দীপক দাস
ঠান্ডা হাওয়ার গতিটা ধীরে ধীরে বাড়ছিল। আকাশে কালো মেঘ জমাট বেঁধেছে আগেই। একসময়ে ঠান্ডা হাওয়া ঝড়ের আকার নিল। আর তার পরেই ‘ঝম্পি ঘন গর জন্তি সন্ততি/ভুবন ভরি বরিখন্তিয়া’। জয়পুরের জঙ্গলে ওয়াচ টাওয়ারের খোলা ছাদে সেই ঝড়ের সন্ধে আমাদের চিরস্মরণীয়। ‘ভরা বাদর’এর বৈষ্ণব পদ ব্যবহার করলাম বটে। কিন্তু ওই ঝড়-বৃষ্টি ছিল মে মাসের।
এ বছর আষাঢ় মাসের প্রথম দিন থেকেই ঝেঁপে বৃষ্টি। এখনও আবহাওয়া ভিজে ভিজে। এদিকে ঘুরতে যাওয়া বন্ধ। করোনা অতিমারিতে বন্দি সময়ে স্মৃতিচারণের পথ নেওয়া উচিত বলে মনে হল। সুখস্মৃতি সবসময় শরীর-মন তাজা রাখে। দলের ছেলেরাও তা-ই বলল। হয়ে যাক ঘুরতে গিয়ে বৃষ্টির আনন্দে ফিরে যাওয়া।
ফিরতে গিয়ে অনেকটাই পিছনে চলে যেতে হল। ২০১৪ সালের অক্টোবর মাস। একেবারে দুর্গাপুজোর দিন। সপ্তমী হবে বোধহয়। শুশুনিয়া পাহাড়ে ঘুরতে গিয়েছি আমরা। ইন্দ্র, ইন্দ্র এক ভাই, বাবলা, আমি আর আমার মেজো ভাই। তখন ইন্দ্র অনিয়ন্ত্রিত। ঘুরতে গেলে এসি ঘর চাই। ট্রেনে-পথচলতি ঠেলায় যা চোখে পড়বে চাখার জন্য বায়না করা চাই। আর যেখানে যেখানে বিপদের সম্ভাবনা সেখানে নিশ্চিত ভাবেই ‘ও কিছু হবে না’ বলা চাই। সেবার আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম শুশুনিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের গেস্ট হাউসে। অক্টোবর মাস হলেও বেজায় গরম। তার উপর রাত থাকতে উঠে ট্রেন ধরা। এত দূর আসা। মাঝে ছাতনায় নামা। তার পর বিকেলে পাহাড়ে চড়া। ক্লান্ত ছিলাম সকলে। তবে রাতে ঘুম হয়েছিল তোফা। কারণ রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। পাহাড়, জঙ্গলের জায়গায় সেই বৃষ্টিতে শীতল হয়েছিল ধরিত্রী।
কিন্তু আমরা কেউ বৃষ্টি বুঝতে পারিনি। এত ক্লান্ত ছিলাম। ইন্দ্র আর ওর ভাইয়ের তো বোঝার কথাই নয়। ওরা এসি ঘরই নিয়েছিল। পরদিন সকালটা হয়ে উঠেছিল দারুণ। দাঁত মাজতে মাজতে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম। বৃষ্টি ভেজা পিচের রাস্তা, জল পেয়ে চকচক করা গাছপালা, নতুন একটা দিনের আলো পেয়ে পাখিদের বেজায় কলরবে প্রকৃতি তখন মোহময়ী। আর পরিবেশ ঠান্ডা।
স্মৃতিচারণায় ইন্দ্র আমাকে মাস দুয়েক আগে টেনে আনল। ওই বছরেই। ১৫ অগস্টে বিষ্ণুপুর ভ্রমণে বেরিয়েছিলাম। সেটা পুরোপুরি আমাদের দলের সফর ছিল না। কিছুটা পারিবারিক ছিল। মানে কোর গ্রুপের সদস্য দীপু, আমি, ইন্দ্র, আমার মেজোভাই ছিলাম। ছিল ইন্দ্রর ভাইঝি মিমি আর বোন নারায়ণী, দীপুর বোন নন্দিতা, আমার বন্ধু মিন্টু। আর ছিল আমাদের সার্বজনীন দিদি, জয়ন্তীদি। লালদিঘি পার করে একটা ওয়াচ টাওয়ারে উঠব বলে গিয়েছিলাম। ওই পার্কে ঢুকেছি। সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি নেমেছে। একটা অফিস ঘর মতো কিছু ছিল। বন্ধ ছিল সেটা। খোলা বারান্দায় কোনও মতে আশ্রয় নিয়েছি। বৃষ্টি থামতে উঠেছিলাম ওয়াচ টাওয়ারে।
‘পাখির চোখে’ বলে একটা কথা এখন বেশ পরিচিত। ঠিক এই কথাটি পরিচিত নয়। ইংরেজি বুলি গর্বিত যুগে এমন কথা জনপ্রিয় হতে পারে না। কথাটা আসলে ‘বার্ডস আই ভিউ’এর বঙ্গীয়করণ। ড্রোনে ক্যামেরা লাগিয়ে ছবি তোলার রমরমায় কথাটা খুব চলে। আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন কথাটার তেমন চল হয়নি। কিন্তু আমরা বিষ্ণুপুর দেখেছিলাম পাখির চোখে। বিশাল একটা সবুজ চত্বর। বৃষ্টি ভেজা শ্যামলিমা। সেই চত্বর গিয়ে শেষ হয়েছে লালদিঘির গায়ে। সেই লালবাঈয়ের সর্বনাশ হওয়া লালদিঘি। দিঘির উপরে ভিজে বাতাসের একটা বাষ্পের মতো আস্তারণ। লালবাঈয়ের কাহিনির মতোই। ইতিহাস আর কিংবদন্তীর কুয়াশায় ঢাকা এক নর্তকীর জীবন। ওয়াচ টাওয়ারের নীচেও জঙ্গল। তবে তা বাড়ন্ত। হয়তো কোনও বনসৃজন প্রকল্পে তৈরি করা। ছোট গাছের জঙ্গলের ভিতরে একটা নালা। বৃষ্টির জলে ঘোলা। জঙ্গল আরও ঘন হলে, আর ছবিটা আরও উঁচু থেকে তুলতে পারলে সেটাকে আমাজন জঙ্গলে এঁকেবেঁকে চলা নদী বলে মনে হত।
বাঁকুড়ার জয়পুরের জঙ্গলে গিয়েছিলাম মে মাসে। পয়লা মে। আমাদের ওয়েবসাইট উদ্বোধনে। প্রায় পুরো টিম। শহর শাখা থেকে (এই শাখা এখন প্রায় আন্ডারগ্রাউন্ডে। সময়ের দাবিতেই) শুভ (কচি), জুয়েল আর অরিজিৎ। গ্রাম থেকে ইন্দ্র, দীপু আর আমি। ছোটা ডন বাবলা আর আরেক শুভ মানে সৌগত যেতে পারেনি। সেদিন প্রবল গরম ছিল। পুড়ে যাচ্ছিল পৃথিবী। এদিকে আমরা পরিকল্পনা করে এসেছি রাত কাটাব জঙ্গলের ওয়াচ টাওয়ারে। কিন্তু যাঁর কাছে চাবি থাকে তিনি বিয়েবাড়ি পালিয়েছেন। বিকেলে পাওয়ার সম্ভাবনা। সাময়িক ভাবে একটা ঘর নিয়েছিলাম রাস্তার পাশের অতিথিশালায়। সন্ধের আগে আগে ওয়াচ টাওয়ার আমাদের দখলে এল। ঘরে ঢোকার পরেই টাওয়ার একেবারে টঙের গোল চত্বরে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হল ঝড়-বৃষ্টি। দুদ্দাড় করে নেমে এলাম আমরা। বাজও পড়ছিল সেদিন। একেবারেই ‘কুলিশ শত শত পাত মোদিত’ করেই। মাসটা শুধু ভাদ্র নয়। বাকি সব লক্ষণ বিদ্যাপতির মাথুর পর্যায়ের বিখ্যাত পদের সঙ্গে মেলে। সেদিন মনে হয়েছিল, এমন ঘোর রবে বজ্রপাতের মধ্যে যে ‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর’ উচ্চারণ করতে পারে তার প্রেম কতটা গভীর! কিংবা প্রেম কতটা বাস্তব বিরোধী। না হলে দেবদাসের ভূমিকায় শাহরুখ স্বরযন্ত্র কাঁপিয়ে বলতে পারেন, ‘বাবুজি নে কহা গাঁও ছোড় দো’ ইত্যাদি। অমন বজ্রপাতে আমি তো কেঁপে কেঁপে উঠছিলাম। জঙ্গলে একটা টঙে চড়ে বসে আছি। বিদ্যুৎ চলে গিয়েছে। হঠাৎ হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে ঘর ভরে যাচ্ছে। বেঁচে ফিরব তো বাড়ি!
ঝড় থামতে প্রকৃতির অন্য রূপ দেখেছিলাম। টাওয়ারের কাছে প্রচুর আমগাছ ছিল। ঝড়ে পড়ে গিয়েছে প্রচুর আম। রাস্তার ধারের সেই অতিথিশালায় খেতে যাওয়ার সময়ে আমাদের আম কুড়নোর সে কী ধুম। পরদিন সকালে বৃষ্টি ধোয়া এক অনন্য প্রকৃতি দেখেছিলাম। ওয়াচ টাওয়ার থেকে ক্যানাল পাড় পর্যন্ত ভিজে মোরাম মাটির গন্ধ নিয়ে হাঁটার অন্য অনুভূতি। সদ্য বসন্ত পার করা শাল জঙ্গলের পাতা যেন স্নার সেরে আঙিনায় পা রাখা কোনও নববধূ। মোরামের লাল রাস্তা তার শাড়ির পাড়? আমাদের আনন্দ দিয়েছিল, ভেজা মাটিতে হরিণের টাটকা পায়ের দাগ। রাত ভর হরিণগুলো রাস্তার ধারে ছিল বলে টহল দেওয়া পুলিশকর্মীরা জানিয়েছিলেন। আমরা দেখা পায়নি। কিন্তু ক্যানাল পাড়ে প্রকৃতির মাঝে সুন্দরের প্রবল অনুভূতি আমাদের অদেখা হরিণের জন্য খেদ ভুলিয়ে দিয়েছিল। প্রচুর পাখি ডাকছিল ক্যানাল পারের জঙ্গলে।
জয়পুর থেকে গিয়েছিলাম বাসুদেবপুর রেঞ্জে। জঙ্গল, পরিত্যক্ত রানওয়ে বা চাতাল (শম্ভু আর তিন বন্দিনী প্রেমিকার গল্প), সেখানকার ক্যানাল পারে শুধু স্নিগ্ধতা। সিক্ত, পেলব অনুভূতি।
ঘাটশিলা ভ্রমণের প্রায় পুরোটাই বৃষ্টি আমাদের তাড়িয়ে ফিরেছিল। বুরুডি ড্যামে যাওয়ার পথে বৃষ্টি। ধারাগিরিতে (ধারাগিরির ধারাপাত) যাওয়ার ও আসার সময়ে অটোয় তো ভিজতে ভিজতেই গেলাম। জঙ্গল ঘেরা পাহাড়ি পথের অসাধারণ সৌন্দর্যও দেখেছিলাম। মুশকিল হল, ধারাগিরির আগে কাঁচা রাস্তায়। অটোর চাকা পিছলে পিছলে যাচ্ছিল। সব অসুবিধা দূর হয়ে গেল প্রান্তরে পা দিতে। ধারাগিরির জলপ্রপাতে পৌঁছনোর আগে যে মাঠটা পেরোতে হয়। অসাধারণ সৌন্দর্য।
ঘাটশিলা থেকে অনেকেই রঙ্কিনীদেবীর মন্দির দেখতে যান। ইউরেনিয়াম খনির যাদুগোড়া পার করে। কিন্তু এর মাঝে সিদ্ধেশ্বর পাহাড় বাদ দেন অনেকেই। তার একটা কারণও আছে। ওই পাহাড়ের মাথায় একটা শিবমন্দির রয়েছে। কোনও একটা সময়ে বিরাট মেলাও বসে। লোকাল গাইড গাড়ির চালকেরা পাহাড়ের মহিমা সে ভাবেই প্রচার করেন। ফলে অনেকে তেমন আগ্রহ দেখান না। পাহাড় ভেঙে নতুন গজিয়ে ওঠা শিবমন্দির দেখতে কে যায়? এই সিদ্ধান্তেই তাঁরা অসাধারণ সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত হন। যেমন হয়েছিল আমাদের ইন্দ্রবাবু। উনি যুক্তিবাদী। তাই মন্দিরে আগ্রহ দেখাননি। আমাদের অটোচালক ও লোকাল গাইড বাপিদাও সেরকম বুঝিয়েছিল।
পাহাড়ে চড়তে কিন্তু বেশ কষ্ট। উঠতে উঠতে আমার শিব্রাম চকরবরতীর কথা মনে হচ্ছিল। উনি বলতেন, উঠে কী হবে? সেই তো নেমে আসতে হবে! গুরুবাক্য অমান্য করেই আমি উঠেছিলাম। বাবলা, শুভ মানে সৌগত আর দীপুও উঠেছিল। তরুণ ওরা। তড়বড় করে উঠছিল আর ‘বুড়োটা বুড়োটা’ বলে আমাকে মাঝে মাঝে ভেঙাচ্ছিল। পাহাড়ের চূড়োয় চড়ে সব কষ্ট লাঘব। আহা কী দৃশ্য! বর্ণনা করা সাধ্যে কুলোবে না যে (সিদ্ধেশ্বর পাহাড় থেকে ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই)। সেদিন, আগের দিন, মাঝে মাঝেই বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টি ভেজা পাহাড়, সবুজ গাছপালায় ঘেরা উপত্যকা, তার মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলা সুবর্ণরেখা নদী মন ভরিয়ে দিচ্ছিল। পাহাড় থেকে যেদিকেই তাকাও, ওয়াও বলে আওয়াজ মুখ থেকে বেরোবেই। ‘ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়া’য় এই পাহাড় চুড়ো থেকে তোলা ছবি প্রচার করা উচিত। ভেবে দেখা দরকার ঝাড়খণ্ড পর্যটন দফতরেরও।
গালুডি ড্যামের উপরে দাঁড়িয়ে আমরা বৃষ্টিতে ঝুপ্পুস গিয়েছিলাম। তার আগে থেকেই মেঘ জমছিল। ড্যামের জলের উপরে মেঘ অসাধারণ দৃশ্য তৈরি করছিল। কিন্তু কিছু বোঝার আগে নেমেছিল বৃষ্টি। তার পর দূরের পাহাড়ে যে চিত্রকল্প তৈরি হল তার বর্ণনা দিতে আমার কম্পিউটারের কী প্যাড অপারগ। সবুজ ভেজা পাহাড়, তার চুড়োয় আটকে থাকা ধোঁয়ার মতো মেঘ চোখে দেখতে হয়। কথা বলতে নেই (গালুডির পাকোচ মাছ আর বুরুডির আমড়ার চাটনি)।
ঘাটশিলা ভ্রমণও ১৫ অগস্টে ছিল। ভাঙা বর্ষার রেশে ভেজা আমাদের। ভেজা প্রকৃতি দর্শনও।
কভারের ছবি- গালুডি ড্যাম থেকে তোলা পাহাড়।
ছবি— কচি, শুভ, দীপু, ইন্দ্র
(সমাপ্ত)