ইন্দ্রজিৎ সাউ
প্রকৃতি প্রেমিকরা বলে থাকেন, যে কোনও জায়গার বিভিন্ন ঋতুতে আলাদা রূপ খোলে। তাই কোনও ভাল জায়গায় অন্তত দু’বার দু’টো আলাদা ঋতুতে যাওয়া উচিত। বিশেষ করে জঙ্গল আর জঙ্গল ঘেরা পাহাড়ে। বসন্তে কচি পাতা, মুকুলের সমারোহে প্রকৃতি যেন কৈশোরের লাবণ্য মাখা। বর্ষায় তরুণের সিক্ত শ্যামলিমা। আমি তাই জয়পুরের জঙ্গলে দু’বার যাচ্ছি। বাঁকুড়ার জয়পুর।
করোনা কালে বিধি নিষেধের বন্দিত্বে প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত। কোথাও বেড়াতে না যেতে পেরে প্রায় পাগল হওয়ার জোগাড়। তাই লকডাউন একটু শিথিল হতেই রোজই প্রায় কোনও না কোনও জায়গা যাওয়ার পরিকল্পনা চলেছে। আবার ভেস্তেও গিয়েছে। কারণ রাজ্য সরকারও আমাদের পরিকল্পনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নতুন নতুন নিয়ম কানুন এনে আমাদের ঘরে আটকে রাখার চেস্টা করেছে। শেষমেশ ঠিক হল আমরা জয়পুরের জঙ্গলে যাব। এর আগেও আমরা এখানে এসেছি। আর আমাদের গ্রুপের ওয়েবসাইটের উদ্বোধন এখানেই হয়েছিল। কিন্তু এখানেও সমস্যা। দু’দিন সময় ঠিক করেও আমাদের বন্ধু সুব্রত বাতিল করল। বাধ্য হয়ে ওকে বাদ দিয়ে আমি আর বাইচুং মানে দীপাঞ্জন বেরিয়ে পড়লাম। বেরিয়েছিলাম সকাল সকাল। প্রায় ৫.৪০ নাগাদ। আমাদের পক্ষীরাজ বাইকে সওয়ার হয়ে।
ভোর থেকেই আকাশের মুখভার। তাতে অবশ্য লাভই হল। সুন্দর মনোরম ঠান্ডা একটা পরিবেশে বাইক সাঁইসাঁই করে এগিয়ে চলল। রাস্তা প্রায় ফাঁকা। মাঝে মাঝে তো দেখি আমরা দু’জনে ছাড়া আগে পিছে কেউ নেই। জগৎবল্লভপুর-জাঙ্গিপাড়া-আরামবাগ হয়ে ৯টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম জয়পুর বন বিভাগের এলাকায়।
জঙ্গলে ঢোকার আগে নিজেদের ইঞ্জিনে জ্বালানি ভরে নিলাম। জঙ্গলের রাস্তা শুরু হচ্ছে বনবিভাগের অফিসের পর থেকেই। বিষ্ণুপুর যেতে গেলে এই রাস্তা দিয়েই যেতে হয়। এর আগে জয়পুর আসা আর বিষ্ণুপুর যাওয়ার সুবাদে বেশ কয়েক বার এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করেছি। এবং প্রত্যেক বার মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু বর্ষায় যে এ রকম মনোমুগ্ধকর রূপ দেখব ভাবিনি। আগের কয়েক দিন বৃষ্টি হওয়ার সবুজের স্নিগ্ধতা নিয়ে রাস্তার দু’ধারে গাছের সারি দাঁড়িয়ে আছে। যানবাহন একেই কম চলছে। যেটুকু চলছে তার হাওয়ায় আর প্রকৃতির বাতাসে ওড়া ধুলোর আস্তরণ জঙ্গলের পাতা থেকে ধুয়ে মুছে গিয়েছে। তাতে জঙ্গলের রূপ খুলে গিয়েছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে সবুজের রূপ উপভোগ করতে লাগলাম। সেই সঙ্গে চলল ফটোশুট।
দলের সঙ্গে এসে রাত কাটিয়েছিলাম বন বিভাগের ওয়াচ টাওয়ারে। কত স্মৃতি সেই সফরের। এবারেও গেলাম সেই ওয়াচ টাওয়ারটাকে একটু দর্শন করে নিলাম। বেশ সুন্দর সে। আরেকটা জিনিস দেখলাম, বন দফতরের পাঞ্চেত ডিভিশনের একটা বোর্ড। তাতে জয়পুর ওয়াচ টাওয়ার থেকে লালবাঁধ পর্যন্ত ট্রেকিংয়ের বিজ্ঞাপন। আগেরবার দেখিনি। নতুন চালু হয়েছে হয়তো।
ওয়াচ টাওয়ার দেখে এগিয়ে গেলাম বাসুদেবপুরের চাতালের দিকে। পুরোটাই জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। কখনও পাকা অথবা লাল বাঁকুড়া মাটির রাস্তা, রেললাইন অথবা হালফিলের ঢালাই রাস্তা পেরিয়ে। সবুজের সমারোহ দেখতে দেখতে। চাতাল এখানকার স্থানীয় মানুষরা বলে। আসলে এটা একটা ব্রিটিশ আমলের বায়ুসেনা ছাউনি। ইংরেজরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৈরি করেছিল। এর আগে যখন গ্রুপের দলবলের সঙ্গে এসেছিলাম তখন একটা রানওয়ের কথাই জানতাম। এবারেও তাই। প্রথমে তো বড় চাতালটাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ভুলে গিয়েছিলাম কোথায়। তার পর ওখানকার একজনকে জিজ্ঞেস করে সন্ধান পেলাম। বড় চাতালে যখন ঘুরছি তখনই আমাদের কাপ্তানবাবুর ফোন এবং সঙ্গে তথ্য, ‘‘ওখানে আর একটা চাতাল আছে সেটা দেখে আসবি। আর যদি বিশেষ কোনও পাখির ছবি তুলে আনতে পারিস তাহলে আরসানালের বিরিয়ানি আর চিকেন চাপ।’’
আমরা যখন বড় চাতালে ঘুরছি তখন একদল কচিকাঁচা সাইকেল নিয়ে হাজির হয়েছিল। স্থানীয় ছেলে সব। ক্যামেরা দেখেই তাদের আবদার একটা ছবি তুলে দিতে হবে এবং তা ভাইরাল করতে হবে। তাদের ছবি তুললাম। সেইসঙ্গে চলল আমার আর বাইচুংয়ের ফটো আর ভিডিও শুট। বাইক নিয়ে চলে গেলাম প্রায় শেষ প্রান্তে। কিন্তু ওটা শেষ না। চাতালটা এল টাইপের সোজা অংশটা এখন মোটামুটি পরিষ্কার। কিন্তু শেষে গিয়ে বাঁদিকে যে অংশটা চলে গিয়েছে ওটা বেশ জঙ্গলে ভরা। আমরা যখন চাতালের দিকে ঢুকছি স্থানীয় কয়েকজন সতর্ক করেছিলেন, জঙ্গলে একটা একা হাতি রয়েছে। তাই বেশি গভীরে না যাই। একা হাতি অনেক সময়ে ক্ষেপে থাকে। দলের তাড়া খেয়ে বা সঙ্গিনীর মন না পেয়ে। তাই আমরা আর ঝুঁকি নিইনি। ও হ্যাঁ আগেরবারে বাসুদেবপুর রেঞ্জের অফিসে বন দফতরের চারটি কুনকি হাতি দেখেছিলাম। তাদের একটার নাম শম্ভু। বাকি তিনটের নাম শিলাবতী, কাবেরী আর ফুলমতি। (শম্ভু আর তিন বন্দিনী প্রেমিকার গল্প)।
বাচ্ছাগুলোর থেকে ছোট চাতালের সন্ধান করে আমরা সেদিকে চললাম। এটা বড় চাতালের একদম কাছেই শুরুর বাঁদিকে। তবে এটা ঢালাইয়ের নয়, পিচের তৈরি। পিচের অস্তিত্ব বিলুপ্ত প্রায়। এখানে বনবিভাগ থেকে নতুন একটা ওয়াচ টাওয়ার করা হয়েছে। ওয়াচ টাওয়ারের নীচে আমরা মনোরম পরিবেশে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ শীতল বাতাস উপভোগ করলাম। প্রচুর পাখি ডাকছে। পাখিদের কলতান শুনতে লাগলাম। দারুণ লাগছিল সেই কলতান। দেখলাম আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় হারিয়ে যাওয়া হরেক রকমের প্রজাপতি। জায়গাটার নাম কী যে বলেছিল ভুলে গিয়েছি।
এর পর আমরা ওখান থেকে চলে এসে মেন রাস্তা পেরিয়ে একদম উন্টো দিকে মোরামের ক্যানাল পাড়ের রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম। সাধারনত এদিকে খুব কম লোকজনই আসে। হয়তো হদিস জানেন না। লাল মোরামের রাস্তার পাশেই জঙ্গল আবার ক্যানালের ওপারেও জঙ্গল। এক অপরূপ সবুজ। মন ভাল করে দেবে সঙ্গে সঙ্গে। এখানে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে মিললেও মিলতে পারে হরিণের দেখা।
এখানকার ছবি লেন্স বন্দি করে আমরা এগিয়ে চললাম মূল রাস্তার দিকে। কিন্তু আমি আছি আর কোনও কাণ্ড হবে না তাই হয়!! এর আগের বারে দেখা ফেরার রাস্তা ধরলাম বাইক নিয়ে। পথে একটা ভগ্ন স্বাস্থ্যের সেতু পড়ল। আগেরবার যখন এসেছিলাম তখন আমরা গাড়ি ছেড়ে হেঁটে ঘুরেছিলাম। তখন এত ঘন জঙ্গল ছিল না। ভরা বর্ষায় জঙ্গল তার বিস্তার বাড়িয়েছে। একে তো পাথর, মাটি দূর থেকে দেখে বেশ সবুজ গালিচা পাতা মনে হচ্ছিল। কিন্তু পুরোটাই ছোট ছোট শ্যাওলায় ভরা রাস্তা। বাইকের চাকা ভীষণ ভাবে হড়কে যাচ্ছিল। আবার পিছনে ফিরে মূল রাস্তায় উঠলাম। তার পর দুপুরের খাওয়া সেরে বাড়ি।
ফেরার পথে একটা আশ্চর্য নির্মাণ দেখেছিলাম। শাল জঙ্গলের ভিতরে প্রচুর উই ঢিবি থাকে। বর্ষার জলে সেই ঢিবির চূড়া ভেঙে সুন্দর এক ছাঁদ তৈরি করেছে। যদিও সেই সৌন্দর্য তৈরি করতে উইপোকাগুলোর ঘর ভেঙেছে!
ছবি- লেখক
(সমাপ্ত)