দীপক দাস
বছর চারেক আগের কথা। তখন মঙ্গলবার হলেই কোথাও না কোথাও বেরনো হত। জায়গা দেখা, মিষ্টি চাখা। মোট কথা, কোনও ছুতোয় বেরিয়ে পড়া। এখনকার করোনা অতিমারিতে থমকে যাওয়া জীবন ছিল না। ওই পর্বেই হাওড়া জেলার বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান ও ব্যক্তিত্বের স্মৃতিধন্য জায়গাগুলো দেখেছিলাম। হাওড়ায় ঐতিহাসিক ব্যক্তির অভাব নেই। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের বাড়িই তো হাওড়ায়। এই রকমই একটা মঙ্গলবারে বেরনো হয়েছিল কবি রামকৃষ্ণ রায়ের বাড়ির খোঁজে। খোঁজ মিলেছিল, তিনি আমতার রসপুরের বাসিন্দা ছিলেন।
রামকৃষ্ণ রায় কে? সাহিত্যের ইতিহাসের ছাত্ররা জানেন তিনি শিবায়ন কাব্যের কবি। তিনিই ‘সম্ভবত’ সবচেয়ে বড় শিবায়ন কাব্যের রচয়িতা। তাঁর কাব্যের নাম ‘শিবায়ন’ বা ‘শিবের মঙ্গল’। এ ছাড়াও তাঁর আরেকটি কৃতিত্ব রয়েছে। বাংলা সাহিত্যে সাহিত্যিক গদ্যের নমুনা তাঁর কাব্যেই মেলে। রামকৃষ্ণ রায় ভারতচন্দ্রেরও আগের কবি। এমন এক কবির বসতভিটের সন্ধান তো অতি পবিত্র কর্তব্য। তাই একদিন বেরিয়ে পড়া গেল। সেদিন পুরো দল যায়নি। ব্যস্ত ছিল সম্ভবত। গিয়েছিলাম আমি আর ইন্দ্র।
আমতা থেকে খুব বেশি দূর নয় রসপুর। এই গ্রামের রায় পাড়ায় কবিদের বহু পুরুষের বাস। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে জায়গাটির সন্ধান করা গেল। দামোদর তীরের জনপদ। বেশ স্নিগ্ধ-সবুজ। কিন্তু গেলেই তো হল না, সঠিক তথ্য চাই। কবির সম্পর্কে জানেন এমন একজনকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। তিনি সম্ভবত কবির বংশেরই কেউ। ফোন করা হয়েছিল তাঁকে। জেনেছিলাম তাঁর কাছে একটি বই আছে যে বই থেকে কবি ও তাঁর বংশের ইতিহাস জানা যাবে। কিন্তু ভদ্রলোক শর্ত দিয়েছিলেন, বই হাত ছাড়া করবেন না। এদিকে ওখানে কোথায় যে ফটোকপির দোকান আছে, জানি না। সময় গোধূলি পেরিয়েছে। দোকান খোঁজার সময় নেই। ইন্দ্র পরামর্শ দিয়েছিল, ‘‘বই নিয়ে চলে আসতে বলো। পুরোটা ক্যামেরায় ছবি তুলে নেব।’’
আমরা রামকৃষ্ণের স্মৃতিবিজড়িত নাটমন্দিরে অপেক্ষা করছিলাম। ভদ্রলোক কিছুক্ষণের মধ্যেই সাইকেল নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। মন্দিরের সিঁড়িতে বসে আমি কথা বলছিলাম আর ইন্দ্র বইয়ের পাতার ছবি তুলছিল। লেখার সময়ে একটাই অপরাধ বোধ কাজ করছে। ভদ্রলোকের নামটা ভুলে গিয়েছি। যে নোটবুকে তথ্য টোকা ছিল, সেটা হারিয়ে গিয়েছে কোথায়! কাজটা অত্যন্ত অন্যায় হয়েছে। ক্ষমাপ্রার্থী আমি। তবে বইটি বেশ কাজে দিয়েছে এই লেখা তৈরিতে। বইটির নাম, ‘রামকৃষ্ণ রায় কবিচন্দ্র ও রসপুর রায় বংশের ইতিকথা’। লেখক শ্রীপাঁচুগোপাল রায়। ইনি কবির বংশধর। ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত বই। বইয়ে রায় বংশের ১৫৪৫-১৮৪৫ সাল পর্যন্ত ইতিহাস ধরা আছে।
রামকৃষ্ণ রায় কবিচন্দ্রের পূর্বপুরুষেরা রসপুরের আদি বাসিন্দা নন। রসপুরে রায় বংশের আদি পুরুষ ধরা হয় যশশ্চন্দ্রকে। রাজ বংশেরই সন্তান তিনি। প্রাচীন বাংলায় দেব বংশের বেশ গৌরব ছিল। এই বংশের এক রাজা কর্ণসেন কর্ণপুরে রাজধানী তৈরি করেছিলেন। বংশেরই একটি শাখা রসপুরের রায়েরা। দলিলপত্রে প্রমাণ রয়েছে, রসপুরের রায়েরা আগে দেব পদবি ব্যবহার করতেন। যশশ্চন্দ্র কেন ও কোথা থেকে রসপুরে এসেছিলেন তার লিখিত নথি নেই। অনুমান, তিনি বর্ধমান থেকে আমতায় এসেছিলেন। বর্ধমানে দেব বংশের একটি শাখা বসবাস করত। বাংলায় মুঘল-পাঠান দ্বন্দ্বের সময়ে যশশ্চন্দ্র আমতার রসপুরে এসে থাকতে পারেন বলে পাঁচুগোপালের অনুমান। অবস্থানের দিক থেকে সেই সময়ে রসপুর গুরুত্বপূর্ণ ছিল। গ্রামটি সরকার সেলেমাবাদ এবং বালিয়া পরগনার অন্তর্ভুক্ত ছিল। গ্রামের একদিকে ভুরসুট পরগনা। অন্যদিকে মণ্ডলঘাট পরগনা। ভূরিশ্রেষ্ঠী বা ভুরসুট পরগনায় গুণীজনের বাস ছিল। এই পরগনার গড়ভবানীপুরে বাস করতেন অন্নদামঙ্গলের কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র। এলাকাটি বাণিজ্যের দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দামোদর দিয়ে তমলুক থেকে সমুদ্রগামী জাহাজ এই নদীতে চলত। এই কারণে ভুরসুট বাণিজ্যের শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। রসপুর গ্রামে অন্যপারে থলিয়া গ্রামে বন্দর গড়ে উঠেছিল। রসপুরের কাছেই কলিকাতা গ্রাম। যা রাজধানী কলকাতার থেকেও প্রাচীন জনপদ। বাওরিজের মানচিত্রে দামোদর নদকে ‘রসপুর নদী’ (raspas or raspur River) বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
যশশ্চন্দ্র রায় রসপুরে দামোদরের তীরে বসবাস করতে শুরু করলেন। বসতবাড়ি তৈরি করালেন। তাঁর বাসস্থানের একপাশে ছিল দামোদর। বাকি তিন পাশে পরিখা কাটিয়েছিলেন। যাতে তাঁর বসতভিটে সুরক্ষিত হয়। ধনী ব্যক্তিরা বাড়ির চারপাশে এরকম খাল কাটাতেন তখন। রসপুরে সেই পরিখার চিহ্ন এখনও রয়েছে বলে দাবি করেন কেউ কেউ। যিনি আমাদের বই দিয়ে সাহায্য করেছিলেন তিনিও সামনেই একটি জলাশয়কে দেখিয়ে বলেছিলেন, এটি সেই পরিখার অংশ। এখন মজে গিয়ে ডোবার মতো হয়ে গিয়েছে। আমরা যখন কথা বলছিলাম, খানতিনেক বাচ্চা খেলা করছিল। ইন্দ্রকে ছবি তুলে দেওয়ার আবদার করেছিল। ইন্দ্রর গলা জড়িয়ে ক্যামেরায় দেখেওছিল, তোলা ছবিতে কেমন দেখাচ্ছে তাদের।
এলাকায় যশশ্চন্দ্রের প্রতিপত্তি ছিল। তিনি বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করেছিলেন। যশশ্চন্দ্রের দুই স্ত্রী, নারায়ণী ও সরস্বতী। নারায়ণীর পুত্র কৃষ্ণ রায়। তিনি বিয়ে করেন সূর্য মিত্রের মেয়ে রাধাকে। কৃষ্ণ ও রাধার সন্তানই রামকৃষ্ণ। রামকৃষ্ণ কবিচন্দ্রের জন্ম ১৫৯০-৯৫ সালের মধ্যে কোনও এক সময়ে। কিশোরকালেই কবির মা রাধা মারা গিয়েছিলেন। বাবা ছেলের শিক্ষায় বিশেষ মনোযোগ দিয়েছিলেন। রামকৃষ্ণকে তিনি সুশিক্ষিত করে তোলেন। শাস্ত্রে অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল রামকৃষ্ণের। ছোট বয়সেই কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন রামকৃষ্ণ। সেই কারণেই তিনি কবিচন্দ্র উপাধি পান বলে মনে করা হয়। যদিও শিবায়ন ছাড়া তাঁর অন্য কোনও কাব্যের খোঁজ মেলে না। শিবায়ন কাব্যের ভণিতায় তিনি নিজেকে কবিচন্দ্র বা কবিচন্দ্র দাস বলে উল্লেখ করেছেন। একটি ভণিতা, ‘কবিচন্দ্র রচিলা সঙ্গীত শিবায়ন/ভক্ত নায়কে দয়া কর পঞ্চানন’।
রামকৃষ্ণের শ্রেষ্ঠ কীর্তি শিবায়ন কাব্য। ২৬টি পালায় বিভক্ত কাব্যে বৈষ্ণব কবিতার প্রভাব ছিল। ছন্দেও ছিল বৈচিত্র। ‘যত বিলাসিনী রচিল বেশ/বান্ধিল লোটন কুটিল কেশ/অলক তিলক অপরিশেষ/ চিত্রবসন ওড়নি’। রামকৃষ্ণের শিবায়ন কাব্যের তিনটি অনুলিখিত পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়। একটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, একটি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে রক্ষিত। তৃতীয়টি রয়েছে পাঁচুগোপাল রায়ের কাছে। সাহিত্য সমালোচকেরা মনে করেন, ভারতচন্দ্রের আগে এমন ছন্দের ব্যবহার বেশ বিস্ময়কর। রামকৃষ্ণ কবিচন্দ্রের আরেকটি কৃতিত্ব ছিল। তাঁর ‘শিবায়ন’ কাব্যে কিছু গদ্যের নিদর্শন রয়েছে ‘বচনিকা’ শীর্ষক রচনাগুলোয়। যেমন, ‘ভাইরে নারদের পরিহাসে, মেনকা রোদন করিতেছেন এমত সময়ে কেমন স্ত্রীলিঙ্গ দেবতাসকল আসিতেছেন অবধান কর’। পণ্ডিতদের অনুমান, ‘সম্ভবত বাঙলা সাহিত্যে সাহিত্যিক গদ্যের এটিই প্রাচীনতম নিদর্শন’। যদিও বাংলা গদ্যের প্রাচীনতম নিদর্শন ধরা হয় কোচবিহার রাজ নরনারায়ণের লেখা চিঠিকে। ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি অহোমরাজ চুকামফা স্বর্গদেবকে চিঠিটি লিখেছিলেন।
রামকৃষ্ণ ১৬২৫ সালের মধ্যে শিবায়ন কাব্য রচনা শেষ করেছিলেন বলে মনে করা হয়। রামকৃষ্ণের দুই বিবাহ। তাঁর দুই পুত্র জগন্নাথ ও বলরাম। কাব্য রচনা শেষের আগেই তিনি দুই পুত্রের জনক হয়েছিলেন। মোট সন্তানের সংখ্যা ছিল সাত। বেঁচেছিলেন ৯০ বছর। তাঁর মৃত্যুর কারণ হিসেবে একটি লুটপাটের ঘটনা দায়ী বলে মনে করা হয়। বংশের ধর্ম শৈব। কিন্তু চৈতন্যদেবের প্রতি তাঁর বিশেষ ভক্তি ছিল। পরে শৈব ধর্ম ত্যাগ করে বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। দীক্ষা লাভের পরে রাধাকান্ত নামে যুগল বিগ্রহ স্থাপন করেন। এই বিগ্রহ নিয়ে অলৌকিক কাহিনিও প্রচলিত ছিল।
বিপদ বাধালেন বর্ধমানের রাজা কৃষ্ণরাম রায়। কৃষ্ণরাম রাজ্য বৃদ্ধির অভিযানে নেমেছিলেন। ১০৯০ বঙ্গাব্দে রাজা কৃষ্ণরাম বালিয়া পরগনার রাজা চৈতন্য সিংহের রাজধানী নিজবালিয়া আক্রমণ করে জয় করে নেন। নিজবালিয়া গ্রামটি জগৎবল্লভপুর ব্লকের পাতিহাল গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্ভুক্ত একটি গ্রাম। এই গ্রামে প্রাচীন সিংহবাহিনী মন্দির রয়েছে। রাজা কৃষ্ণরাম কবিচন্দ্রের প্রতিষ্ঠা করা রাধাকান্তের কথা শুনেছিলেন। কবির সুনাম সম্পর্কেও তাঁর জানা ছিল। কৃষ্ণরাম প্রথমে রামকৃষ্ণকে ডেকে পাঠিয়ে বিগ্রহ তাঁর দিতে বলেন। বদলে ভূসম্পত্তি দেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু কবি রামকৃষ্ণ তা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন। রাজা গ্রাম আক্রমণ করেন। রামকৃষ্ণ বিগ্রহ লুকিয়ে রেখেছিলেন ঘুঁটের মাচায়। কিন্তু রাজার সৈন্যরা সেখান থেকে বিগ্রহ খুঁজে বার করে বর্ধমানে নিয়ে চলে যায়। বিগ্রহের শোকেই কবির মৃত্যু হয় বলে কথিত। কবির মৃত্যু হয় ১৬৮৪ সালের মার্চ মাসে। বাংলায় ১০৯০ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসের শেষে।
কবির পুত্র জগন্নাথ রাজা কৃষ্ণরামের কাছে বিগ্রহ ফেরত আনতে বর্ধমানে গিয়েছিলেন। তখনও অশৌচ কাটেনি। কাছা গলায় তিনি ভাইয়েদের নিয়ে রাজা দরবারে উপস্থিত হয়েছিলেন। রাজা বিগ্রহ দেননি। কিন্তু নতুন বিগ্রহ স্থাপন করে পুজো করার জন্য ৮৫ বিঘা নিষ্কর ভূমি দান করেন। রাধাকান্ত জীউর এখনকার মন্দির বেশি পুরনো নয়। আগের মন্দিরগুলো বিভিন্ন কারণে বারবার ধ্বংস হয়েছে। যশশ্চন্দ্রের প্রচলিত পারিবারিক এখনও হয়। রায় বংশের দুর্গাপুজোর একটা রীতি কিছুটা অভিনব। এর স্থানীয় নাম বুহিত তোলা। বুহিত শব্দটা এসেছে বহিত্র থেকে। অর্থাৎ নৌকা। এখন নবমীর পুজোয় বাঁশের নৌকা তৈরি করা হয়। মাঝরাতে সেই নৌকা বধূরা ঘরে নিয়ে যান। একেই বলে ‘বুহিত তোলা’।
দুর্গাপুজোর ‘বুহিত তোলা’ রীতি থেকে যশশ্চন্দ্রের রসপুরে আসার একটি পরোক্ষ কারণ অনুমান করা যায়। রায় বংশ একসময়ে নদীপথে বাণিজ্য করত। সেই বাণিজ্যের স্মারক চিহ্ন হল ‘বুহিত তোলা’। ভূরিশ্রেষ্ঠ ছিল বাণিজ্যে সমৃদ্ধ। যশশ্চন্দ্র সম্ভবত বাণিজ্যের কারণেই বর্ধমান থেকে রসপুরে এসেছিলেন। ভাগ্যিস এসেছিলেন। না হলে আমরা হাওড়াবাসীরা মধ্যযুগের অন্যতম কবিকে পেতাম না। প্রথম সাহিত্যিক গদ্যের লেখকেও পেতাম না।
তথ্যসূত্র: ১। ‘রামকৃষ্ণ রায় কবিচন্দ্র ও রসপুর রায় বংশের ইতিকথা’— শ্রীপাঁচুগোপাল রায়, ২। ‘সমগ্র বাংলা সাহিত্যের পরিচয়’— শ্রী পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, ৩। ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’- বিনয় ঘোষ।
কভারের ছবি— রামকৃষ্ণ রায়ের স্মৃতিবিজড়িত নাটমন্দির।
ছবি— ইন্দ্রজিৎ সাউ
(সমাপ্ত)