তনয় শীল
পশ্চিমবঙ্গ সরকার আয়োজিত রাজ্যের বিভিন্ন হস্তশিল্প মেলার দৌলতে নতুনগ্রামের কাঠের পুতুল আজ সকলের কাছে সুপরিচিত। এই কাঠপুতুল তৈরির পটভূমি ও নেপথ্য জানতে চলুন আজ ঘুরিয়ে নিয়ে আসি সেই কাঠ পুতুলের আঁতুড়ঘর থেকে।
পূর্ব বর্ধমান জেলার অগ্রদ্বীপের একটি ছোট্টগ্রাম ‘নতুনগ্রাম’ বা ‘পুতুলগ্রাম’। হাওড়া-কাটোয়া বা শিয়ালদহ-কাটোয়া রুটে কাটোয়ার তিনটি স্টেশন আগে একটি ছোট স্টেশন অগ্রদ্বীপ। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ কালের আগে সমস্ত রকম সচেতনতা ও নিষেধাজ্ঞা মেনে গত ৭ ফেব্রুয়ারি, সকাল ৫টা ৩৮ মিনিটের হাওড়া-কাটোয়া লোকাল চেপে একাকী ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েছিলাম নতুনগ্রামের উদ্দেশ্যে।
সকাল ৯টা নাগাদ ট্রেন থামল অগ্রদ্বীপ স্টেশনে। টোটোয় চাপলাম নতুন গ্রামের উদ্দেশ্যে। টোটো ভাড়া ১০ টাকা জন প্রতি। টোটোয় যেতে যেতে দূর অবধি সবুজ মাঠ, ধানের ক্ষেত, ভুট্টার ক্ষেত, পুকুর, ঘন বাঁশঝাড়, গরুর গোয়াল, ধানের মড়াই, শাল ও লম্বু গাছের সারি দেখে চোখ জুড়িয়ে যাবে।
হাতে গোনা কয়েকটি ‘সূত্রধর’ এবং ‘ভাস্কর’ পরিবার নিয়ে এই নতুনগ্রামের প্রত্যেকেরই পেশা কাঠের পুতুল তৈরি। যাঁদের তৈরি কাঠের পেঁচা সারা দেশে অসামান্য খ্যাতি অর্জন করেছে। এক এক করে এবার প্রত্যেকটি বাড়ি ঘোরার পালা। দেখলাম বালক, বালিকা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ বৃদ্ধারা অসামান্য নিপুণতার সঙ্গে কাজ করে চলেছেন। কেউ বাটালি দিয়ে কাঠ কেটে পুতুলের অবয়ব তৈরি করছেন, কেউ রং করছেন। শাল, নিম, সোনাঝুড়ি, লম্বু, গামার গাছের কাঠ এঁরা ব্যবহার করেন।
এখানকার প্রধান আকর্ষণ কাঠের পেঁচা, যা এখানে লক্ষ্মীদেবীর প্রতীক মনে করা হয়। ছোট, বড়, মাঝারি বিভিন্ন মাপ এবং কাঠের গুণগত মানের উপর নির্ভর করে যার দাম। ২০ টাকা থেকে শুরু হয়ে ৮০০ টাকা এমনকি ৫০০০ টাকা পর্যন্ত হয়। পেঁচা দিয়ে তৈরি চাবির রিং, ফটোফ্রেম, ট্রে, টেবিল ল্যাম্প, ঘড়ি, টেবিলগুলিও অসামান্য দক্ষতার সাথে তৈরি হয়। ঘড়ি এবং টেবিল ল্যাম্পগুলির দাম ১০০০ টাকা থেকে শুরু। পেঁচা ছাড়াও কৃষ্ণ, রাধাকৃষ্ণ, রাজারানি, দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, গৌর-নিতাই ইত্যাদি পুতুলও আছে। এছাড়াও আছে ট্রে, কাঠের টুল ও ফোল্ডিং চেয়ার, পড়ার টেবিল, খাট (৩০০-৫৫০টাকা)। এখানে বেশ কিছু শিল্পী রাষ্ট্রপতি পুরস্কারও পেয়েছেন।
সহজ সরল, সাদাসিধে মানুষগুলোর আতিথেয়তায় সারাদিন কেটে গেল। ক্যামেরায় কিছু শিল্পকলার ছবি বন্দি করলাম। একটি মাঝারি মাপের নিরেট কাঠের পেঁচা (৪০০ টাকা), দু’টি ছোটো পেঁচা (২০ টাকা), ঘড়ি (১০০০ টাকা), দু’টি কাঠের টুল ও একটি ফোল্ডিং টেবিল (৩৫০ টাকা পিস) কিনলাম।
প্রত্যেক বছর স্থানীয় একটি মাঠে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে একটি বড় মেলা বসে। করোনার জন্য এ বছর মেলা হয়নি। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় মেলাও এবার সে অর্থে হয়নি। তাই এ বছর শিল্পীরা অনেকটা ক্ষতির মুখে। শিল্পী শ্রী জয়দেব ভাস্কর বললেন, ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলে (9153281453) পছ্ন্দ মতো সামগ্রী বানিয়ে দেবেন। হোম ডেলিভারিও করা হয়। শিল্পী সনৎ সূত্রধর তাঁর যোগাযোগ নম্বরটি (9734768352) সামাজিক মধ্যমে ছড়িয়ে দিতে বললেন পরিচিতি ও পুতুল বিক্রির আশায়। করোনা অতিমারি বড় ক্ষতি করেছে সকলেরই।
দুপুর আড়াইটে নাগাদ টোটোয় উঠলাম বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে। যে টোটোয় সকালে এসেছিলাম তাঁর ফোন নম্বর নিয়ে রেখেছিলাম, তাকেই ডেকে নিলাম। কারণ স্টেশন থেকে সহজে টোটো পাওয়া গেলেও নতুনগ্রাম থেকে স্টেশন যাওয়ার টোটো কম। স্টেশন পৌঁছে কাছে একটি ছোট হোটেলে মধ্যাহ্নভোজ সারলাম। বিকেল ৩:৪৪ মিনিটের ডাউন কাটোয়া-হাওড়া লোকালে চড়লাম বাড়ি ফেরার জন্য।
পল্লী প্রকৃতির অসামান্য ছোঁয়া, সহজ সরল পরিবারগুলোর আতিথেয়তা এবং অসাধারণ শিল্পকলার টানে আবার হয়তো একদিন চলে আসবো, কোনও এক ছুটির দিনে, কোনও একভোরের শীতল বাতাস মেখে।
ছবি— লেখক
(সমাপ্ত)