দীপক দাস
কুমোরপাড়াটা পার করলেই দেখা যেত মূর্তিগুলো। ছাদে সার সার দিয়ে বসে আছে। দেখতে ভাল লাগত। কিন্তু বিস্তারিত কিছু জানতাম না। জানা সম্ভবও ছিল না। তখন সবেমাত্র প্রাথমিক স্কুল। গুমোতলায় সুধাময় আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়। কী করে জানব ওই মূর্তিগুলোর গঠন শৈলী বা ঠাকুর দালানে তাদের অবস্থানের তাৎপর্য সম্পর্কে! যেমন জানতাম না কুমোরপাড়ার সুনাম নিয়েও। রাজধানী কলকাতা পর্যন্ত এখানকার মাটির হাঁড়ির সুনাম ছড়িয়েছিল। এ নিয়ে একটা মজার গল্পও আছে। পাতিহালের এক বাসিন্দার এন্টালিতে ফলের দোকান ছিল। একবার কোনও দরকারে তাঁর মাটির জিনিসপত্র বিক্রি হয় এমন দোকানে যাওয়ার প্রয়োজন হয়। দোকানদার তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘নিন না বাবু ভাল হাঁড়ি। পাতিহালের জিনিস।’’ পাতিহালের বাসিন্দা হিসেবে ফল ব্যবসায়ী খুশি হয়েছিলেন।
কুমোরপাড়ার ইতিহাস পরে আলোচনা করা যাবে। ঠাকুরবাড়ির কথায় আসা যাক। কোনও ঠাকুরদালানে শিল্পসুষমা মণ্ডিত এমন মূর্তি খুব বেশি দেখিনি। পাতিহাল গ্রামে বেশ কয়েকটি দুর্গাদালান রয়েছে। সেগুলোর বেশির ভাগই অভিজাত বর্গের। দু’জন জমিদারও রয়েছেন এঁদের মধ্যে। কিন্তু দালানের ছাদে মূর্তি নেই কোথাও। মূর্তিগুলোর সৌন্দর্য ছিল শৈল্পিক। আর্ট কলেজের অনেক পড়ুয়াকে ঠাকুরবাড়ির সামনে খোলা চত্বরে মূর্তিগুলোর ছবি আঁকতে দেখেছি। সেই সময়ের নিস্তরঙ্গ গ্রাম জীবনে সে বেশ অভিনব ব্যাপার।
মূর্তির টানেই ঠাকুরবাড়ির ইতিহাসে আগ্রহ জন্মায়। আর তাতেই মেলে বিচিত্র ধর্ম সমন্বয় ও বৈভবের এক ইতিহাস। ঠাকুরবাড়িটি যাঁদের তাঁরা বহু বছরই কলকাতা শহরের বাসিন্দা। কয়েক দশক আগেই গ্রামের সঙ্গে তাঁদের সংযোগ নেই তেমন। ফলে যোগাযোগের কোনও সূত্র মেলেনি। ইতিহাস জানতে দ্বারস্থ হয়েছিলাম পাতিহাল দামোদর ইনস্টিটিউশনের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক গৌরমোহন চক্রবর্তীর। তিনি আমার শিক্ষকও। গৌরবাবু জানালেন, জীবন মণ্ডল নামে এক ব্যবসায়ী পরিবারের মন্দির এই ঠাকুরবাড়ি। এখানে পুজো পেতেন রাধাগোবিন্দ জিউ। মণ্ডল পরিবারের ছিল মদের ব্যবসা। যথেষ্ট বিষয় সম্পত্তি ছিল তাঁদের। গৌরবাবুর এখন বয়স প্রায় ৮০ বছর। তিনি ১৯৫৩-৫৪ সালে দেখেছেন, বেশ ঘটা করে পুজো হত। ভোরবেলা থেকে রাত পর্যন্ত চলত পুজো। কাঁসর-ঘণ্টার আওয়াজ শোনা যেত দূর থেকে। মূর্তি বসানো যে ঠাকুরদালান তার এক পাশে ছিল রাধাগোবিন্দ জিউয়ের মন্দির। দালানের আরেক পাশেও একটি ঘর রয়েছে। সেখানে কী ছিল তা আর মনে করতে পারলেন না গৌরবাবু।
সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পুজো হওয়ার তথ্যেই জীবনবাবুদের বৈভবের একটা ইঙ্গিত মেলে। মন্দিরের জন্য তাঁরা খরচও করতেন। গৌরবাবুর কথায়, ঠাকুরবাড়ির মূল দরজার দু’পাশে দু’টো ঘর ছিল। তাতে মন্দিরের কাজকর্মের জন্য নিযুক্ত কর্মীরা থাকতেন। ব্রাহ্মণ, ভোগ রাঁধার লোকজন। ওড়িশা থেকেও কর্মী আনা হয়েছিল। পাতিহালে এক ঔড্রদেশীয়কে ছোটবেলায় আমিও দেখেছিলাম। সুধাময় স্কুলের পাশে ডাকঘর। তার পাশে একটি সারের দোকানের এক কোণে তিনি থাকতেন। মাটি কাটার কাজ করতেন। তাঁর পূর্বপুরুষ কারও সঙ্গে জীবন মণ্ডলদের ঠাকুরবাড়ির যোগ ছিল কিনা, জানা নেই। এমন যোগসূত্রের কথা কখনও মনে আসেনি। গৌরবাবু জানালেন, মন্দিরে একটি অষ্টধাতুর রাধাগোবিন্দের মূর্তি ছিল। সেটি এক সময়ে চুরি হয়ে যায়।
অত বড় লম্বাটে ঠাকুরবাড়ির একটা ঘরে রাধাগোবিন্দের মন্দির ছিল। তাহলে এত বড় দালান কেন? গৌরবাবু বললেন, দালানে দুর্গাপুজো হত। পুরো ঠাকুরবাড়িটাই উঁচু পাঁচিল ঘেরা ছিল। মূল প্রবেশপথটা দেখলেই বোঝা যায়। বেশ ছড়ানো একটি চত্বর। এই চত্বরেই আবার রয়েছে একটি শিব মন্দির। এটিও ওই মণ্ডল পরিবারের। একই পরিবার বৈষ্ণব এবং শাক্ত ধর্মের ভক্ত এমনটা কি খুব বেশি দেখা যায়? কী এর কারণ তা আজ আর জানা সম্ভব নয়। শিব মন্দিরটির বয়সও অনুমান করা শক্ত। ঠাকুরবাড়ির মূল প্রবেশপথের ডানপাশে একটি ফলকে লেখা, ‘শ্রী শ্রী রাধাগোবিন্দ জিউ ঠাকুর বাটি সন ১৩৫২ সাল ২৭ শে আষাঢ় পাঁতিহাল’। এটিই কি ঠাকুরবাড়ির প্রতিষ্ঠা সাল? নাকি পুনর্নির্মাণের কাল? উত্তর জানা নেই।
ঠাকুরবাড়ি এখনও মন্দির আর দালানের কারণে কিছুটা হলেও বেঁচে রয়েছে। কিন্তু মূর্তিগুলো? সেগুলো সবই হারিয়ে গিয়েছে। যত্নের অভাবে। মূর্তিগুলো আসলে কী ছিল? গৌরবাবুর সঙ্গে আলোচনার সময়ে ছিলেন তাঁর তিন পুত্রও— অরিন্দম, অনিন্দ্য আর অভিরূপ। প্রথম দু’জন দেখেছিলেন মূর্তিগুলো। কীসের মূর্তি ছিল? অরিন্দমদা বললেন, ‘‘সরস্বতী, লক্ষ্মী, গণেশ আর জয়া বিজয়া ছিলেন। আমি শুঁড় ভাঙা গণেশের মূর্তি দেখেছি।’’ জীবনবাবুরা মূর্তিগুলো বাইরে থেকে শিল্পী আনিয়ে তৈরি করিয়েছিলেন, বলছিলেন গৌরবাবু। সেই কারণেই হয়তো মূর্তিগুলো আর্ট কলেজের শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করত। কিন্তু একটা একটা করে ভেঙে পড়তে পড়তে এক সময়ে সব চিহ্ন মুছে গেল। হারিয়ে গেল মন্দির-কলার অনন্য বৈশিষ্ট্য। এখনও ঠাকুরবাড়ির থাম ও অন্য কাজগুলো দেখলে এর শৈলীর কিছুটা আভাস মেলে।
পাতিহালের মন্দির নিয়ে আলোচনা এক ঠাকুরবাড়িতে শেষ হওয়ার নয়। অল্প দূরত্বের ব্যবধানে বেশ কিছু মন্দির রয়েছে। যেখানে ঠাকুরবাড়ি সেখান থেকে কিছুটা এগিয়ে গেলেই পড়ে বাঘমুখো বাড়ি। বাড়ির এমন নামের কারণ মূল দরজার উপরের দিকে বাঘের মূর্তি। যদিও সিংহ দরজার দু’পাশে দু’টি বড় সিংহ রয়েছে। অনেকেরই প্রশ্ন, সিংহের মূর্তিওয়ালা বাড়ির নাম কেন বাঘমুখো বাড়ি। আসলে বাঘের মুখগুলো ঠিক খেয়াল করা যায় না। ওগুলো চোখের উপরিতলে রয়েছে। ফলে চোখ তুলে একটু দেখতে হয়। এই পরিবারের একটি রাসমঞ্চ রয়েছে। ভাঙাচোরা, লতাগুল্মে ঢাকা। রাসমঞ্চের বয়স জানা যায় না। গৌরবাবু বলছিলেন, ‘‘১৯৬১ সাল নাগাদ ওই বাড়িতে নাটকের মহড়া দিতে যেতাম। রাসমঞ্চটি ভাঙা ছিল। রাসমঞ্চের পাশে একটা বিরাট বাড়ি ছিল। সেই বাড়িতেই মহলা হত। বাড়িটিও এখন নেই।’’ বাঘমুখো বাড়ির মণ্ডলরা পাতিহালের ধনবান ব্যক্তিদের অন্যতম। এই পরিবারের তেমন ইতিহাস মেলে না। তবে শোনা যায়, এঁরা কোনও জমিদারের খাজনা আদায়কারী ছিলেন। এরকমই আরেক খাজনা আদায়কারী ছিলেন মিত্রগড়ের মিত্ররা। তাঁদেরও একটি শিবমন্দির ছিল। সেই মন্দিরটি অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মন্দিরকে বেষ্টন করে একটা বটগাছ বেড়ে ওঠায় তার আঁকড়ে ধরা শিকড়ে মন্দিরের আদল বোঝা যেত। এখন আর কোনও চিহ্নই নেই।
কুমোরপাড়ায় রয়েছে শয়লা মন্দির। এই মন্দিরে শীতলা ও শয়লার একত্রে অবস্থান। স্থানীয় মানুষজন বলেন, দুই দেবী আসলে দুই সই। মকর সংক্রান্তির দিনে গ্রামের মেয়েরা এই মন্দিরে এসে সই পাতাত। এখন অবশ্য সই, গঙ্গাজলের বন্ধুত্ব অতীত। পুজো হয় আষাঢ় মাসে। নির্দিষ্ট দিন নেই পুজোর। ব্রাহ্মণ ঠিক করে দেন দিন। সেই সময়েই শয়লার গানের আসরও বসে মন্দির চত্বরে। গ্রামে শীতলার একটি মন্দির রয়েছে। ঘোষালরা সেবায়েত। তবে এই মন্দিরটি প্রথমে ঘোষালদের ছিল না। এক যুগী পরিবারের দেবী ছিলেন এই মন্দিরের শীতলা। যুগীদের বংশের শেষতম বৃদ্ধা মারা যাবার পর গ্রামের জমিদার মজুমদারদের অনুরোধে ঘোষাল বংশ শীতলা মন্দিরের ভার নেন। মন্দিরের পাশেই একটি জলার নাম যুগীর জলা। সেই যুগী পরিবারের অস্তিত্বের প্রমাণ।
জমিদার মজুমদার বংশ গ্রামে বেশ কয়েকটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই মজুমদার বংশেই জন্মেছিলেন এ টি দেব। জনপ্রিয় অভিধানের প্রণেতা। দেব সাহিত্য কুটীর যাঁর অনন্য কীর্তি। এঁদের প্রতিষ্ঠা করা পঞ্চানন মন্দিরটি মান্নাপাড়ায় রয়েছে। মন্দিরের চাতালে একটি ফলকে নাম পাওয়া যায়, চমৎকার সুন্দরী দাসী। ইনি এ টি দেবের স্ত্রী বলে জানা যায়। এঁর নামে পাতিহালের নোলোর খটির পাড়ে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। কলকাতার ঝামাপুকুর লেনে মজুমদারদের একটি বাড়ির নামও ‘চমৎকার বাড়ি’। হাজারিবাগে মজুমদারদের ‘চমৎকার বাড়ি’ নামে একটি বাড়ি ছিল। সে বাড়ি তৈরি করান এ টি দেবের সেজো ছেলে নীরদ মজুমদার (বই ব্যবসা ও পাঁচ পুরুষের বাঙালি পরিবার- রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়)। পাতিহালের মন্দিরে পঞ্চানন-সহ মোট সাতজন দেব-দেবী রয়েছেন। ২০১৫ সালে মন্দির সংস্কার করা হয়। ফলে এর শিবমন্দিরের মতো প্রাচীন রূপটি আর দেখতে পাওয়া যায় না।
মজুমদারদের বসতবাড়ির কাছে মন্দিরতলা নামে একটি জায়গা রয়েছে। এখানে ছিল জোড়া শিবমন্দির। মজুমদারদেরই। একটি মন্দির ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। আরেকটি টিকে রয়েছে এখনও। কিন্তু মন্দিরে বিগ্রহ নেই। মন্দিরের সামনের অংশে পোড়ামাটির কিছু কাজের নমুনা এখনও রয়েছে। মন্দিরের দরজার উপরি অংশে প্রতিষ্ঠার সাল-তারিখ লেখা ফলকটি এখনও রয়েছে। তাতে লেখা, ‘সকাব্দ ১৭০৩ সক ১১৮৮ সাল’। অর্থাৎ মন্দিরটি ২৪০ বছরের পুরনো। মন্দিরের বয়স দেখে পাতিহালে মজুমদার বংশের জমিদারির প্রাচীনত্বের কিছুটা অনুমান করা যায়।
মজুমদার বংশের শ্রেষ্ঠ কীর্তি বসতবাড়ির একেবারে লাগোয়া, দুর্গামন্দিরের পাশে নারায়ণ মন্দিরটি। পঞ্চরত্ন মন্দিরটির গায়ে টেরাকোটার কাজ ছিল। তাতে রামায়ণের চিত্রাবলী দেখা যেত। ছোটবেলায় দেখা স্মৃতি থেকে বলতে পারি, হনুমানের গন্ধমাদন পর্বত নিয়ে ওড়া আর রথে রাম, এরকম একটা পোড়ামাটির কাজ ছিল। মন্দিরটি কিছু বছর আগে সংস্কার করা হয়েছে। সংস্কারের শুরুর আগে একটা আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে। মন্দিরের গায়ের টেরাকোটার সব কাজ চুরি হয়ে যায়। রামায়ণের চিত্রাবলীর কিছুই আর নেই। শুধু কিছু নকশা এখনও দেখা যায়।
মন্দির শৈলীতে পাতিহালের সেরা দু’টি দেবস্থান হল, ঠাকুরবাড়ি আর এই পঞ্চরত্ন মন্দির। কিন্তু দু’টি দেবস্থানই তাদের বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে। অবহেলায় ভেঙে আর চুরির কারণে।
কভারের ছবি— গুমোতলার ঠাকুরবাড়ি। এর মাথায় ছিল নানা মূর্তি।
ছবি— লেখক
(সমাপ্ত)