দুলালচন্দ্র দাস
সকাল ৬:৩০ গাড়ি ছাড়ল আমাদের। ২৪-৩-২০১৫। আমরা বলতে আমার গ্রামের ভবদেব ঘোষাল, তাঁর স্ত্রী পলি এবং ওঁদের একমাত্র পুত্র অয়ন। আর ভবদেবের মেজ বৌদি ও এক প্রতিবেশিনী। গন্তব্যস্থল হালিশহরে আসাম বঙ্গীয় সারস্বত মঠ। ভবদেব ও পলি এই আশ্রমের দীক্ষিত। বর্ষশেষে আশ্রমে এঁদের কিছু করণীয় থাকে। যেমন কিছু বাৎসরিক প্রণামী জমা দেওয়া, আশ্রম প্রকাশিত ‘আর্য দর্পণ’ পত্রিকার গ্রাহক নবীকরণ ইত্যাদি। ওঁদের উৎসাহে আমরা ক’জন সঙ্গী হয়েছি মাত্র।
গাঁয়ের সীমানা ছাড়িয়ে হাওড়া-আমতা রোড ধরে চলেছি হাওড়া শহরের দিকে। উদ্দেশ্য সলপ থেকে বাঁদিকে দক্ষিণেশ্বরগামী রাস্তা ধরে এগিয়ে চলা। ফাল্গুন শেষ হয়েছে। চৈত্রের বোধহয় আজ ৯ কী ১০। ঋতু হিসেবে মাঝ বসন্ত। নাকি শেষ বসন্ত। কখন যে সে আসে আর কখন যে তার নীরব প্রস্থান ঘটে প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চ থেকে আমাদের এদিকটায় তা ঠাহর করাই মুশকিল। ফাল্গুনের শুরুতে পথের ধারে ঝোপে ঝাড়ে পোড়ো জমিতে অনাদরে অবহেলায় অজস্র ভাটফুল যখন আলো ছড়ায়, মনে হয় সে যেন এল ওই। কদাচিৎ ফোটা আম বউলের গন্ধ, কী বাতাবি লেবু ফুলের সুবাস যখন আনমনা করে দেয় আমাদের, ভাবি সে কি এল!
আমাদের এদিকটায় পলাশ নেই। শিমূল ছিল। এখন তো তা-ও চোখে পড়ে না। প্রশস্ত পথের বিভাজিকার মাঝে মাঝে শীর্ণকায় করবী শাখায়, খর্বকায় গুলমোহরের ডালে দেখছি রঙের বাহার। যেন বলতে চাইছে, আমি তো এসেছিলেম, তোমরা স্বাগত জানাতেই ভুলে গেলে। তাই চলেই যাচ্ছি। মনে মনে বলি – না বন্ধু না। অভিমান করো না। আসলে তোমাদের নন্দন কাননে তো পরিবর্তন আসে না। কিন্তু আমাদের পৃথিবীর এ অংশটায় বদল এসেছে বড় দ্রুত। নিজের ছোটবেলার পরিচিত দৃশ্যপট কখন যে হারিয়ে গেছে নীরবে। আজ পরিণত বয়সে সে সব কথা স্মরণ করে অব্যক্ত বেদনায় ভরে যায় বুক। নির্বিচার আগ্রাসনে গাছপালা হারিয়ে গিয়েছে। গড়ে উঠেছে কংক্রিটের আবাসন। তবু তার মাঝে কোথাও রক্তকরবীর দল, কোথাও বাগান বিলাসের সমারোহ, কোথাও রক্ত কাঞ্চন তোমায় স্বাগত জানাতে তৈরি। তাদের তুমি তোমার রঙে রাঙিয়ে দিয়ে যাও।
আম্রকুঞ্জ বকুলবীথি হারিয়ে গিয়েছে। শিমূল-পলাশও নেই। তবু তুমি এসো। তুমি এসো এই মর্ত্যের ধূলিতলে যেখানে হয়তো কোনও কবি বিনিদ্র রজনীতে অপেক্ষায় রয়েছে তোমার আসার পথ চেয়ে। আজকের এই মলয় সমীরণ আর আনন্দানুভুতির কিছুমাত্র ভাগও যদি শতবর্ষ পরে তার কোন অদেখা প্রিয়ার কাছে পৌঁছে দিতে পারে তবে সেই হবে তার পরম প্রাপ্তি।
ফিরে আসি পথের কথায়। বিগত বিশ বাইশ বছরে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়েছে। নির্মিত হয়েছে বহু উড়াল সেতু। যার ফলে যানজট কমেছে। গ্রাম থেকে রওনা হয়ে মাত্র এক ঘণ্টায় দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কাছে পৌঁছে গিয়েছে আমাদের গাড়ি। এ যাত্রায় ফেরার সময় মন্দির দর্শন হবে। আমরা এগিয়ে চলি বিটি রোড দিয়ে ব্যারাকপুরের দিকে। ব্যস্ত স্টেশন এলাকা ছাড়িয়ে গাড়ি ক্রমশ এগিয়ে চলে হালিশহরের দিকে। প্রশস্ত রাস্তার দু’দিকে গড়ে উঠেছে বসতি। এক জায়গায় একটি বিশাল জুটমিল দেখেছি। তবে আজ সেখানে কাজ চলে নাকি বন্ধ আছে অনুমান করতে পারিনি। প্রাচীন অট্টালিকার মতো সদৃশ একটি নির্মাণ নজরে এল। চলমান যান থেকে জায়গাটার নাম উদ্ধার করা সম্ভব হল না। আর যা কিছু ঘরবসতি বা ছোটখাট কলকারখানা সেগুলি খুব প্রাচীন মনে হচ্ছে না। তাই স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে এ সব জায়গা কেমন ছিল কোনরকম অনুমান করা দুঃসাধ্য।
দক্ষিণেশ্বর থেকে আরও প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে অবশেষে পৌঁছনো গেল হালিশহর পুরসভা এলাকায়। রাস্তার বাঁদিকে গঙ্গার প্রশস্ত প্রবাহ। রামপ্রসাদের ঘাট ও শ্মশানভূমি অতিক্রম করে একসময় পৌঁছে যাই আসাম বঙ্গীয় সারস্বত মঠের বিস্তৃত প্রাঙ্গণে। নিগমানন্দ সরস্বতী প্রতিষ্ঠিত শাখা আশ্রম। সারা ভারতেই ছড়িয়ে আছে এর শাখাপ্রশাখা। মানব সেবায় নিয়োজিত সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীদের পরিচালিত সংগঠন। গঙ্গার দিকে মন্দিরে নিগমানন্দের মর্মর মূর্তি। মূর্তি নিয়ে প্রকোষ্ঠ মধ্যে নিগমানন্দ সমাহিত। আশ্রমের দীক্ষাভবনের পাশে একটি অতি প্রাচীন বেলগাছ। তার তলে নিগমেশ্বর শিব মন্দির। সাদা লিং মূর্তি। প্রাঙ্গণে একটি স্বর্ণচাঁপা ফুলের গাছ। গোড়াটি পরিপাটি করে বাঁধানো। কাছে প্রশস্ত সোপান শ্রেণি গঙ্গাধারা পর্যন্ত নেমে গিয়েছে। ঘাটের একপাশে গঙ্গা মন্দিরে গঙ্গা মায়ের প্রসন্ন মূর্তি।
পলি মুড়ি, শশা আরও বিবিধ মুখরোচক এনেছিল। তা দিয়ে জলযোগের পর সাধক রামপ্রসাদ সেন প্রতিষ্ঠিত কালীমন্দির ও সাধনস্থল পঞ্চবটী দর্শনে রওনা হয়েছি সকলে। ইতিমধ্যেই সূর্যদেব যথেষ্ট প্রখর মূর্তি ধারণ করেছেন। সকলে এগিয়ে চলি মন্দির প্রাঙ্গণে। দর্শনার্থী অল্প কয়েকজনই রয়েছেন। দর্শনে কারও কোনওরকম অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তবুও সেবাইতরা কটু সম্ভাষণে দর্শনার্থীদের উপর খবরদারি চালিয়ে যাচ্ছেন। শ্রীমান অয়ন বয়সে তরুণ। একটু মনঃক্ষুণ্ণ হয়। রামপ্রসাদের নামে এদের কাছে তো এটা অর্থ উপার্জনের জায়গা। ভক্তজনের মনের খবর রাখবার দায় তো তাদের নয়।
দেবীকে প্রণাম করে সকলে আসি রামপ্রসাদের গঙ্গার ঘাটে। জনশ্রুতি বলে, পুজো শেষে কালী প্রতিমা মাথায় নিয়ে মাতৃনামে বিভোর সাধক গঙ্গায় নেমে আর ওঠেননি। ঘাট সংলগ্ন প্রাচীর গাত্রে দেখতে পাচ্ছি সে কাহিনীর চিত্ররূপ। শোনা যায়, সুবে বাঙ্গলার নবাব সিরাজদোল্লা গঙ্গাবক্ষে ভাসমান প্রমোদ তরী থেকে রামপ্রসাদের মাতৃ সঙ্গীত শ্রবণে অভিভূত হয়ে পার্শ্বচর-সহ রামপ্রসাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গিয়েছেন।
ফিরে আসি সারস্বত আশ্রমে। মধ্যাহ্নে এখানেই প্রসাদ ভক্ষণ। ভোজন গৃহে সারি সারি আসন বিছানো। শালপাতার থালা ও প্লাস্টিকের গ্লাসে জল। মন্ত্রপাঠ চলছে। জানা গেল, পূর্বে এই অন্নদান সেবাকার্য আশ্রম নিবাসী সন্ন্যাসীরাই পরিচালনা করতেন। বর্তমানে আশ্রমে সন্ন্যাসীর সংখ্যা কমে আসায় কিছু লোক নিয়োগ করতে হয়েছে। সন্ন্যাসী যাঁরা আছেন প্রবীণ। শারীরিক শ্রমদানে অক্ষম। আমার আসনের সামনে একটি সাড়ে তিন চার বছরের শিশুকন্যা বাবা-মার সঙ্গে খেতে বসেছে। কী তার আনন্দ! আপনহাতে এটা ওটা মুখে দিচ্ছে। যেটা খুব ভাল লাগছে, আনন্দের অভিব্যক্তি তার ছোট মুখখানিতে। খাওয়ার পরে নাটমন্দিরে বাবা-মায়ের সঙ্গে সে-ও এসেছে। কিন্তু, অনেক চেষ্টা করেও তার সঙ্গে ভাব জমাতে পারিনি।
আশ্রম থেকে রওনা হতে হবে এবার। আশ্রম সংলগ্ন প্রকাশণা ভবন থেকে পছন্দ মতো বই বা অন্য কিছু সংগ্রহ করি কেউ কেউ। আমি সংগ্রহ করি দু’খানি ভিডিয়ো সিডি।
তার পর দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে। কিছুটা বিশ্রামের পর এবার ফেরার পালা। সূর্যদেব তখন পাটে বসেছেন। সমস্ত প্রকৃতি জগতে তখন ভীম পলশ্রীর করুণ সুর ধ্বনিত হচ্ছে। এখন লেখার সময়ে মনে সেই করুণ সুর। আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে যাওয়া পলি আর বেঁচে নেই।
ছবি— জয়ন্তী গলুই।
(সমাপ্ত)