অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

মাদুর বোনা গ্রামের কথা

দেবাশিস দাস

মাদুরও ইতিহাস বোনে। গড়ে নস্টালজিয়া মনের গহন স্মৃতিপটে। মাদুর এখন হারিয়ে যাওয়া অনেক কিছুর মতো স্মৃতিজাগানিয়া। সন্ধ্যের আড্ডা হোক বা গরমকালে ছাদে মাদুর পেতে ঘুম, সবেতেই জড়িয়ে ছিল মাদুর। শতছিন্ন, কাঠি ভাঙা মাদুরে প্রত্যন্ত গ্রামের হাজার হাজার কিশোর-তরুণ প্রজন্ম একদিন দেখেছিল সুখী আগামী দিনের স্বপ্ন। কেউ আজ সফল হয়ে কাঠের পালঙ্কে ম্যাট্রেস চাপিয়েছে। কেউ বা সেই মাদুরে শুয়েই ‘এবার হল না, পরের বার’এর জেদ নিয়ে ঘুমিয়েছে।

নস্টালজিক অনুভূতির সাক্ষী হতেই এক মঙ্গলবার আমরা চারজন বেরিয়ে পড়েছিলাম মাদুর গ্রামের খোঁজে। ক্যাপ্টেন দীপকবাবুর সঙ্গে আমি, দীপু আর ইন্দ্রদা রওনা দিলাম। পাতিহাল থেকে মুন্সিরহাটগামী রাস্তা ধরে পেঁড়োর মোড়। সেখান থেকে ডানদিকে পেঁড়ো-বসন্তপুর রোড ধরে ২০-২৫ মিনিট বাইক চালালেই নরনারায়ণচকে পৌঁছনো যায়। আমরা অবশ্য একবারে পৌঁছতে পারিনি। ইন্দ্রদা খোঁজ নিয়েছিল আগে। জেনেছিল, উদয়নারায়ণপুর ব্লকের কানুপাট-মনশুকার বিভিন্ন এলাকায় মাদুর কাঠির চাষ হয়। আবার মাদুর বোনাও হয়। আছে একটা হাটও। সেই মতো জায়গায় পৌঁছনোর আগে লোকজনকে জিজ্ঞাসা করতে হয়েছিল। মদন দাস সেতু পেরিয়ে কিছুটা যাওয়ার পরে একটি কিশোরকে জিজ্ঞাসা করতে সে বলল, বাঁ হাতি রাস্তা ধরে কিছুটা গেলেই পরপর পড়বে মাদুর বোনা গ্রামগুলো। সেই মতো এগিয়ে প্রথমে পৌঁছনো গেল নরনারায়ণ চকে। প্রথমে ইচ্ছে ছিল মাদুর কাঠি চাষ দেখব। নরনারায়ণচকে পৌঁছে এক কাকিমাকে জিজ্ঞাসা করলাম, মাদুর কাঠি বোনা জমিগুলো কোথায়? তিনি জানালেন, আরও যেতে হবে। পুরপাট নামে এক জায়গায় হাসপাতালের আশেপাশের জমিতে মাদুর কাঠি চাষ হয়।

কানুপাটে মাদুর কাঠির চাষ।

নরনারায়ণ চক থেকে পুরপাট বেশ দূর। বাইকে ১০-১৫ মিনিট লাগল। কিন্তু পুরপাটে কোনও মাদুর কাঠি চাষের জমির খোঁজ মিলল না। স্থানীয় একজনকে জিজ্ঞাসা করা হল। তিনি বললেন, ‘‘কানুপাটের আশেপাশে খোঁজ করুন পেয়ে যাবেন।’’ কানুপাটে গিয়ে আবার জিজ্ঞাসা। পথপ্রদর্শক বললেন, মূল রাস্তা ছাড়িয়ে বাঁ দিকে কিছুটা গেলেই জমিগুলো। যে জায়গাটির সন্ধান মিলল সেখানে গিয়েও মাদুর কাঠির জমি চিনতে পারি না। দেখা মিলল স্বপন সামন্ত নামে এক প্রৌঢ়ের। তিনি দেখিয়ে দিলেন জমি। উলুখাগড়ার মতো গাছের জঙ্গল। না চেনাই স্বাভাবিক। ইন্দ্রদা আর দীপু ছবি তুলল। ক্যাপ্টেন তথ্য জানতে স্বপনবাবুর সঙ্গে কথোপকথন চালাচ্ছিলেন। তিনি জানালেন, মাদুর কাঠি সারা বছরই চাষ হয়। বছরে তিনবার কেটে নেন চাষিরা। কেটে নেওয়া কাঠি শুকোতে হয়। তার পর তিন রকম দৈর্ঘ্যে কাটা হয়। চাষিদের কাছে এক ধরনের ছুরি থাকে। তা দিয়ে একসঙ্গে একটা কাঠি তিন ভাগে চেরা যায়। স্বপনবাবু জানালেন, তবে এখন মাদুর কাঠির চাষ প্রচুর কমে গিয়েছে। কাছাকাছি এই একটা জমিতে আর পাশের পাড়ায় একটা, দু’টো জমিতে চাষ হয়।

চাষ কমার কারণ? কারণ মাদুর বোনার লোক নেই। স্বপনবাবু বললেন, ‘‘পাশের দলুই পাড়ায় একসময়ে বেশ কিছু ঘর মাদুর বুনত। কিন্তু এখন আর কেউ বোনে না। লাভ নেই। এখনকার ছেলেরা এ কাজে আসতেও চায় না। তারা বাইরে কাজ করতে চলে যায়।’’ স্বপনবাবু আরেকটা তথ্য দিলেন। এই এলাকায় একসময়ে প্রচুর আখের চাষ হত। জমিতেই আখ মাড়াই হত। গুড় তৈরি হত। বহু লোক সে কাজে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু আখ চাষ অনেক কমে গিয়েছে। আমরা দু’একটা আখের খেত দেখতেও পেলাম। স্বপনবাবুদের পাড়া ছাড়িয়ে এসে আরেকটি মাদুর কাঠির জমি মিলল। আবার থেমে ছবি।

সুভাষ হাট। মাদুর কাঠি বিক্রি হয় এখানে।

কাঠির ছবি তো হল। কিন্তু মাদুর বোনেন এমন কাউকে মিলবে না? নরনারায়ণ চকে একজনের সন্ধান মিলেছিল। তাঁর বাড়ি সুভাষ হাটের কাছে। সুভাষ হাটটিও কিন্তু মাদুর বোনার সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত। এই হাটে চাষিরা তাঁদের মাদুর কাঠি বিক্রি করতে আনেন। সেখান থেকে কেনেন মাদুর শিল্পীরা। আর পাইকাররা। তা চলে যায় বিভিন্ন প্রান্তে। ঠিক হল, মাদুর শিল্পীদের খোঁজার আগে সুভাষ হাটটা একবার দেখে নেওয়া হবে। হাট বসে শনি ও বুধবার। আজ মঙ্গলবার। ফাঁকা হাট। তা-ও তথ্য তো! হাটের চালায় কয়েকজন আড্ডা দিচ্ছিলেন। সন্তোষ ছড়ি, কচিরাম ছড়ি, সমীর পাছাল। তাঁরাই বললেন, এটা এখন আর শুধু মাদুর কাঠির হাট নেই। আনাজপাতি, মাছ সবই বিক্রি হয়। তবে বাকি হাট ১২টা পর্যন্ত চললেও মাদুর কাঠির হাট সকাল সকাল শেষ হয়ে যায়। তাঁরা এটাও জানালেন, হাটের কাছাকাছি যাঁর কথা জেনেছি তিনি আর মাদুর বোনেন না। তিনি এখন মাদুর পাইকারি বিক্রি করেন। এই এলাকায় এখন আর কেউ মাদুর বোনেন না। তবে কানুপাটের বাগপাড়ায় দু’একজন এখন আছেন।

রবিন সেনাপতির সাক্ষাৎকার চলছে।

বাইক ঘুরল বাগপাড়ার দিকে। আমাদের মূল ইচ্ছেও ছিল মাদুর বোনা লাইভ দেখার। হাটের চালার আড্ডাধারীদের থেকে কয়েকজনের নাম জোগাড় করেছিলাম। বাগপাড়ায় পৌঁছে নাম ধরে খোঁজ করতে বেশ কয়েকজন বেরিয়ে এলেন। প্রায় ঘেরাওয়ের মতো। পুরুষের সঙ্গে মেয়েরাও ছিলেন। কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করলেন, আর কার কার নাম আছে? কী ব্যাপার? ইন্দ্রদা ক্যাপ্টেনকে বলল, ‘‘ওঁরা আমাদের সরকারি লোক ভাবছেন।’’ ক্যাপ্টেন জোরে জোরে ঘোষণা করল, আমরা সরকারি লোক নই বলে। বুঝিয়ে বলতে হল কী জন্য আসা। তখন আবার কৌতূহল, টিভি চ্যানেলের লোক! এর আগে রাস্তায় তিন বাইক আরোহী বন্ধু তো ধরেই নিয়েছিল, ‘ভ্যাকসিন অন হুইলের লোক আমরা। রাস্তাতেই ঠুকে দেওয়া হবে ভ্যাকসিন।

মাদুর কাঠি।

সব কৌতূহল শান্ত হওয়ার পরে প্রথম লেখা মাদুর শিল্পীর কথা ঘোষণা করা হল। শ্যামল বাগ। এক বৃদ্ধা বললেন, ‘‘শ্যামলকে বাড়িতে পাবে না। ও এখন জমিতে কাজ করছে।’’ তাহলে? তখনই পাড়ার একজন এক বৃদ্ধকে দেখিয়ে বললেন, ‘‘এই তো ইনি মাদুর বোনেন।’’ মোবাইলে তাঁর একটা সংক্ষিপ্ততম সাক্ষাৎকার নেওয়া হল।

প্রশ্ন: আপনার নাম?

উত্তর: রবিন সেনাপতি।

প্রশ্ন: কত বছর ধরে মাদুর বুনছেন?

উত্তর: ৩৫ বছর ধরে।

প্রশ্ন: মাদুর বোনার এখন কী অবস্থা?

উত্তর: এখনকার কম বয়সি ছেলেরা জমিতে চাষও করতে চায় না। মাদুরও বোনে না। মাঝিপাড়া আর বাগপাড়া মিলিয়ে চার-পাঁচ ঘর। সকলেই বয়স্ক। আমরা মাদুর বুনি কেন না আমরা আর চাষের কাজ করতে পারি না। ঘরে বসে থাকব কেন? যা আসে তা দিয়ে যদি বাজারটাও হয়। যতটা খাটতে হয় তার তুলনায় লাভ থাকে খুব কময় জিনিসপত্রের দামও বেড়েছে।

প্রশ্ন: মাদুর তৈরির প্রক্রিয়াটা যদি একটু বলেন?

উত্তর: সুভাষ হাট থেকে মাদুর কাঠির আঁটি কিনে আনতে হয়। তিন মুঠোতে এক আঁটি। এক আঁটির দাম ২৭৫ টাকা। এক আঁটি কাঠি থেকে তিনটে মাদুর হয়। একেকটা মাদুর বিক্রি হয় ২৫০-৩০০ টাকায়। দড়ি আর পাটও লাগে। সব বাদ দিয়ে হাতে যা থাকে তাতে পড়তায় পোষায় না। শুধু বাপ-ঠাকুরদার পেশা বলে টিকে আছি। আমাদের কয়েকজনের পরে এই শিল্প শেষ হয়ে যাবে।

রবিনবাবু জানালেন, সরকার থেকে তিনি বার্ধক্য ভাতা পান। কিন্তু মাদুর শিল্পের জন্য কোনও সাহায্য পান না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা এক বাসিন্দা জানালেন, আগে এই এলাকার ঘরে ঘরে মাদুর বোনা হত। এখন এই ক’জনই টিকেছেন। এর পর মাদুর বোনা দেখা। রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে জটলার মধ্যে দাঁড়িয়েছিলেন এক বধূ। তিনি জানালেন, তাঁর শ্বশুর মাদুর বোনেন। জটলাটা সঙ্গে করে পৌঁছে দিল মদন বাগের আড্ডায়। দু’পা ফেলেই।

মাদুর বোনা চলছে। শিল্পী মদন ও ঝর্না বাগ।

ছোট্ট একটা চালা ঘরে মাদুর বুনছিলেন বৃদ্ধ মদন বাগ আর তাঁর স্ত্রী ঝর্না বাগ। মাদুর বুনতে দু’জন লাগে। মাদুর বোনার কাঠের যন্ত্রটিকে ওঁরা আড্ডাই বলেন। জরির কাজেও আড্ডা কথাটার চল আছে। আড্ডাটা কাঠের তৈরি। মাঝে পরপর দড়ির টান। সেই টানের মাঝে মাদুর কাঠি ঢুকিয়ে বোনার কাজ চলছে। এঁরা তিন আয়তনের মাদুর বোনেন। বড়, মাঝারি এবং ছোট। এমন একটা শিল্পের এই হতশ্রী দশা হল কেন? কম কথা বলেন মদন বাগ। অনেকক্ষণ ধরে আলাপ আলোচনার পরে যেটুকু বোঝা গেল, প্লাস্টিকের মাদুরের সঙ্গে লড়াইয়ে অনেকদিন পিছিয়ে পড়েছে হাতে বোনা কাঠির মাদুর। কারণটা খুবই সোজা। মানুষ কোয়ালিটির সঙ্গে আপস করে করছে দামের জন্য। প্লাস্টিকের মাদুরের দাম ২০০ টাকা। সেখানে কাঠির মাদুর ৩০০-৪০০ টাকা। কাঠির মাদুর বুনতেও সময় লাগে। লাভও তেমন থাকে না। আরও একটি তথ্য পাওয়া গেল। মদনবাবুর দাবি, মেদিনীপুরের সবংয়ে এক কাঠির মাদুর বোনা হয়। মানে কাঠির পরত একটাই। কানুপাটের এঁরা ডবল কাঠির মাদুর বোনেন। ফলে দাম বেশি। মেদিনীপুরের মাদুরের চাহিদাও বেশি।

মদন ও ঝর্না বাগের বোনা মাদুর।

সব মিলিয়ে ধীরে ধীরে কোণঠাসা হচ্ছে, বিলুপ্তির পথে চলেছে হাওড়ারও এক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য।

ছবি— ইন্দ্রজিৎ সাউ ও দীপশেখর দাস

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *