দীপক দাস

একটা দিঘি। একটা দরগা আর একটা বেদির মতো নির্মাণ। এই তিনটি চিহ্ন পাতিহাল গ্রামের অনেক অকথিত ইতিহাসের সাক্ষী। হয়তো জন্ম দিয়েছে কিংবদন্তীরও। যার জট থেকে প্রকৃত ইতিহাস খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তবে কাছাকাছি বিশ্বাসযোগ্য কারণের খোঁজ চলতেই পারে।
দিঘিটির নাম লস্কর দিঘি। পাতিহাল গ্রামে যতগুলো বড় জলাশয় আছে সেগুলোর নামে আরবি-ফারসি প্রভাব নেই। একমাত্র এই জলাশয়টি ফারসি ‘লস্কর’ শব্দে নামাঙ্কিত। অতি সুন্দর দিঘি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ। জলে পদ্ম ফোটে। শীতে পরিযায়ী পাখি আসে। অন্য জলজ পাখিরও আবাস। কিন্তু দিঘির নাম এমন কেন? এ বিষয়ে গ্রামের শিক্ষক বর্তমানে প্রয়াত রতনচন্দ্র বাগ একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি ‘পাঁতিহাল গ্রামের ইতিকথা’ শীর্ষক এক নিবন্ধে লিখেছেন, বর্গি হামলার সময়ে গ্রামে নবাব সেনার আগমন ঘটেছিল। বর্গিদের হামলা ঠেকাতে তারা গ্রামে ছাউনি ফেলেছিল। খাঁদারঘাট জাঙাল দিয়ে পাতিহালে ঢুকেছিল মুর্শিদাবাদের নবাব সেনা। ছাউনিটি ছিল একটি খালের পাশে। ছাউনির সেনাবাহিনীর জলের প্রয়োজন। তাই খোঁড়া হয়েছিল বিশাল দিঘিটি। পাড়-সহ যার আয়তন ছিল প্রায় ৩৫০ বিঘা। জলকর প্রায় ১৫০ বিঘা।

নবাবের সেনাকে লস্কর বলা হয়। লস্করেরা দিঘি খনন করেছিল বলেই নাম হয়, ‘লস্কর দিঘি’। একসময়ে দিঘির দক্ষিণ পাড়ে নবাবি আমলে তৈরি ঘাটের সোপান মিলেছিল। যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা।
এবার বেদির মতো নির্মাণের কথা। গুমোতলায় গুমোরাজের থান আর সুধাময় আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ের পাশেই রয়েছে বেদিটি। সাহাদের বাড়ির সামনে। একটি চাতালের উপরে চার ধাপে তৈরি বেদি। ধাপগুলো উপরের দিকে ক্রমশ ছোট হয়েছে। প্রাথমিক বিভাগে এই স্কুলেই পড়াশোনা আমার। তখন সাহাদের বাড়ির সামনে একটা কাঁঠাল গাছ ছিল। তার নীচেই ছিল বেদিটা। সাহাদের বাড়ির মেয়েরা বেদিতে দুপুরে ধূপ দিতে দেখেছি ওই বেদিতে। এখন আর কাঁঠাল গাছটা নেই। বেদির গায়ের রাস্তাটাও পাকা হয়েছে। হাল ফিরেছে বেদিরও। ছোটবেলায় দেখেছি, ভাঙা, ক্ষয়াটে ছিল সেটি। এখন নতুন করে বাঁধানো হয়েছে।

কীসের বেদি এটি? স্থানীয় লোকজনের দাবি, কোনও ইসলাম ধর্মাবলম্বীর সমাধি এটি। রতনবাবুর দাবি ছিল, নবাবের লস্করের সঙ্গে যোগ রয়েছে এই সমাধিস্থলের। তাঁর মতে, এটি পিরের দরগা। নবাব সেনার সঙ্গেই এসেছিলেন তিনি। সম্প্রতি একটি ভিন্নমতের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এক প্রবীণ গ্রামবাসী দাবি করেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশ সেনারা গুমোতলার কাছেই বাঘমুখো বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। এই বেদিটা তাদের পতাকা তোলার জায়গা। বাঘমুখো বাড়ির এক প্রবীণ সদস্যকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তাঁদের বাড়িতে ব্রিটিশ আগমনের ঘটনা। তিনি জানিয়েছেন, এমন কোনও কথা তাঁর বাপ-ঠাকুরদা তাঁকে কখনও বলেননি। এরকম ঘটনা ঘটে থাকলে নিশ্চয় সেটা আলোচনার বিষয় হত। তিনিও জানালেন, ওই বেদিটি একটি সমাধিস্থল। গুমোতলায় মুদিখানার দোকান দিলীপ পালের। তাঁর বাড়ি গুমোতলার পাশের পাড়াতেই। বছর সত্তরের দিলীপবাবুও জানালেন, তিনি কখনও তাঁদের গ্রামে ব্রিটিশ আগমনের কথা শোনেননি। আর তাঁর দোকানের সামনের বেদিটি একটি সমাধিস্থলই।

পাতিহালে ব্রিটিশ আগমনের দাবি খুব একটা জোরাল নয়। এর স্বপক্ষে তেমন কোনও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ নেই। মৌখিক বা পারিপার্শ্বিক, কোনও প্রমাণই মেলে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কেন ব্রিটিশরা পাতিহালে ঘাঁটি গাড়বে? এদিক দিয়ে কি কোনও ভাবে জাপানি আক্রমণের সম্ভাবনা ছিল? না বলেই মনে হয়। তাছাড়া ব্রিটিশ সেনা ঘাঁটি তৈরি করলে অন্য কোনও প্রমাণও মিলত। বিশেষ করে সেনা রোজ ইউনিয়ন জ্যাক তুলত, এমন দাবি যখন উঠছে। কিন্তু পাতিহালে ব্রিটিশ স্মারক কিছুই নেই। একমাত্র কোম্পানি ট্যাঙ্ক নামে একটি পুকুর ছাড়া। এটিও সম্ভবত, গ্রামবাসীদের পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে খোঁড়া হয়েছিল। বেশ গভীর পুকুর। যাতে সারা বছর জল থাকে তেমন গভীর করে খোঁড়া। জল শুকোয়নি কোনওদিন। গ্রামের ইতিহাস চর্চার সময়ে ক্ষীণ দাবি শুনতাম, এটা আসলে নীলকুঠির পুকুর। কিন্তু দাবির কোনও প্রমাণ নেই। কুঠির ধ্বংসাবশেষ নেই আশপাশে। এই পুকুরের জল একসময়ে খাওয়া হত, এমন দাবিই বরং জোরাল।

হাটতলায় আছে একটি দরগা। হাটের চালাটার ঠিক কাছেই। ঘোষেদের বাড়ির সামনে। দরগার নির্মাণের অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। মেরামতির অভাব। এটি এক পিরের দরগা। রতনচন্দ্র বাগ মহাশয় জানিয়েছিলেন, লস্কর দিঘি থেকে গুমোতলা, হাটতলা ছিল নবাব সেনার যাতায়াতের পথ। অর্থাৎ লস্করদের সঙ্গেই এই দুই নির্মাণের যোগ। রতনবাবুর অনুমান, হাটতলা ও গুমোতলার দুই নির্মাণই পিরের দরগা। হাটতলার নির্মাণ পিরের দরগা হতেও পারে। তিনি হয়তো নবাব লস্করের সঙ্গে এসেছিলেন। কিন্তু গুমোতলার বেদি নিয়ে একটু সংশয় প্রকাশ করা যায়। হাটতলার সমাধি ঘিরে পোক্ত নির্মাণ। চারটি মিনার ও গম্বুজওয়ালা ছিল এটি। কিন্তু গুমোতলার বেদি ঘিরে কোনও নির্মাণ কখনও গড়ে উঠেছিল, এমন কোনও চিহ্ন মেলেনি। একই সেনার সঙ্গে যুক্ত দুই পিরের সমাধিস্থল দু’রকম হতে পারে কি? মনে করা যেতে পারে, লস্করদের কেউ মারা গিয়েছিলেন। তাঁকে এখানে সমাধি দেওয়া হয়েছে।
হাটতলার দরগা সম্পর্কে অন্য দাবিও রয়েছে। হাটতলার একটি বিরাট অংশ ছিল পাতিহালের পড়শি গ্রাম বাঁকুলের বাসিন্দা কাজী পরিবারের সম্পত্তি। এই পরিবারের এক সদস্য কোনও এক সময়ে দরবেশ হয়ে সংসার ত্যাগ করেছিলেন। পরে আবার তিনি গ্রামে ফেরেন। তাঁর মৃত্যুর পরে হাটতলায় তাঁকে সমাধি দেওয়া হয়। গড়ে ওঠে দরগা। পরে হাটতলার ওই অংশ পাতিহালের সাহাদের সম্পত্তি হয়। বাঁকুলের কাজী পরিবার বা সাহা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একসময় যোগাযোগ করেছিলাম। কিন্তু তাঁরা দরগা সম্পর্কে কিছুই জানাতে পারেননি। এখন দরগাটি ক্ষয়িষ্ণু।

তিনটি ঐতিহাসিক চিহ্নের প্রকৃত ইতিহাস আজ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। গ্রামে ইসলাম ধর্মাবলম্বী না থাকলেও চিহ্নগুলো বহু বছর ধরে রয়ে গিয়েছে। কারণ এগুলো বরাবরই মিলন ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। গুমোতলার সমাধিস্থলে ধূপ দেওয়ার উল্লেখ আগেই করেছি। হাটতলায় পিরের এই দরগাতেও সকল ধর্মাবলম্বীর যাতায়াত। কারও পোষ্য গরুর বাচ্চা হলে প্রথম দুধ দরগায় দেওয়ার রীতি। আমিও ছোটবেলায় দিয়ে এসেছি। এই সমস্ত ইতিহাস, আচার থেকে বোঝা যায়, পাতিহাল গ্রামটি এক মহামিলনের ক্ষেত্র। এই গ্রামেই রয়েছে বদর পিরের থান। কোনও এক সুদূর অতীতে বাণিজ্য করতে আসা মাঝি মাল্লারা এখানে বদর পিরকে স্থাপন করেছিলেন। যেখানে পিরের গান করে যান মাজুর চক্রবর্তীরা। রক্ষণাবেক্ষণ করেন গ্রামবাসীরা।
পাতিহাল মানব ইতিহাসের গর্বের ক্ষেত্র।
ছবি— লেখক, দীপশেখর দাস
(সমাপ্ত)