভালবাসে। সুন্দর কিছু মুহূর্ত জন্ম নিল বাড়িটায়।

তার পর ফেরার পালা। নতুন পথে ফিরলাম। সে পথের দু’পাশেও ফুলের জলসা। মনে মনে ভাবছিলাম, একবার দলবল নিয়ে আসতে হবে গোলাপ কলোনিতে ঘুরতে।

ছবি— লেখক ও দিগন্ত।

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *